আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো তারা বাংলাদেশকে তাদের একক অর্জন এবং দেশটিকে কেবল ‘তাদের দেশ’ বলে মনে করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময় বিশ্বের বহু দেশ সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর কোনো না কোনো নেতার নেতৃত্বে স্বাধীন সার্বভৌম দেশ হিসেবে বিশ্ব মানচিত্রে আবির্ভূত হয়েছে; কিন্তু ইতিহাস সম্পর্কে পুরোপুরি অজ্ঞ অথবা ইচ্ছাকৃতভাবে ইতিহাস অস্বীকারকারী আওয়ামী লীগ এবং দলটির সুবিধাভোগী বুদ্ধিজীবীরা জনগণকে বিশ্বাস করাতে চান যে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট নিহত ‘তাদের নেতা’ শেখ মুজিবুর রহমান ছাড়া বাংলাদেশ কোনো দিন স্বাধীন হতে পারত না এবং তাঁর ‘সুযোগ্য কন্যা’ শেখ হাসিনা ছাড়া বাংলাদেশকে তাঁর মরহুম পিতার আরাধনা ও স্বপ্নের ‘সোনার বাংলা’ কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতার মাঝেই সীমাবদ্ধ থাকত। কে আওয়ামী লীগকে বোঝাবার সাধ্য রাখে যে উপমহাদেশের ইতিহাসে ‘১৯৪৭’ সংখ্যার একটি গ্রেগরীয় বছর না আসত, তাহলে বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত অখণ্ড ভারতেরই অংশ থাকত।
১৯৪৭ সালের এক বছর পরই বাংলাদেশের আয়তনের চেয়ে দেড় গুণের বেশি বড় দক্ষিণ ভারতের নিজামশাসিত হায়দরাবাদ, ১৯৫৪ সালে পন্ডিচেরি, ১৯৬১ সালে গোয়া এবং ১৯৭৫ সালে সিকিম কীভাবে ভারতভুক্ত হলো অথবা ৭৮ বছর ধরে কাশ্মিরীরা আজাদির জন্য যুগপৎ রাজনৈতিক আন্দোলন ও সশস্ত্র সংগ্রাম করা সত্ত্বেও কেন স্বাধীনতা লাভ করতে পারছে না, সেসব ইতিহাস আওয়ামী মস্তিষ্কে কোনোভাবেই প্রবেশ করবে না। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে মুক্ত হস্তে ও হৃদয় খুলে সহযোগিতা দানে ভারত যেভাবে উতলা হয়েছিল, একইভাবে যদি তারা কাশ্মীর এবং যুদ্ধরত ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর স্বাধীনতাকামীদের আশ্রয়, প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র দিয়ে সহযোগিতা করত, তাহলে বাংলাদেশের ব্যাপারে ভারতের সদিচ্ছা ও সদুদ্দেশ্য নিয়ে সন্দেহ সৃষ্টির কোনো ঘটনা ঘটত না।
আওয়ামী রাজনীতি থেকে পরিত্রাণের উপায় আওয়ামী লীগ কর্তৃক বাংলাদেশের স্বাধীনতার একক কৃতিত্ব দাবি, তাদের নেতা শেখ মুজিব ও শেখ হাসিনা ছাড়া আর কারও পক্ষে যে বাংলাদেশকে ‘সোনার বাংলা’য় পরিণত করা, গণতন্ত্র ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা অসম্ভব ব্যাপার এবং তারা ভিন্ন আর কেউ দেশপ্রেমিক নয়-সবই মেনে নেওয়া সম্ভব ছিল যদি না শেখ মুজিব ও শেখ হাসিনা ক্ষমতা হাতে পেয়ে দেশে ফ্যাসিবাদ কায়েম করতেন। তাঁরা উভয়ে যা করেছেন তার মধ্যে ছিল জনগণের মৌলিক অধিকার-বাকস্বাধীনতা, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, চলাফেরার স্বাধীনতা, সমাবেশ-বিক্ষোভের স্বাধীনতা, ব্যক্তিগত গোপনীয়তার অধিকার-সবই সম্পূর্ণভাবে হরণ। নির্বাচনব্যবস্থাকে আওয়ামী লীগ কেবল তাদের নিজেদের বিজয় অর্জনের কারসাজির উপায়ে পরিণত করেছিল। এর পরিণতিতে পিতা ও কন্যা উভয়ের ক্ষেত্রে যা ঘটা অবশ্যম্ভাবী ছিল তাই ঘটেছিল এবং বাংলাদেশ স্বাধীনতার ৫৪ বছর পরও যে গণতন্ত্র ও আইনের শাসনের সুফল ভোগ করতে পারেনি, তার পেছনে এ দুই রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বই বহুলাংশে দায়ী।
