শুক্রবার, ৩ অক্টোবর, ২০১৪ ০০:০০ টা
গল্প

দিগম্বর

সুমন্ত আসলাম

দিগম্বর

অলংকরণ : আহমেদ তারেক

বিছানায় শুয়েই দৃশ্যটা দেখতে পেলেন মাজবুর ফাকির। হঠাৎ। সঙ্গে সঙ্গেই উঠে বসলেন ঝট করে। বড় বড় করে ফেললেন ঘুম জড়ানো চোখ দুটো। ঘরের কোনায় যে লম্বা ড্রেসিং টেবিলটা আছে, তার স্ত্রী দাঁড়িয়ে আছেন সেই আয়নার সামনে। প্রতিদিনের মতো যেমন সময় নিয়ে সাজেন, সাজছেন আজও। কিন্তু আজ তার গায়ে কোনো পোশাক নেই, নেই এক টুকরো সুতোও- এ প্লেইন বিউটি উইথআউট ক্লথ!
ধক করে উঠল মাজবুর ফাকিরের বুকের ভেতরটা। বিছানায় বসেই তিনি কিছুটা শব্দ করে বললেন, ‘রুবিতা, এটা কী করছো তুমি!’
গ্রীবা সামান্য না ঘুরিয়েই রুবিতা বললেন, ‘কেন, কী করছি আমি?’ রুবিতার গলার স্বরে প্রচ্ছন্ন অবহেলা, অবজ্ঞাও, ‘রূপচর্চা জীবনের একটা অংশ, এ কথাটা এর আগেও তোমাকে বলেছি, আজও বলছি। মাইন্ড ইট।’ ‘না না, ওটা আমি অস্বীকার করছি না। কিন্তু তোমার শরীরে কোনো কাপড়-চোপড় নেই কেন!’ কাঁপা কাঁপা গলা মাজবুর ফাকিরের।
শ্লথগতিতে একটু ঘুরে দাঁড়ালেন রুবিতা রহমান। চোখ কুঁচকে ফেললেন, সঙ্গে কপালও। প্রসাধনে ঢাকা পুরো চেহারাটায় ভাঁজ পড়ার আগেই সচেতন হয়ে উঠলেন তিনি। চোখ-কপাল সামলে নিয়ে প্রলম্বিত ভঙ্গিতে বললেন, ‘মা-নে!’
‘এ ঘরে অবশ্য আমি ছাড়া কেউ নেই।’ ঘরের চারপাশটা একবার দেখে নিলেন মাজবুর ফাকির, ‘দরজা-জানালাও বন্ধ। তাই বলে একেবারে ন্যাংটো হয়ে সাজতে শুরু করে দিলে!’
‘কী! অসভ্যর মতো কথা বলছো!’ আয়নায় নিজেকে দেখে নিয়ে কিছুটা চিৎকার করে উঠলেন রুবিতা রহমান, ‘দিনে দিনে তোমার কাণ্ডজ্ঞান লোপ পাচ্ছে নাকি ফাকির। পুরো মাতালের মতো কথা বলছো তুমি!’
মাজবুর ফাকির টান টান করে ফেললেন চোখ দুটো। ঝাপসা কিংবা অস্বচ্ছ কিছু দেখছেন না তিনি। তবুও। চোখ দুটো আরও টান করে ঘরের কোনার দিকে তাকালেন ভালো করে। না, তিনি যা দেখছেন, তা সত্য দেখছেন। কোনো সমস্যা নেই, কোনো ভুল নেই-সম্পূর্ণ সুতোবিহীন তার স্ত্রী, দ্বিধাহীন শরীরে বিলুপ্ত আবরণ!
