১১ জুন, ২০২১ ০৯:০১

জীবনের স্পন্দন কান পেতে শুনি বারবার

অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান চৌধুরী

জীবনের স্পন্দন কান পেতে শুনি বারবার

অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান চৌধুরী

জীবনটা একটা পরীক্ষা। এই পরীক্ষা এতটা সহজ না। অনেক কঠিন। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত মানুষকে এই পরীক্ষা দিয়ে যেতে হয়। মানুষের তথাকথিত পরীক্ষার মতো এখানে পাশ-ফেল নেই, আছে সফলতা-বিফলতা। জীবনের পরীক্ষায় কোনো সিলেবাস নেই, রুটিন নেই, রেজাল্ট নেই, নাম্বার নেই, আছে অনিশ্চয়তা, উৎকণ্ঠা, উদ্বেগ ও উত্তেজনা। জীবনের একটা সিদ্ধান্ত মানুষকে যেমন জীবনমুখী করতে পারে তেমনি জীবনবিমুখও করতে পারে। পলে পলে বদলে যায় মানুষের জীবনের দৃশ্যপট। কখনো উত্থান, কখনো পতন। কখনো হার, কখনো জিত। কখনো কষ্ট, কখনো আনন্দ। কখনো অনুকূল, কখনো প্রতিকূল। জীবনে যেমন পাবার আনন্দ আছে তেমনি হারানোর ভয় আছে। জীবন পরীক্ষার সবচেয়ে কঠিন কথাটি হলো জীবনে পাওয়াটা অনিশ্চিত কিন্তু হারানোটা নিশ্চিত। এই পরীক্ষাটা সময় যেন নিজে দাঁড়িয়ে মানুষের নেয়। মানুষ এই সময়টাতে খুব অসহায় হয় যেমন অসহায় হয় সময়, প্রকৃতি আর দৃষ্টিভঙ্গি। সময় যত সামনে গড়িয়েছে জীবনের পরীক্ষা তত কঠিন ও দুর্বোধ্য হয়েছে। আগে মানুষকে মানুষ চিনতো পারতো, এখন পারে না।

আগে মানুষ মানুষকে বুঝতে পারতো, এখন আর পারে না। আগে মানুষ মানুষকে বিশ্বাস করতো আর এখন উল্টো বিশ্বাস মানুষকে ত্যাগ করেছে। মানুষ মানুষের খুব কাছাকাছি এসেছে কিন্তু কেউ কাউকে আপন করে নিতে পারছে না। সবখানে স্বার্থে দেয়াল, কাঁচের স্বর্গ। বিশ্বাস-অবিশ্বাস শুন্যতায় ঝুলন্ত হয়ে জীবনকে কেমন যেন পাগলের মতো হাতড়িয়ে বেড়ায়। আবেগ, ভালোবাসা, জীবন বোধ সবকিছু কক্ষচ্যুত হয়েছে। কখনো কখনো ফেরারি আসামির মতো পালিয়ে বেড়াচ্ছে। জীবন পরীক্ষায় কোথায় যেন একটা জটিল মনস্তত্ব এসে ধাক্কা দিয়েছে। শকুনীদের চোখ পড়েছে জীবন পরীক্ষার উপর। পাপ আর পাপীরা এক হয়ে জীবন পরীক্ষাকে বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড় না করিয়ে নিজেদের মতো নাটক বানাচ্ছে। যেখানে জীবন পরীক্ষায় এগিয়ে থাকা মানুষদের কপালে পরাজয়ের কলংক লেপন করা হচ্ছে। মিথ্যের জয়োধ্বনিতে সত্যরা মাটিতে লুটিয়ে পড়ছে। মানুষের আত্মায় পচন ধরিয়ে কারো কারো চোখে-মুখে হিংস্র উন্মাদনার দেখা মিলছে। এভাবে এতটা অন্ধকারের কাছে কোনঠাসা হয়ে প্রতিদিন মানুষ জীবন পরীক্ষার কাছে আত্মসমর্পণ করে জীবন বিমুখ হচ্ছে। পথ হারিয়ে পথে বসছে। মানুষ এখন দৈত্য হয়ে মানুষের জীবনকে নিয়ে খেলেছে। সব বোঝা যায়, বলা যায়না। এ ভারসাম্যহীন সময়টাতে কেউ আর সাহস নিয়ে জীবন পরীক্ষাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে গ্রহণ করছে না। উল্টো সময়ের উল্টো পথে মানুষ হাটছে, নিজের ভিতরের শক্তিকে ভুলতে বসেছে। তারপরও কেউ হাত ধরে উপরে তোলার নেই। একটু আপন করে জীবনবোধকে জাগিয়ে তোলার কাউকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। কেউ জীবন পরিবর্তনের ডাকও দিচ্ছে না। সব যেন স্থবির আর জড় পদার্থের মতো ম্রিয়মান হয়ে পড়ে আছে।

জীবনের পরীক্ষা হতে পারে অনিশ্চিত। হতে পারে বাউন্ডুলে। হতে পারে নিয়ন্ত্রণহীন। হতে পারে নষ্টদের আগ্রাসনের শিকার। তারপরও তো জীবন থেমে থাকেনা। স্বপ্নের ভিতরে স্বপ্নের বীজ রোপিত হয়ে স্বপ্ন বৃক্ষের স্বপ্ন দেখতে চায় মানুষের জীবন। যে যায় বলুক, যে যায় করুক, মানুষ তো মানুষই। সে মানুষ হারিয়ে যাক, সে মানুষের জীবন পথভ্রষ্ট হোক কিন্তু মানুষের মূল্যবোধ অটুট থাকুক। তবেই পাপ আর পাপীদের ষড়যন্ত্র রুখে দিতে পারবে জীবনবোধ। হয়তো একটা বাঁচা-মরার লড়াই হবে। আগুনে পোড়া লোহার কষ্ট আর আর্তনাদের বোবা কান্না হয়ে বেরিয়ে আসার ইতিহাস হবে। শহরের পর শহরে জীবন থাকা মৃত মানুষগুলো আবার নতুন করে প্রাণ ফিরে পাবে। শিশির বিন্দুগুলো মানুষের ঘুম ভাঙাবে। মানুষ আবার জীবনমুখী হয়ে উঠবে। সেদিন জীবন পরীক্ষায় আর হারানোর কিছু থাকবে না। জীবনের স্পন্দন খুব মৃদু শব্দ করে কড়া নাড়ছে দরজায়। সে জীবনের দরজাটা খুলে গেলে পৃথিবীটা আরও অনেক বড় হবে। সে বড় পৃথিবীর ছোট মানুষ হতে চাই আমরা।

বিডি-প্রতিদিন/সালাহ উদ্দীন

সর্বশেষ খবর