বাংলাদেশের ইতিহাসের কোনো পর্যায়েই আওয়ামী লীগ তাদের ভুল স্বীকার করেনি। এমনকি মাত্র এক বছর আগে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার প্রতিটি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং সেনাবাহিনীকে মাঠে নামিয়ে ছাত্র-জনতার অভূতপূর্ব আন্দোলন দমন করতে গণহত্যা চালানোর পরও আন্দোলনকারীদের প্রতিহত করতে সক্ষম না হয়ে পলায়নে বাধ্য হলেও শেখ হাসিনা এখন পর্যন্ত বলে যাচ্ছেন, ‘আমার কী দোষ!’ দলীয় বশংবদরা তাঁর সঙ্গে সুর মেলাচ্ছেন, ‘আমরা কী করেছি?’ আওয়ামী লীগ যদি সত্যি সত্যি গণতন্ত্রে বিশ্বাস করত তাহলে তারা তাদের দলদাস বুদ্ধিজীবী ও গবেষকদের নিয়োগ করে তাদের সরকারের ন্যক্কারজনক বিপর্যয়ের কারণ মূল্যায়ন ও বিশ্লেষণ করত। দেশ পরিচালনায় তাদের ব্যর্থতার দায়ভার নিয়ে তারা জাতির কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করতে পারত। দলের বা প্রশাসনের অভ্যন্তরে ঘাপটি মেরে থাকা কোনো মহল যদি ছাত্র-জনতার সরকারবিরোধী আন্দোলন ও আন্দোলনের নেতাদের সমূলে বিনাশ করাসহ আন্দোলনকারীদের ওপর নির্বিচারে গুলি চালিয়ে হত্যা করার জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোকে উসকানি দিয়ে থাকে তাহলে তাদের চিহ্নিত করে বিচারের আওতায় আনতে পারত; কিন্তু শেখ হাসিনা বা তাঁর সরকার এসবের কোনো কিছু করেনি। কারণ তারা মনে করে যে আওয়ামী লীগের যে কোনো স্তরের নেতা-কর্মী কোনো অঘটন ঘটালেও তা অপরাধ নয়। আইনের চোখে যেসব কর্মকাণ্ড সবার জন্য অপরাধ, সেসব অপরাধ থেকে আওয়ামী লীগ তাদের শাসনামলে সব সময় অভিনবভাবে দায়মুক্তির সুবিধা পেয়েছে।
ভারত সরকারের নিরাপদ আশ্রয়ে থেকে শেখ হাসিনা উসকানিমূলক বক্তব্য দিয়ে এখনো তাঁর দলের লোকজনকে নির্দেশনা দিয়ে যাচ্ছেন হিংসাত্মক পথ অবলম্বন করে দেশে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে। যার সর্বশেষ দৃষ্টান্ত চার দিন আগে তাঁর নির্দেশনায় গোপালগঞ্জে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সমাবেশস্থলে হামলা, যা রক্তক্ষয়ী হয়ে উঠেছিল। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ছাড়াও সেনাবাহিনীকে মাঠে নামতে হয়েছিল। সেখানে চারজনের মৃত্যু ঘটে এবং বহু লোক আহত হয়। আহতরা কেউ শেখ হাসিনার স্বজন নন, তাঁর দলের উল্লেখযোগ্য কোনো নেতা-কর্মীও নন। সাধারণ মানুষ। ১৯৭১ সালে ভারতে আশ্রয় নেওয়া এক কোটি লোকসহ মোট সাড়ে সাত কোটি লোকের বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তাঁর পরিবারের কোনো সদস্য নিহত হওয়ার দৃষ্টান্ত নেই। বর্তমানে ১৭ কোটির অধিক অধিবাসীর বাংলাদেশে এমনকি তাঁর সম্প্রসারিত পরিবারের কোনো সদস্য হতাহত হবেন না, এটাই স্বাভাবিক। ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট রাতে ছোট বোনসহ শেখ হাসিনা ছাড়া তাঁর পরিবারের সব সদস্য ও তাঁর বৃহত্তর পরিবারের কিছু সদস্যের দুঃখজনক মৃত্যুর সঙ্গে সরকারবিরোধী কোনো আন্দোলনের সম্পর্ক ছিল না। কারণ তখন দেশ ছিল রাজনীতি ও রাজনৈতিক দলশূন্য, গণতন্ত্রবিহীন। জনগণের ক্ষোভ প্রকাশ ও দাবিদাওয়ার পক্ষে আন্দোলন করা তো দূরের কথা, শেখ মুজিবের একদলীয় বাকশালী শাসনে তখন মানুষের কথা বলার স্বাধীনতাটুকুও ছিল না। যার খেসারত তাঁকে চরমভাবে দিতে হয়েছে।
শেখ হাসিনা তাঁর পিতার ভুল থেকে শিখতে পারতেন। আওয়ামী লীগ নিজেদের পুরোনো ভুল শুধরে নিতে পারত; কিন্তু তারা তাদের নিহত নেতার রক্তের প্রতিশোধ গ্রহণের শপথে বলীয়ান। তারা শেখ মুজিবুর রহমানকে সব মানবিক ভুলভ্রান্তির ঊর্ধ্বে অতিমানব বানিয়ে ফেলেছিল এবং তাঁর কন্যা শেখ হাসিনাকেও পরিণত করেছিল অতিমানবীতে। তারা গোপালগঞ্জের ঘটনাকে গত বছরের ৫ আগস্টের পর তাদের বিজয়ের শুভসূচনা বলে বর্ণনা করছে। তাদের কাছে গোপালগঞ্জ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের লেনিনগ্রাদের মতো, যে নগরীতে আক্রমণ চালিয়ে হিটলারের নাৎসি বাহিনীকে চরম নাকানিচুবানি খেতে হয়েছিল এবং তাঁর পতন ত্বরান্বিত করতে মিত্রবাহিনীকে উৎসাহিত করেছিল।
এ কথা সত্য, গোপালগঞ্জ আওয়ামী লীগের শক্ত ঘাঁটি। শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মস্থান এবং তাঁর কবরও সেখানে। ১৯৭০ সাল থেকে পরবর্তী সময়ে যতগুলো নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে, গোপালগঞ্জে অন্য কোনো দল সুবিধা করতে পারেনি। এটা হতেই পারে এবং তাতে কারও আপত্তিও নেই, ক্ষতিরও কোনো কারণ নেই। বিশ্বের বহু দেশে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে প্রতিটি দলের নির্দিষ্ট কিছু রাজ্য বা এলাকা থাকে, যেখানে প্রতিপক্ষ দল হাজার চেষ্টা করেও ভাঙন ধরাতে পারে না। যুক্তরাষ্ট্রে তা আরও প্রকটভাবে আছে। স্টেটগুলোতে ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকান পার্টির নিয়ন্ত্রণ অনুযায়ী ভাগ করা হয় যথাক্রমে ‘ব্লু স্টেট’ ও ‘রেড স্টেট’ নামে। পার্শ্ববর্তী ভারতেও এমন আছে, কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে নির্বাচনি নিয়ন্ত্রণ ও প্রভাবের বাইরে গোপালগঞ্জকে সারা দেশে সন্ত্রাসী কার্যকলাপ ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য আওয়ামী লীগের ঘাঁটি হিসেবে বিবেচনা করে দলীয় কর্মীদের উসকানি দিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে তাদের লড়াই চালিয়ে যাওয়ার জন্য শেখ হাসিনার নির্দেশনা রাজনৈতিকভাবে অপরিণামদর্শিতা। বাংলাদেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ীও গর্হিত ও দণ্ডনীয় অপরাধ।
