প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস আঁচ করেছেন, দানবীয়-ফ্যাসিস্টরা আবার গোলমাল পাকাচ্ছে। করছে ষড়যন্ত্র, রটাচ্ছে গুজব। আর বিবেচক যে কেউ আঁচ করছেন সেনাবাহিনী বিতর্কিত করার ফের আয়োজন। সেনাবাহিনীর প্রতি জনমানুষের আস্থার প্রাচীর ভাঙার কাপালিকদের তৎপরতা।
বিপদে, দুর্যোগে, জননিরাপত্তায়; এমনকি গেল ৫ আগস্ট জনতার আন্দোলনকে একটি চমৎকার সমাপ্তিতে নেওয়ার অনবদ্য ভূমিকা রাখা সেনাবাহিনীর গায়ে কালিমা লেপতে গুজব ফ্যাক্টরিগুলোর সামপ্রতিক তৎপরতা স্পষ্ট। যখন সেনাসম্পৃক্ততায় একটি চমৎকার নির্বাচনের প্রত্যাশায় অনেকে বুক বাঁধছেন, যখন উত্তরায় মাইলস্টোনে বিমান বিধ্বস্তের পর জানবাজি রেখে সেনা সদস্যরা উদ্ধার ও চিকিৎসা তৎপরতায় যারপরনাই ব্যস্ত, যখন সেই সেনাবাহিনীর এক সদস্য যাঁর নিজের দেহ থেকে খুলে দেওয়া পোশাকে এক মৃত মায়ের সম্মান রক্ষায় রত, তখন কৃতজ্ঞতার বদলে এ কোন কৃতঘ্নতা? সচেতন যে কারোই বোধগম্য, সংকটে কারা প্রকৃত সাহায্যের হাত বাড়ায়।
এমন ট্র্যাজেডিতেও কারো ফোনের ক্যামেরা শিশুটির দগ্ধ হওয়ার মুহূর্ত ক্যাপচারে ব্যস্ত থাকে কন্টেন্ট-ভাইরাল বাতিকে। ৩০ টাকার বোতল ৫০০ টাকায় বিক্রির চাতুরিতে মত্ত পানিওয়ালা।রিকশাওয়ালা, সিএনজিওয়ালা কয়েক গুণ বেশি ভাড়া তোলায় এগোয় না। ঘরপোড়ার মাঝে আলু পোড়া খাওয়ার এ উদাম দৌড়ে লুটেরা মনোবৃত্তি। কেউ দুর্ঘটনার পিক টাইমে রাস্তা বন্ধ করে ফটোশুটের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। প্রথম প্রতিক্রিয়ায়ই ঘটনাস্থলে পৌঁছে জীবন বাঁচানোর লড়াইয়ে নামেন সেনা সদস্যরা।
ইউনিফর্ম খুলে জড়িয়ে দিয়েছেন পুড়ে যাওয়া মানুষদের গায়ে। এমন সময়ও সেনাবাহিনীর দিকে আঙুল তোলা? সেনাবাহিনীকে নিয়ে গুজব রটাতে খোদার আরশ কাঁপানো বর্বরতা। লাশ গুমের কিচ্ছা, বানোয়াট ফুটেজ। কারো আঙুল বা চোখ গেল না ত্রুটিপূর্ণ বিমান কেনার সিস্টেম, নিরাপত্তা ফাঁকি দিয়ে বিল্ডিং অনুমোদন দেওয়া কর্তৃপক্ষের দিকে। এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনা শুধু একটি প্রতিষ্ঠানকে নয়, গোটা জাতিকে স্তব্ধ করেছে।
চোখের সামনে ঘটে যাওয়া এই নির্মম বিপর্যয় আমাদের সামষ্টিক ব্যর্থতার এক নির্মম চিত্র তুলে ধরেছে। সেই সঙ্গে দুর্যোগকেও সুযোগ হিসেবে নিয়ে সেনাবাহিনীকে নিয়ে গুজব রটানোর নোংরা খেলা চলছে। সেনাবাহিনী একটি দেশের সার্বভৌমত্ব, নিরাপত্তা এবং স্থিতিশীলতার প্রধান প্রতীক। ইতিহাসে বহুবার দেখা গেছে, রাষ্ট্র যখন দুর্বল হয়েছে, তখন সেনাবাহিনী তার শৃঙ্খলা ও বলের মাধ্যমে দেশকে টিকিয়ে রেখেছে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে, সাম্প্রতিক