তারুণ্য ও গণমানুষের কবি সুকান্তের ‘এদেশের বুকে আঠারো আসুক নেমে’র মতোই তারুণ্যের শক্তি, উদ্দীপনা ও সম্ভাবনা প্রায়ই দেশের জন্য ইতিবাচক ফলাফল বয়ে আনতে পারে। এ দেশের ইতিহাসে তারুণ্যই সকল অন্যায়, অবিচার ও শোষণের বিরুদ্ধে সবসময় রুখে দাঁড়িয়েছে। তবে এতদিনের তারুণ্যের শেষ আশ্রয়স্থল বলে খ্যাত সরকারি কর্মকমিশন বা পিএসসির মতো সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের প্রশ্নফাঁস তারুণ্যের উদ্দীপনা, আশা-আকাঙ্ক্ষা ও স্বপ্নকে ধুলিস্যাৎ করে দেয়।
কত ত্যাগ-তিতিক্ষা, ধৈর্য, অধ্যবসায় ও সংগ্রাম করে তারুণ্য নিজেকে চাকরি যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার জন্য যোগ্য করে গড়ে তোলে। তারুণ্যের স্বপ্ন দুঃস্বপ্ন হয়ে যায় প্রশ্নফাঁসে জড়িত সৈয়দ বংশের আবেদ আলীসহ কতিপয় ব্যক্তির জন্য। দেশকে মেধাশূন্য ও তারুণ্যের স্বপ্নকে ভেঙে দিতে এসব সিন্ডিকেটের কার্যক্রম দীর্ঘদিন থেকে চলে আসছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল ছাড়াও সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রশ্নপত্র ফাঁসে চক্রটির ভূমিকা রয়েছে।
কোটা আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে এ বিষয়টি আরো বেশি সময়োপযোগী ও প্রাসঙ্গিক। বিসিএসে লক্ষণীয় যে ৫৬ শতাংশ কোটার বিপরীতে মাত্র ৪৪ শতাংশ শূন্য পদে এদেশের লাখো তারুণ্যের চাকরি পাওয়ার সম্ভাবনাকে চ্যালেঞ্জ করে। কারণ, যারা শতকরা ৪৪ জন মেধাক্রমে চাকরি পেতেন তাদের সম্ভাবনা কমতে থাকে যখন প্রশ্নফাঁসের কারণে অনৈতিক সুবিধা পেয়ে কিছু অযোগ্য প্রার্থী যোগ্য প্রার্থীদের স্বপ্ন ছিনতাই করে তারুণ্যের সম্ভাবনাকে ধূলিস্যাৎ করে। তখন তারুণ্য নিজেকে আসামির কাঠগড়ায় দাঁড় করান। এ দেশটি সত্যিই যোগ্য ও মেধাবীদের জন্য? কোটার বদৌলতে ৫ হাজারতম হয়েও কেউ তার কাঙ্ক্ষিত ক্যাডার পেয়ে যান আবার মেধাক্রমে অনেক এগিয়ে থেকেও একটি ক্যাডার পদ থেকে বঞ্চিত হন। পিএসসির লিখিত রেজাল্ট সিটের তথ্য অনুযায়ী কেউ ৫৪৭ পেয়েও নন ক্যাডার হন আবার কেউ ৪৫০ পেয়েও ক্যাডার পেয়েছেন।উল্লিখিত তথ্যই প্রমাণ করে বৈষম্য কতটা প্রবল!এছাড়াও অন্যান্য নন ক্যাডার চাকরিতে ৬১ শতাংশ, রেলে ৮২ শতাংশ ও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ৯৬ শতাংশ পর্যন্ত কোটার যৌক্তিকতা নিয়ে সর্ব মহলে প্রাসঙ্গিক ভাবনা ও প্রশ্ন রয়েছে। অধিকাংশ মহলই মনে করেন মেধাকে পাশ কাটিয়ে বিশালসংখ্যক কোটায় নিয়োগ ভবিষ্যতের স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে অত্যন্ত অগ্রহণযোগ্য ও অযৌক্তিক। এমন বাস্তবতায় কোটার যৌক্তিক সংস্কার ও সমাধান সবাই প্রত্যাশা করে। কোটা নিয়ে গত কয়েকদিন অনেক যৌক্তিক বিশ্লেষণ, ব্যাখ্যা, উচ্চ আদালতের রায় ও নির্দেশনা এবং আন্দোলনকারী, রিটকারী, বুদ্ধিজীবী ও রাজনৈতিক মহলে প্রচুর আলোচনা, বিতর্ক, ও টকশো সম্পন্ন হয়েছে। বিশেষজ্ঞগণ মেধাপাচার ও তারুণ্যের বিশাল অংশের দেশ ত্যাগের অন্যতম কারণ হিসেবে যোগ্য ও মেধাবীদের অবমূল্যায়নকে দায়ী করেন। মাঝেমধ্যেই অফলাইন, অনলাইনে তারুণ্যের বিরাট একটি অংশকে দুঃখ ও ক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখা যায়।