সাজতে শুরু করেছেন আবার রুবিতা রহমান। মনোযোগ দিয়ে, পুঙ্খানুপুঙ্খানো প্রসাধনের প্রলেপে। পলকহীন মাজবুর ফাকির। তিনি বুঝতে পারছেন না তার স্ত্রী হঠাৎ এমন উন্মুক্ত কেন! স্বামীর কিংকর্তব্যবিমূঢ়তা টের পেলেন তিনি। গ্রীবা সামান্য বাঁকিয়ে পাশ ফিরলেন। তাচ্ছিল্য আর অবজ্ঞার মিশেলে সেই চাহনীতে কিছু বলার আগেই মাজবুর ফাকির বললেন, ‘সম্ভবত আমি ভুল দেখছি না, রুবিতা।’
সম্পূর্ণ ঘুরে দাঁড়ালেন এবার রুবিতা রহমান। উপরের ঠোঁটটা রাঙানো হয়েছে তার, নিচেরটা এখনো বাকি। সেই অবস্থাতেই দুজনের দূরত্বের মাঝখানে এসে কিছুটা থমকে দাঁড়ালেন। তারপর নিজের শরীরটা নিজে একবার পর্যবেক্ষণ করে বললেন, ‘এবার কী মনে হচ্ছে তোমার?’ স্ত্রীকে দিব্যি ন্যাংটোই দেখছেন তিনি, তবুও চোখ দুটো মেলে ধরলেন আরও। দ্বিধা, বিব্রতা, সংকোচ সব একসঙ্গে এসে ঠাঁই নিল অবয়বে। চোখ-মুখে সেসব নিয়েই তিনি বললেন, ‘সত্যি বলছি, তোমার শরীরে কোনো কাপড় নেই, একদম নেই। সম্পূর্ণ খালি গা তুমি!’
নিজের শরীরে লেপ্টে থাকা অ্যানডি কটন শাড়িটার আঁচল হাতে নিলেন রুবিতা রহমান। আরও একটু এগিয়ে এলেন স্বামীর দিকে। আঁচলটা মেলে ধরলেন আরও প্রশস্ত করে, ‘এটা কী?’
কিছু বলেন না মাজবুর ফাকির। চোখ দুটো আগের মতোই আধা বিস্ফোরিত রেখেছেন তিনি। বিছানা থেকে নামলেন সেই অবস্থাতেই। ঘোর লাগা অবয়বে, অবিন্যস্ত পায়ে, এগিয়ে গেলেন সামনের দিকে। উঁচু করে রাখা স্ত্রীর হাতের দিকে হাত বাড়ালেন। ঝুলে থাকা শাড়ির আঁচলটার স্পর্শ পেতেই চমকে উঠলেন বেশ। একটু কুঁজো হয়ে ভালো করে তাকালেন নিচের দিকে। পার্পেল রঙের শাড়িটা এবার স্পষ্ট দেখতে পেলেন তিনি। সেই দেখাটাকে আরও প্রমাণিত করার জন্য কাঁধে হাত রাখলেন রুবিতা রহমানের। না, শরীরটা সুতোবিহীন না, বরং সুতোয় বোনা কয়েক প্রস্ত আবরণ রয়েছে তার গায়ে।
শক খাওয়া মানুষের মতো কিছুটা ছিটকে সোজা হলেন মাজবুর ফকির। স্ত্রীর চোখের দিকে তাকালেন। বিব্রত হলেন তিনি সঙ্গে সঙ্গে। রুবিতা রহমানের চোখে-মুখে আগের মতোই অবজ্ঞা, অবহেলা, তুচ্ছতা। ঠোঁটের কোনায় কেমন যেন এক টুকরো রূঢ়তাও ঝুলে আছে স্পষ্টভাবে।
ড্রেসিং টেবিলের দিকে আবার এগিয়ে গেলেন রুবিতা রহমান। রূপচর্চায় মনোযোগী হলেন আবার। কয়েক সেকেন্ড সেদিকে তাকিয়ে থেকে মাজবুর ফাকির ফিরে এলেন বিছানায়। ঘুমমুক্ত হয়ে গেছে চোখ দুটো অনেক আগেই। তবুও কেমন যেন ঝিঁমুনি এসে ঠাঁই নিয়েছে শরীরে। মাথাটাও গরম হয়ে উঠেছে। দোদুল্যমান মনে হচ্ছে সামনের সব কিছু।
২.
নাশতার টেবিলে আসতে নিয়েই দ্বিতীয়বারের মতো ধাক্কা খেলেন মাজবুর ফাকির। ডান পাশের চেয়ারে তার ছেলে বসে আছে। সদ্য নবম শ্রেণিতে পা দেওয়া ছেলেটা থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট পরে থাকে বাসায়, উপরে গোল গলা টি-শার্ট। আজ ওগুলোর একটাও নেই!  
ডাইনিং রুমের দরজার কাছেই দাঁড়িয়ে পড়লেন মাজবুর ফাকির। অবয়বে ইতস্ততা, আচরণে দ্বিধা। ব্যাপারটা খেয়াল করলেন রুবিতা রহমান। চিরাচরিত কপাল কুঁচকে তিনি বললেন, ‘কী ব্যাপার, ওখানে দাঁড়িয়ে পড়লে যে!’
‘এমনি’। দুর্বল স্বর মাজবুর ফাকিরের।
‘এমনি মানে কী?’ ঝাঁঝালো গলায় বললেন রুবিতা রহমান, ‘ওটা কোনো দাঁড়িয়ে থাকার জায়গা হলো!’
বিব্রত ভঙ্গি কাটাতে এদিক-ওদিক তাকালেন মাজবুর ফাকির। আশপাশে কিছু একটা খোঁজার পর বললেন, ‘পলিন কোথায়?’
‘তোমার মেয়ে সকালে ঘুম থেকে ওঠে নাকি! টেনে তুলতে হয় ওকে। ও আসছে। নাশতা সেরে ভার্সিটি যাবে।’
বুকের ভেতরটা আবার ধক করে উঠল মাজবুর ফাকিরের। মেয়ের দিকে চোখ যাওয়ার আগেই সরে পড়তে হবে তাকে। সম্ভবত মেয়েকেও আবরণহীন দেখবেন তিনি। ব্যাপারটা যেমন লজ্জার হবে, অনুশোচনারও হবে তেমন। বুকের ভেতরটা কুঁকড়ে থাকবে সব সময়। অপরাধবোধে ছেয়ে যাবে সমস্ত আচরণ। বেশভূষাহীন একটা মেয়ে হাঁটাচলা করছে একজন বাবার সামনে, ব্যাপারটা কেমন অশোভনীয় হবে না!
ঘুরে চলে যাচ্ছিলেন মাজবুর ফাকির। আড়চোখে সেটা দেখলেন রুবিতা রহমান, ‘কোথায় যাচ্ছো আবার? এখনই বাইরে যেতে হবে আমাকে। জরুরি একটা মিটিং আছে আজ।’
‘ভালো লাগছে না, খেতেও ইচ্ছে করছে না।’
‘ডাক্তার তোমাকে প্রতিদিন সকালের নাশতা করতে বলেছেন ঠিকমতো। রাতে এটা-ওটা গিলে সকালে দেরি করে ওঠার অভ্যাস তোমার। নাশতা না সেরে একেবারে দুপুরের খাবার খাও তুমি! ডাক্তার বারণ করেছেন এসব।’
একটু থমকে দাঁড়ালেন মাজবুর ফাকির। কী একটা ভেবে বললেন, ‘নাশতাটা বেডরুমে পাঠিয়ে দাও।’ আর কোনো কথা না বলে দ্রুত বেডরুমে চলে এলেন তিনি। দরজা চাপিয়ে বিছানায় বসেই দু-হাত দিয়ে চেপে ধরলেন মাথাটা- এমন হচ্ছে কেন তার? এসব তিনি কী দেখছেন! এভাবে চলতে থাকলে তো চোখ বুঁজে থাকতে হবে তাকে সারাক্ষণ। কিংবা ঘরবাড়ি ছেড়ে কোথাও চলে যেতে হবে চুপচাপ।
দরজায় নক হতেই চমকে উঠলেন মাজবুর ফাকির, ‘কে’?
‘ড্যাড, আমি।’
মেয়ের গলা শুনে কিছুটা লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন মাজবুর ফাকির। দ্রুত দরজার কাছে গিয়ে লক লাগিয়ে বললেন, ‘কী ব্যাপার, মা?’
‘দরজার লক লাগিয়ে দিলে কেন, ড্যাড?’
‘একটা সমস্যা আছে, মা।’
‘কী সমস্যা?’
‘আপাতত বলা যাবে না।’
কিছুক্ষণ থেমে রইল পলিন। তারপর কিছুটা ম্লান গলায় বলল, ‘তুমি নাকি নাশতা করবে না, ড্যাড।’
‘হ্যাঁ’
‘কেন?’
‘শরীরটা ভালো লাগছে না।’
‘ওকে, ড্যাড।’
বিছানায় এসে বসলেন মাজবুর ফাকির। মাথাটা চেপে আসছে চারপাশ থেকে। দপদপ করছে কপালের দু-পাশ। অস্থির হয়ে উঠছে বুকের ভেতরটা। কোনো কিছুই ভালো লাগছে না।
দরজায় শব্দ হলো আবার। আবার চমকে উঠলেন মাজবুর ফাকির। দ্রুত দরজার কাছে গিয়ে বললেন, ‘কে’?