সময়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্ন মাধ্যমে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে নিয়ে গুজব ছড়ানো ও বিতর্কে জড়ানোর গভীর ষড়যন্ত্রে নয়া আয়োজন লক্ষণীয়। কিছু অনলাইন পোস্ট, ইউটিউব ভিডিও ও বিভ্রান্তিকর সংবাদ শিরোনামে সরকারের সঙ্গে সেনাবাহিনীর বিরোধ, ব্যারাকের ভেতরে অসন্তোষ, পক্ষপাতিত্ব, এমনকি অবস্থান গ্রহণের মতো গুজব ছড়াতেও কম করা হয়নি। সেনাবাহিনীকে বিতর্কিত করতে সক্ষম হলে, তাদের প্রতি জনতার বিশ্বাস ভাঙতে পারলে লাভ হবে কার? এতে মোটাদাগে লাভবান হবে রাষ্ট্রবিরোধী শক্তি। ক্ষতিগ্রস্ত হবে রাষ্ট্র, জনগণ এবং ভবিষ্যৎ। তাই সেনাবাহিনীকে নিয়ে রাজনীতি বা সেনাবাহিনীকে দিয়ে রাজনীতি; কোনোটাই এ দেশে টেকেনি। বুমেরাং হয়েছে নিদারুণভাবে। যারা সেই চেষ্টা করেছেন বরণ করতে হয়েছে করুণ পরিণতি। পতিত-বিতাড়িত হয়েছেন, দেশান্তরিও হয়েছেন।
বর্তমান সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের এ বিষয়ক ঘোষণা আরো পরিষ্কার। মনেপ্রাণে তাঁর একটি বিশ্বাসের কথাও বলেছেন, রাজনীতিবিদদের বিকল্প রাজনীতিবিদরাই। তাঁদের বিকল্প সেনাবাহিনী নয়। এভাবে বলার পর আর কথা থাকে না। কিন্তু মহলবিশেষের কাছে কথার পিঠে কথা থেকেই যায়। তা-ও কথার কথা নয়। কদাকার, নোংরা, কটুকথা। যার পুরো উদ্দেশ্যই বিভ্রান্তি তৈরির অপচেষ্টা। সেনাপ্রধান কেন রাজনৈতিক বিষয়ে কথা বলেন? তিনি কি ক্ষমতা নিতে চান? কাউকে ক্ষমতায় আনতে চান? এ ধরনের অবান্তর-অবাস্তব বিষয়কে রসিয়ে, রং মেখে নানা প্রশ্ন ছড়াচ্ছে। গোলমাল বাধাতে কিছুটা সফলও হচ্ছে। তাদের মূল ভরসা সোশ্যাল মিডিয়া। নামে সোশ্যাল হলেও এই মাধ্যমটিকে রীতিমতো আনসোশ্যাল করে তুলছে তারা। আজগুবি তথ্য ও মিথ্যাচারে ভরিয়ে দিচ্ছে।
শুরু থেকে যেকোনো ত্যাগ স্বীকার করে অন্তর্বর্তী সরকারের পাশে থাকার অঙ্গীকার বারবার ব্যক্ত করেই চলছেন সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান। তাঁকে যেন কাদম্বিনীর মতো ‘মরিয়া প্রমাণ করিতে হইবে যে তিনি মরেননি।’ তিনি যে বেঁচে আছেন সেটাও ঘটনা। ৫ আগস্ট পূর্বাপর গান পয়েন্টেই ছিলেন জেনারেল ওয়াকার। পুলিশ ও তখনকার ক্ষমতাসীনদের বিভিন্ন দলের লাঠি-গুলির মাঝে সেনাবাহিনীকে ফিরিয়েছেন ‘নো ফায়ার’ নির্দেশে। তা মাত্র ৯-১০ মাস আগের ঘটনা। তখন কী দশা-দুর্গতিতে ছিল বাংলাদেশ! কার অসিলায় কিভাবে এখন মুক্ত বাতাসে দম-নিঃশ্বাস নিচ্ছেন এখন যারা সিনা টান করে ঘুরছেন? আর রটাচ্ছেন-ছড়াচ্ছেন নানা আকথা? মানবসৃষ্ট বা প্রাকৃতিক বড় রকমের বিপর্যয় ঘটলে সেনা ডাকতে মন চায়। দ্রুত এবং মানসম্পন্ন নির্মাণকাজ চাইলে আবশ্যক মনে করা হয় সেনাবাহিনীকে। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য অর্ধেক খরচে সেনাবাহিনী ঘর বানিয়ে দিলে মন্দ লাগে না। ঝিল, লেক, খাল মজে গেলে তা উদ্ধার ও খননে ডাক পড়ে সেনাবাহিনীর। জাতিসংঘ মিশনে গিয়ে সেনাবাহিনী দেশে টাকা পাঠালে তা রেমিট্যান্স নামে অর্থনীতিতে যোগ করতেও চমক বলে মনে হয়। জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে আহতদের সেনা ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত হাসপাতালে চিকিৎসায়ও যারপরনাই আস্থা জাগে। এমন সময়ও সিভিল প্রশাসনের সারথি হয়ে মাঠে কাজ করছে সেনাবাহিনী। তা গোপনে বা আড়ালে নয়, একেবারে প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়ে। সেনা সদর থেকেও মাঝেমধ্যে জানানো হয় তাদের কর্মলিপি।
চব্বিশের পটপরিবর্তনে সেনাবাহিনীর জনসম্পৃক্ততার অনন্য দৃষ্টান্তকে বানচাল করতে মহলবিশেষ তাদের নন-স্টপ ফাঁদে কদিন ধরে নতুন করে শান দিচ্ছে। কেউ দেশে, কেউ ভিন দেশে বসে এ অপকর্মে যুক্ত হচ্ছে। স্যোশালমিডিয়ার কথা ভিন্ন। কারণ তাদের কোনো সম্পাদকীয় কর্তৃপক্ষ নেই। দায়বদ্ধতা নেই। হিট বা ভাইরাল হতে গিয়ে নিজের সম্পর্কে অশ্রাব্য শব্দ-বাক্য ব্যবহারেও তাদের বাধে না। সেনাবাহিনীর প্রাথমিক দায়িত্ব হচ্ছে বাংলাদেশ ভূখণ্ডের অখণ্ডতা রক্ষাসহ বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে দেশকে রক্ষা করা এবং সব ধরনের নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা সহায়তায় বাংলাদেশ নৌবাহিনী এবং বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর সঙ্গে প্রয়োজনীয় শক্তি ও জনবল সরবরাহ করা। প্রাথমিক দায়িত্বের পাশাপাশি যেকোনো জরুরি অবস্থায় বেসামরিক প্রশাসনের সহায়তায় এগিয়ে আসতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সাংবিধানিকভাবে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। যুদ্ধবিদ্যায় বিশ্বসেরা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে ‘উই রিভোল্ট’ বলা একাত্তরে এই বাহিনীর বীরত্বগাথা। পাকিস্তানিরা এ অঞ্চলের অধিবাসী সেনাদের নিয়ে ব্যঙ্গ করত। ভেতো বাঙালি বলে মশকরা করত। ওই ‘ভেতোদের’ একজন তৎকালীন মেজর জিয়াউর রহমান।
নব্বইয়ের গণ-আন্দোলনে যুক্ত হয়েছিল তখনকার সেনাপ্রধান জেনারেল নূরউদ্দীন খানের ‘এনাফ ইজ এনাফ’, অনেক হয়েছে আর না জানিয়ে দেওয়া। জনতার সঙ্গে সেনাদের উপলব্ধির ওই ভূমিকার জেরে ১৯৯০ সালের ৪ ডিসেম্বর ক্ষমতা ছাড়ার ঘোষণা দিতে হয় এরশাদকে। দেশ, জনতা, সময় এবং বাস্তবতার চাহিদায় সেনাবাহিনীর এ ধরনের ঐতিহাসিক ভূমিকার মাঝে রাজনীতি খোঁজা এক ধরনের বিমারির মতো। বরং দেশপ্রেম ও জন-আকাঙ্ক্ষার দৃষ্টান্ত খুঁজলে অনেক উপাদান মিলবে। এখনকার সেনাপ্রধানের ক্ষমতালিপ্সা থাকলে তা কবেই চরিতার্থ করতে পারতেন। তিনি সেই পথ মাড়াননি। মাড়াবেনও না বলে জানিয়েছেন সোজাসাপটা বাংলা ভাষায়। এমনকি তাঁর বাহিনীকে নিয়ে রাজনীতি করার সুযোগ দেবেন না বলে দৃঢ় প্রত্যয়ও রয়েছে তাঁর।
