প্রাচীন গ্রিসের মহান বীর আলেকজান্ডার, তাঁর বিশ্বজয়ের অভিযানে একসময় পৌঁছে গিয়েছিলেন আমাদের উপমহাদেশের খাইবার গিরিপথে। বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে তাঁর সহচর সেলুকাসকে উদ্দেশ করে বলেছিলেন, ‘কী বিচিত্র এই দেশ, সেলুকাস!’
কেন এমন বলেছিলেন তিনি? এই দেশের ভূগোলের বৈচিত্র্যে? ঋতুর রং বদলের খেলায়? না কি মানুষের ভাবনার অদ্ভুত ছন্দপতনে?
ইতিহাসবেত্তাদের অনুসন্ধান হয়তো কখনো সেই রহস্য ভেদ করবে। তবে আমরা জানি, বহিরাগতরা যখনই এই মাটিতে পা রেখেছে, তারা বিস্ময়ে থমকে গেছে। কেউ কেউ প্রশংসায় মুখর হয়েছে, কেউ আবার ভীত হয়েছে এখানকার নদী, প্রকৃতি, মানুষের চঞ্চল মনের স্রোতে। যেমন একবার এক মোগল সম্রাট বাংলায় নৌবিহারে এসে জোয়ার-ভাটার খেলা দেখে রীতিমতো বিমূঢ় হয়ে পড়েন। সতর্ক করেন সঙ্গীদের, ‘যে দেশের ভূমি সকালে এক রকম, বিকালে আরেক রকম, সে দেশের মানুষের মনোভাবও যে অস্থির ও বৈচিত্র্যময় হবে, তা বলাই বাহুল্য।’
এ দেশের মানুষ সহজসরল, তবু বিপদের মুখে দুর্ধর্ষ। তাদের সহনশীলতা অসীম, কিন্তু চরম অন্যায় বা পরাধীনতার সম্মুখে তারা পরিণত হয় অদম্য যোদ্ধায়। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, বারবার বিশ্বাসঘাতকতা, চক্রান্ত, বিদেশি আগ্রাসন সত্ত্বেও এই জাতি একত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে নিজের অস্তিত্ব রক্ষায়।
তারেক রহমানের প্রতীক্ষায় ১৮ কোটি মানুষতবু, কিছু ঘৃণ্য আত্মপ্রেমিক, সুবিধাবাদী কুচক্রী বারবার সেই ঐক্যের ভিত নষ্ট করেছে। পলাশীর প্রান্তরে যেমনটি ঘটেছিল, যেখানে বাংলার শাসনভার এক অযোগ্য, লোভী সেনাপতির হাতে তুলে দিয়ে ইতিহাসের গায়ে লেখা হয়েছিল গভীর কলঙ্কচিহ্ন। মীরজাফর ছিলেন শুধু নামমাত্র বিশ্বাসঘাতক, প্রকৃত বিপর্যয় ডেকে আনে রায় দুর্লভ, উমিচাঁদ, জগৎশেঠ আর রাজবল্লভদের মতো স্থানীয় ষড়যন্ত্রকারীরা। আজও সেই চক্রান্তের ছায়া আমরা দেখতে পাই। আধুনিক যুগে, প্রযুক্তির মুখোশে মুখ ঢাকা সেই প্রেতাত্মারা যেন ভর করেছে কিছু নব্য রাজনীতিক আর সুবিধাবাদী গোষ্ঠীর ওপর। তারেক রহমান একজন প্রতিশ্রুতিশীল, সংস্কারমুখী, দেশপ্রেমিক নেতা, যাঁর জনপ্রিয়তা আর প্রজ্ঞাই হয়ে দাঁড়ায় তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের প্রধান কারণ।
সেনাসমর্থিত এক-এগারো সরকারের আমলে তারেক রহমানকে গ্রেপ্তার করা হয় কোনো ওয়ারেন্ট ছাড়াই। তাঁর ওপর চলে এমন নির্মম নির্যাতন, যার বিবরণ শোনাও কষ্টকর। তাঁর মেরুদণ্ড ভেঙে দেওয়া হয়, কাঁধ ও হাঁটুর হাড় ক্ষতিগ্রস্ত করা হয়। আর এসব করা হয় শুধু তাঁর উত্থান থামিয়ে দিতে-যাতে তিনি আর হাঁটতে না পারেন, কথা বলতে না পারেন, রাজনীতি করতে না পারেন।
কেন এত নিষ্ঠুরতা? কারণ তাঁর নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ হতো আত্মনির্ভরশীল, প্রযুক্তিনির্ভর, শিক্ষানির্ভর, আধুনিক। জাতি হতো না কারও গোলাম। আর যাঁকে দেশ চালাতে হতো না বিদেশি চক্রের ইশারায়। তাঁর জনপ্রিয়তা, জনসম্পৃক্ততা এবং তৃণমূল রাজনৈতিক সংগঠন নির্মাণের দক্ষতায় এসব চক্রের চোখে তিনি ছিলেন বিপদের বার্তা। ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপির গঠনমূলক প্রচারণা, সুসংগঠিত পরিকল্পনা এবং দেশব্যাপী তরুণদের উদ্দীপনায় যে জোয়ার দেখা গিয়েছিল, তার মূল স্থপতি ছিলেন তারেক রহমান। তিনি আধুনিক রাজনৈতিক কৌশল, জনসম্পৃক্ত ভাষা এবং তৃণমূল পর্যায়ের শক্তিকে কাজে লাগিয়ে দলকে জয়ের পথে নিয়ে গিয়েছিলেন।
এটাই হয়ে দাঁড়ায় তাঁর ‘অপরাধ’। তারপর শুরু হয় প্রপাগান্ডার খেলা, গল্প রচনা হয়, কল্পকাহিনির মতো কেস বানানো হয়। মিডিয়ার একাংশ নিজেদের দায়িত্ব ভুলে গিয়ে হয়ে ওঠে অপপ্রচারযন্ত্র। তাঁকে কেন্দ্র করে যত মামলা, তার একটিতেও তিনি সরাসরি অভিযুক্ত নন, কিন্তু উদ্দেশ্য ছিল পরিষ্কার, তাঁকে বিতাড়িত করা, নিঃশেষ করা।
কিন্তু ইতিহাস বলে, সত্যকে চিরদিন চাপা রাখা যায় না। যাঁর হৃদয়ে গরিব, কৃষক, শ্রমিক আর মেধাবী ছাত্রদের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা আছে, যিনি দেশের জন্য নিজের স্বস্তি বিসর্জন দিতে পারেন, তাঁর জয় অবশ্যম্ভাবী। দুর্দিনে মানুষ তাঁর মুখ মনে রেখেছে, তাঁর সাহায্যের হাত মনে রেখেছে। সীমাহীন কষ্ট সয়েও যে মানুষটি সারাক্ষণ দেশ ও জাতির কল্যাণে ভাবেন, স্বপ্ন দেখেন, পরিকল্পনা করেন, তাঁকে থামানো যায় না। থামানো যাবে না।
২০০৮ সালে আদালতে দাঁড়িয়ে যখন তিনি দৃপ্তকণ্ঠে বলেন, ‘দেশের উন্নয়নের জন্য আমি যা করেছি, তাতে যদি কেউ অপরাধ খুঁজে পায়, আমি তবু সে কাজ করতেই থাকব,’ তখন যেন সত্য নিজেই কথা বলে।
সেই সত্য আজও অম্লান। লন্ডনে চিকিৎসাধীন থেকেও তিনি প্রতিনিয়ত স্বপ্ন বুনে চলেন একটি আধুনিক, আত্মনির্ভর, সম্মানিত বাংলাদেশের। বলেছেন, তিক্ত অতীত ভুলে সামনের দিকে এগোতে চাই। একদিন ফিরব। বাংলাদেশ নিয়ে আমার স্বপ্নের রূপায়ণ ঘটাব।’ দেশের ১৮ কোটি মানুষ তাঁর সেই প্রত্যাবর্তনের প্রতীক্ষায় বুক বেঁধে আছে। কারণ তাঁর দেশপ্রেম, তাঁর জনপ্রিয়তা, তাঁর আত্মত্যাগ, কখনো হারায় না, মুছে যায় না। বরং তা সময়ের আবর্তনে আরও উজ্জ্বল, আরও বিকশিত হয়ে ফিরে আসে, জাতির অন্তরে প্রজ্জ্বলিত এক দীপ্ত শিখা হয়ে। ভঙ্গুর এই দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে তাই দেশপ্রেমিক ও জনপ্রিয় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব তারেক রহমানের প্রতীক্ষায় দেশের ১৮ কোটি মানুষ।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও আমরা বিএনপি পরিবারের আহ্বায়ক