সমাজ বিজ্ঞানীগণ মনে করেন, ২০১৮ সালের ন্যায় চলমান কোটা আন্দোলন, প্রশ্নফাঁস, রাঘব বোয়ালদের মেগা দুর্নীতির তথ্য, ব্যাংকিং সেক্টরে অস্থিরতা, অর্থ পাচার নিয়ে তারুণ্যের বিশাল অংশের মধ্যে হতাশা ও দেশ ছাড়ার প্রবণতা বেড়েছে। এদেশের বুয়েট, মেডিকেলসহ মেধাবী তরুণরা আগের চেয়েও বেশি সংখ্যক দেশ ছাড়ছেন। সামগ্রিকভাবে তরুণ সমাজের মনে নিজের দেশ ও প্রিয় জন্মভূমি নিয়ে একটি বিরূপ প্রভাব পড়ছে।
আবেদ আলীসহ প্রশ্নফাঁস করে যারা আলাদিনের চেরাগ হাতে পেয়ে কোটি কোটি টাকা অবৈধভাবে হাতিয়ে নিয়েছেন তাদের সিন্ডিকেট বিশাল। অনেকেই মনে করছেন সিন্ডিকেটের রাঘব বোয়ালদের বাঁচানোর জন্য আবেদ আলীর মতো লোকদের নিয়ে বেশি মাতামাতি হচ্ছে। কর্মকমিশনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সিরিয়াল প্রশ্নফাঁস লাখ লাখ তরুণের স্বপ্নের সাথে প্রতারণা করে তারুণ্যের স্বপ্ন ও সম্ভাবনাকে ছিনিয়ে নিয়েছে।
চ্যানেল ২৪ এর প্রতিবেদনে বিসিএস এর প্রশ্নফাঁসের যে তথ্য উপস্থাপিত হয়েছে তা অত্যন্ত মর্মপীড়াদায়ক। পিএসসির চেয়ারম্যান প্রশ্নফাঁসের বিষয়টিকে যেভাবে উড়িয়ে দিয়েছেন এবং তা অস্বীকার করে রাতে প্রেসবিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছেন তা অত্যন্ত দুঃখজনক ও অগ্রহণযোগ্য। পিএসসির মতো সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের উপর তারুণ্যের যে প্রবল আস্থা ও বিশ্বাস ছিল তা আজ আইসিইউতে। প্রতিবেদনে দেখানো হয়েছে, ৪৬তম বিসিএসে কীভাবে বুথ বসিয়ে অভিনব কায়দায় প্রশ্নফাঁস করে পরীক্ষার আগের রাতে প্রশ্ন মুখস্ত করিয়ে কতিপয় প্রার্থীকে প্রিলিমিনারি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে সহায়তা করা হয়। এখানে প্রশ্ন থেকে যায় একটি বুথে যদি ১০০ জন পরীক্ষার্থীকে প্রশ্ন দেওয়া হয়, না জানি আরো কত বুথে কতজনকে প্রশ্ন দেওয়া হয়েছে। প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, ২৪তম থেকে ৪৬তম বিসিএস পর্যন্ত একটি সঙ্ঘবদ্ধ চক্র বিসিএস ও নন ক্যাডারসহ অন্তত ৩০টি চাকরি পরীক্ষার প্রশ্নফাঁস করেছে। প্রশ্নফাঁসকারী কতিপয় ব্যক্তি এ জাতির লাখ লাখ তারুণ্যের স্বপ্ন, সম্ভাবনা ও ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলেছে।
সিআইডি যে ১৭ জনকে আটক করেছে তাদের মধ্যে সাতজন জবানবন্দীতে প্রশ্নফাঁসের কথা স্বীকার করেছেন, যাদের মধ্যে পিএসসির কর্মকর্তাও রয়েছেন। যাতে পিএসসির অস্বীকার করে দেওয়া প্রেস বিজ্ঞপ্তি অমূলক ও অযৌক্তিক বলে প্রমাণিত হয়েছে। পিএসসির অফিস সহায়ক সাজেদুল ইসলাম ও সাবেক ড্রাইভার আবেদ আলী অকপটে গণমাধ্যমের ক্যামেরায় তা স্বীকার করেছেন। সাজেদুলের বোন ও ভগ্নিপতি দুজনই পররাষ্ট্র ক্যাডার বলে দৈনিক সমকাল পত্রিকা জানিয়েছে। এছাড়াও আবেদ আলী বিভিন্ন বিসিএসে ১০৫ জনকে ক্যাডার বানিয়েছেন বলে স্বীকারোক্তি দিয়েছেন। তাদের মধ্যে ২৭ বিসিএসের তিনজন, ২৯ বিসিএসে দুইজন ও ৩৩ বিসিএসের তিনজন ক্যাডার রয়েছেন।
সরকারি কর্মকমিশনের মতো সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের কাছে এদেশের শিক্ষার্থী সমাজ ও গণমানুষের প্রত্যাশা অনেক বেশি। এ প্রতিষ্ঠানের যেকোনো ধরনের ব্যত্যয় ও অনিয়ম আমাদের অনেক বেশি ব্যথিত করে। দৈনিক প্রথম আলোর তথ্য মতে, পিএসসির প্রশ্নফাঁসের ব্যাপারে কর্তৃপক্ষ অবগত ছিলেন। সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে কর্মকমিশন কোনোভাবেই প্রশ্নফাঁসের দায় এড়াতে পারে না। এ প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান ছিলেন জাঁদরেল সিএসপি সা'দত হোসেন ও বেকারবান্ধব বলে পরিচিত ড. মোহাম্মদ সাদিক যারা তারুণ্যের আস্থা অর্জন করে অত্যন্ত সুনামের সাথে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। তাদের উত্তরসূরীদের কাছে প্রত্যাশা প্রতিষ্ঠানটির সুনাম ও ভাবমূর্তি অক্ষুণ্ন রাখবেন।
পাবলিক পরীক্ষা (অপরাধ) আইন ১৯৮০’ অনুযায়ী প্রশ্ন ফাঁস হলে পরীক্ষা বাতিল করতে হবে কি না, এ বিষয়ে সেখানে সুনির্দিষ্ট কিছু বলা নেই। তবে বিশেষজ্ঞগণ বলেন, পরীক্ষা বাতিল করার ক্ষমতা পিএসসির রয়েছে। এর আগেও ২৪তম ও ২৭তম বিসিএসের চূড়ান্ত ফল প্রকাশের আগে বাতিল হয়েছিল। কিন্তু বিজ্ঞ আইনজীবী ও বিশেষজ্ঞগণ বলছেন, নিষ্পত্তি হওয়া বিসিএস বাতিল করতে গেলে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানটিকে আইনি জটিলতাই পড়তে হবে। আদালতে কোনোভাবেই তা টিকবে না। কেননা সব প্রার্থী প্রশ্নফাঁস করে ক্যাডার হয়েছেন এমন প্রমাণ পিএসসি দিতে পারবে না। তবে দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারবে এবং দোষী কেউ ক্যাডার হয়ে থাকলে তার প্রার্থিতা বাতিল করতে পারবে। উক্ত আইনে পরীক্ষা আরম্ভ হওয়ার পূর্বে প্রশ্নপত্রের প্রকাশনা ও বিতরণ সম্বন্ধে উল্লেখ আছে যে ‘‘কেউ যদি পরীক্ষার আগে কোনো উপায়ে প্রশ্নফাঁস, প্রকাশ বা বিতরণ করেন, তাহলে ‘তিনি চার বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড কিংবা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হইবেন।” তবে এই আইনে সাজা কম হলেও দুদকের আইনে প্রশ্নফাঁসের সাত বছর পর্যন্ত কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা যায়। এছাড়াও ২০২৩ সালের পিএসসির প্রশ্নফাঁস আইনে ১০ বছরের সর্বোচ্চ শাস্তির কথা বলা আছে।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু একটি বৈষম্যহীন, শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, সুবিচার এবং মানবিক মর্যাদাসম্পন্ন রাষ্ট্র গড়তে চেয়েছিলেন, যা সংবিধানের প্রস্তাবনায় উল্লেখ আছে। তিনি বলেছিলেন, ‘এই পৃথিবী দুই ভাগে বিভক্ত। শোষক ও শোষিত। আমি শোষিতের পক্ষে।’ মহান মুক্তিযুদ্ধে আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধারাও বৈষম্য ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রিয় মাতৃভূমি রক্ষায় ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন।
প্রশ্নফাঁসে জড়িত অপরাধীরা বিভিন্ন সময় গ্রেপ্তার হলেও আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে, রাষ্ট্রপক্ষের প্রচেষ্টার অভাবে অথবা সাক্ষীর অভাবে ছাড়া পেয়ে যায়। জড়িত কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বিধি মোতাবেক চাকরিচ্যুত করে আইনে সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। শাস্তির মাত্রা যাবজ্জীবন ও অত্যধিক জরিমানা আরোপ করে আইন সংশোধন ও দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে পারলে ভবিষ্যতে কোনো উদ্যত কালো হাত প্রশ্নফাঁস করতে সাহস পাবে না। প্রশ্নফাঁসে জড়িত সকল সিন্ডিকেট গুঁড়িয়ে দিতে হবে। পিএসসির পরীক্ষার পুরো সিস্টেম অটোমেশন ও কঠোর নজরদারি নিশ্চিত এবং পুরো সিস্টেমকে ঢেলে সাজাতে হবে। পিএসসির কালো বিড়ালকে সমূলে উৎপাটন করতে হবে। পিএসসির সোনালি অতীত আবার ফিরে আসুক। ধ্বংস হোক প্রশ্নফাঁসকারীদের কালো হাত। দূর হোক চাকরিপ্রার্থীদের সংশয় ও অনাস্থা।
লেখক: শিক্ষক ও কলামিস্ট
[email protected]