সামনে একটি নির্বাচন। ভোটের সংস্কৃতি বরবাদের হোতাদের বিচার চলছে। তাই সুষ্ঠু, অবাধ, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের উচ্চাশা এবার ব্যাপক। কেবল নির্বাচন নয়, ভালো কিছুর জন্য মানুষের মধ্যে সেনাবাহিনীকে পাশে পাওয়ার এক তাড়না কাজ করে। সেনাবাহিনীর অধীনে নির্বাচনের কথা অনেকবার এসেছে। সেখানেও একটা ফের থাকে। বিরোধী দলে থাকলে এ দাবি যত জোর দিয়ে উচ্চারণ করা হয়, সরকারে গেলে কথা ও সুর বদলে যায়। আবার বাস্তবতা হলো—বাংলাদেশের নির্বাচনে সেনাবাহিনী মোতায়েন যত না ‘রেওয়াজ’, তার চেয়ে বেশি ‘প্রয়োজন’। এবারের পরিপ্রেক্ষিত ভিন্ন। ফ্যাসিবাদবিরোধী লড়াইয়ে সেনাবাহিনীর অবস্থান স্পষ্ট করার ইতিহাস তৈরি হয়েছে চব্বিশের গণ-আন্দোলনের চূড়ান্ত বা মোক্ষম সময়ে। জাতির পরম আস্থা ও ভালোবাসার প্রতীক বাংলাদেশ সেনাবাহিনী রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠার সঙ্গে দেশ গঠনেও নিরবচ্ছিন্ন ভূমিকার একটি নতুন দৃশ্যায়ন ঘটল এবার। সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান কথা দিয়ে রেখেছেন, জনস্বার্থে ও রাষ্ট্রের প্রয়োজনে সেনাবাহিনী সব সময় জনগণের পাশে থাকবে। সেই সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারকে সফল করার লক্ষ্যে যাবতীয় চেষ্টা করবে। যত দ্রুত সম্ভব নির্বাচনের কথা গেল বছরের সেপ্টেম্বরেই বলে রেখেছেন সেনাপ্রধান।
দেশের এবারের সামগ্রিক অনিবার্য পরিস্থিতিতে ম্যাজিস্ট্রেসি সক্ষমতা নিয়ে এখনো মাঠে আছে সেনাবাহিনী। আর আছে বলেই সম্ভাব্য অনেক বিপদ থেকে রক্ষা। জননিরাপত্তা, অনাকাঙ্ক্ষিত অরাজকতা প্রতিরোধ, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্টের কারসাজি রুখে দেওয়া, মিল-কারখানা সচল রাখা, রাষ্ট্রের কেপিআই এবং গুরুত্বপূর্ণ সরকারি-বেসরকারি স্থাপনাগুলোকে রক্ষা, সড়ক-মহাসড়ক বাধামুক্ত রাখা, অবৈধ অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধার, বিদেশি কূটনীতিক ও দূতাবাসগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিতের কাজ সেনাবাহিনী যেভাবে করে যাচ্ছে, তা বিবেকবানরা উপলব্ধি করছেন মর্মে মর্মে।
লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট, ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন।