বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধি মূলত জোগান বৃদ্ধির কারণে হলেও বিনিয়োগ স্থবির থাকায় এ প্রবৃদ্ধি দীর্ঘ মেয়াদে স্থায়ী না-ও হতে পারে। বর্তমান রিজার্ভ বৃদ্ধির পেছনে মূল কারণ বিদেশি মুদ্রার জোগান বৃদ্ধি এবং বিনিয়োগের দুর্বলতা। প্রবাস আয় বেড়েছে, আবার মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি কমেছে। ফলে বাজারে ডলার সরবরাহ বাড়ায় বাংলাদেশ ব্যাংককে কিনে নিতে হচ্ছে, যাতে দামের অস্বাভাবিক পতন না ঘটে।
আপাতত এতে স্বস্তি এলেও এটি মূলত চাহিদার দুর্বলতার প্রতিফলন, অর্থনীতির প্রাণশক্তির নয়। বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নিয়ে যে সংখ্যাগত বিভ্রান্তি চলছে, তা এখনই বন্ধ হওয়া দরকার। বাংলাদেশ ব্যাংক আনুষ্ঠানিকভাবে রিজার্ভকে ৩১ বিলিয়ন ডলার বললেও আন্তর্জাতিক মানদণ্ড বিপিএম-৬ অনুযায়ী প্রকৃত রিজার্ভ ২৬ বিলিয়ন ডলার। সংখ্যার এই ফাঁপা খেলা দীর্ঘমেয়াদে আস্থা ক্ষুণ্ন করে, যা অর্থনীতির জন্য মোটেও শুভ নয়।
আগের সরকারেরও বেশি দেখানোর অভ্যাস ছিল। এত কিছু পরিবর্তন হয়েছে, তাই রিজার্ভ বেশি দেখানো এই অভ্যাসটাও পরিহার করা উচিত। এখন সবচেয়ে বড় ঝুঁকি হলো রাজনৈতিক অস্থিরতা। বিনিয়োগকারীরা সব সময় স্থিতিশীলতা খোঁজেন।
জ্বালানি সমস্যার সমাধান খোঁজা সম্ভব, কিন্তু রাজনৈতিক সহিংসতা ও সড়ক অবরোধ দেখলেই বিনিয়োগকারীরা পিছিয়ে যান। বিদেশি বিনিয়োগকারীদের সাম্প্রতিক মন্তব্য ‘নো ভায়োলেন্স’ এই সতর্কতাই স্মরণ করিয়ে দেয়। তাঁরা বলেন, ‘আমরা দ্রুত মুনাফার খোঁজে থাকা বিনিয়োগকারী। একই সঙ্গে খামখেয়ালিও। যদি আমাদের বাজারে ধরে রাখতে চান, তবে সহিংসতা করবেন না, দয়া করে কোনো সহিংসতা নয়।
আমরা যদি দেখি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাচ্ছে, আমরা জাপানে ফিরে যাব (জাপানি বিনিয়োগকারীদের দিকে ইঙ্গিত করে)। মতবিরোধ (রাজনৈতিক) থাকতেই পারে, তবে সেগুলো আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করুন। বিদেশি প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ বাংলাদেশে ঢুকলে তা প্রবৃদ্ধিকে ‘টার্বোচার্জার’-এর মতো ত্বরান্বিত করতে পারে, কিন্তু একই সঙ্গে এটি ভয়ানকভাবে বিঘ্নকারী নেতিবাচক শক্তি হতে পারে, কারণ অস্থিরতার সামান্য ইঙ্গিত পেলেই আমরা চলে যাব।’
এদিকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের শুল্কনীতি বাংলাদেশের জন্য একটি সুযোগের জানালা খুলে দিয়েছে। ভারত ও চীনের ওপর আরোপিত শুল্কের কারণে তৈরি পোশাকের অর্ডার বাংলাদেশে আসছে। তবে এই সুযোগ কাজে লাগাতে হলে স্থিতিশীল পরিবেশ ও বিনিয়োগবান্ধব নীতি জরুরি। নইলে রপ্তানির সম্ভাবনা হাতছাড়া হবে।
ভারত ও চীনের ওপর ট্রাম্প প্রশাসন যে হারে শুল্ক আরোপ করেছে, তাতে কোনো সংস্কার ছাড়াই ২০২৫-২৬ অর্থবছরে বাংলাদেশের সামনে মার্কিন বাজারে ২০৫ কোটি ডলারের বেশি রপ্তানি করার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। পাচার বা হুন্ডিচক্র ফের সক্রিয় হলে রেমিট্যান্স প্রবাহ আবারও নড়বড়ে হয়ে পড়তে পারে। সামপ্রতিক সময়ে রেমিট্যান্স বৃদ্ধির পেছনে মূল কারণ ছিল হুন্ডি দমন। কিন্তু রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর যদি আবার হুন্ডি সক্রিয় হয়, প্রবাস আয় কমে যাওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। শুধু শ্রমিক পাঠানোই সমাধান নয়; বরং বৈধ চ্যানেলকে প্রণোদনা ও আস্থা দিয়ে আকর্ষণীয় করতে হবে।
সার্বিকভাবে এখনকার রিজার্ভ একটি স্বস্তির অবস্থান, কিন্তু স্থিতিশীল নয়। এটিকে টেকসই করতে হলে জরুরি হলো প্রকৃত রিজার্ভের হিসাব প্রকাশে স্বচ্ছতা বজায় রাখা। একই সঙ্গে বিনিয়োগবান্ধব রাজনৈতিক পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। রেমিট্যান্স প্রবাহকে আনুষ্ঠানিক পথে দীর্ঘমেয়াদি করতে কার্যকর পদক্ষেপও নেওয়া প্রয়োজন। অন্যথায় আজকের ফুলে ওঠা রিজার্ভ আগামী দিনের জন্য কেবল একটি মরীচিকা হয়ে থাকবে।
লেখক : বিশ্বব্যাংক ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ।
বিডি প্রতিদিন/নাজিম