বাংলাদেশের কোনো দুর্বলতম সরকারের পক্ষেও কি দেশের ক্ষুদ্র একটি অংশকে দেশ ও জনগণের বিরুদ্ধে সন্ত্রাস ও অরাজক পরিস্থিতি বজায় রাখা অথবা সেখান থেকে দেশের অন্যান্য স্থানে সন্ত্রাস রপ্তানি করার সুযোগ দেওয়া সম্ভব? গত বুধবার শেখ হাসিনার উসকানিতে গোপালগঞ্জের আওয়ামী লীগ এবং অন্তর্বর্তী সরকার কর্তৃক ইতোমধ্যে নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ কর্মীরা জাতীয় নাগরিক পার্টির সমাবেশ ও মিছিলকে কেন্দ্র করে যে তাণ্ডব চালিয়েছে তার পরিণতিতে গোপালগঞ্জ শহর বলতে গেলে পুরুষশূন্য হয়ে পড়েছে। হতাহতের পরিবারগুলোর আহাজারি চলবে দীর্ঘদিন। শেখ হাসিনা গত বছরের গণহত্যাকে ‘আমার কী দোষ?’ বলে উড়িয়ে দিয়েছেন। গোপালগঞ্জের ঘটনায় হতাহতের পেছনে তাঁর উসকানির যে বড় ভূমিকা ছিল, তা তাঁর স্বীকার করার প্রশ্নই আসে না। জুলাই বিপ্লবে নিহতদের বেলায় তিনি দাবি করেছেন, যে গুলিতে ওরা মরেছে, পুলিশ ওই গুলি ব্যবহার করে না। এবারের নিহতদের শরীরে বিদ্ধ গুলি সম্পর্কে এখনো তাঁর বক্তব্য জানা যায়নি। আশা করা যায়, যথাসময়ে তিনি এ সম্পর্কে উপযুক্ত কিছু বলবেন। তবে আওয়ামী দৃষ্টিকোণ থেকে এটা ধরে নেওয়াই উত্তম যে ২০০৯-২০২৪ মেয়াদে শেখ হাসিনার শাসনে বাংলাদেশে অন্যায়-অবিচার কিছুই ঘটেনি।
শেখ হাসিনা ৪৪ বছর যাবৎ এককভাবে আওয়ামী লীগ শাসন করছেন এবং ২০ বছর ৭ মাস বাংলাদেশ শাসন করেছেন। এ দীর্ঘ মেয়াদে তিনি তাঁর দলের সর্বস্তরে একটি চেতনার অনুপ্রবেশ ঘটাতে সফল হয়েছেন যে বাংলাদেশে কোনো নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে সে নির্বাচনে যে কোনো উপায়ে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয় নিশ্চিত করতে হবে, জাতীয় সংসদকে হতে হবে বিরোধী দলশূন্য অথবা নগণ্যসংখ্যক সদস্য সমন্বয়ে অনুগত বিরোধী দলসহ, বারবার সরকার গঠন করবে আওয়ামী লীগ। যত দিন দেশে আওয়ামী লীগের অস্তিত্ব থাকবে, দেশ ও জনগণ আওয়ামী অভিশাপ থেকে মুক্ত হতে পারবে না। আওয়ামী লীগকে কীভাবে অস্তিত্বহীন করা সম্ভব? দলটিকে নিষিদ্ধ করার মধ্য দিয়ে তা সম্ভব নয়। অন্তর্বর্তী সরকারেরও এ ধরনের কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা সংগত হবে বলে মনে করি না। অন্তর্বর্তী সরকার সাময়িক এক ব্যবস্থা। বিদ্যমান কাঠামোতে রাজনৈতিকভাবে আওয়ামী লীগকে হটিয়ে দিতে বিএনপি সম্ভবত কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারত। আওয়ামী লীগের মন্দ কাজগুলোর তথ্যপ্রমাণই আওয়ামী লীগকে রাজনীতি থেকে নির্বাসনে পাঠানোর যথার্থ উপায় হতে পারত যদি বিএনপি সুসংগঠিত কোনো দল হতো। ইতোমধ্যে তারা চাঁদাবাজি ও চাঁদার উৎসগুলোতে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য নিজেদের মধ্যে বেপরোয়া লড়াই করে দিশাহারা হয়ে পড়া জনগণকে চরম হতাশ করেছে। স্বাধীনতার ৫৪ বছরে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষায় দেশবাসীর যথেষ্ট শিক্ষা হয়েছে। তারা আর কড়াই থেকে গনগনে চুলায় পড়তে চায় না।
লেখক : যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী সিনিয়র সাংবাদিক