‘আমি’।
‘রুবিতা’? দরজা খুলে দিলেন মাজবুর ফাকির। রুবিতা রহমান রুমে ঢুকেই ভ্রৃ কুঁচকালেন, ‘ভেতর থেকে দরজায় লক করে রেখেছিলে কেন তুমি!’  
হাসার চেষ্টা করলেন মাজবুর ফাকির, ‘এমনি’।
দৃষ্টি সন্দেহ-ছোঁয়া হলো রুবিতা রহমানের। রুমের চারপাশটা একবার দেখে আবার স্বামীর দিকে তাকালেন, ‘কোনো সমস্যা ফিল করছ নাকি তুমি? তোমাদের পার্টিতে তো অনেক ঝামেলা চলছে এখন। পেপার পত্রিকায় এটা-ওটা লিখছে। সেখানে তোমার নামও আছে।’
‘না না, ওসব কিছু না। কোনো সমস্যা নেই আমার।’
‘কিন্তু সকাল থেকে এখন পর্যন্ত যা দেখা যাচ্ছে তাতে তোমাকে সমস্যাগ্রস্তই মনে হচ্ছে আমার কাছে।’
‘না না, সব ঠিক আছে। অল ওকে।’
দরজায় শব্দ হলো আবার। পলিন কিছুটা উদগ্রিব হয়ে বলল, ‘মাম, আসব? ভার্সিটিতে যাব, দেরি হয়ে যাচ্ছে।’
পলিনের গলা শুনে দ্রুত বাথরুমের দিকে পা বাড়ালেন মাজবুর ফাকির। ঝটকা দিয়ে দরজা খুলে ঝটকা দিয়েই বন্ধ করলেন সেটা। তারপর শব্দ করে একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে বললেন, ‘আল্লারে, জীবনে অনেক বিপদে পড়েছি, কিন্তু এটা কোন ধরনের বিপদে ফেললা তুমি আমাকে, মাওলা!’
৩.
বাসা থেকে বের হতে নিতেই থমকে দাঁড়ালেন মাজবুর ফাকির। স্ত্রী, ছেলেমেয়ে বাইরে গেছে। কাজের মেয়ে ছাড়া বাসায় আর কেউ নেই। দরজা বন্ধ করার জন্য ডাইনিং টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে আছে মেয়েটা। সালোয়ার-কামিজ পরে আছে সে, পায়ে এক জোড়া স্যান্ডেলও আছে তার।
মাথা এদিক-ওদিক করলেন ফাকির সাহেব। কোনো কিছু কোনো কিছুতে মিলছে না- স্ত্রী আর ছেলেকে ন্যাংটো দেখেছেন তিনি, কিন্তু কাজের মেয়েটাকে দিব্যি কাপড় পরা অবস্থায় দেখছেন। কেন? ব্যাপারটা কিছুতেই মিলছে না, মেলানো যাচ্ছে না।
তার মাথা ঝাঁকানো দেখে কাজের মেয়েটা একটু এগিয়ে এসে বলল, ‘কাক্কু, আপনার কি মাথা ধরিছে?’
কাক্কু শব্দটা শুনলে ভীষণ রাগ হয় মাজবুর ফাকিরের। কিন্তু এখন হলো না। মাস দুয়েক আগে গ্রাম থেকে আনা হয়েছে এই মেয়েটাকে। মুখে এখনো গ্রামের ভাষাই রয়ে গেছে।
‘না, মাথা ধরেনি আমার।’
‘তাহলে ওমন মাথা ঝাকানছে যে?’
কোনো জবাব দিলেন না মাজবুর ফাকির। মেয়েটার দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে বের হয়ে এলেন বাসা থেকে।
রাস্তায় অসংখ্য মানুষ। সবার শরীরে পোশাক, কোনো মানুষই উন্মুক্ত নেই, এমনকি আধা উন্মুক্তও। দিব্যি সবাই যে যার কাজে ব্যস্ত। কেবল তিনি ব্যস্ত হতে পারছেন না। সকাল থেকে কী যেন আটকে আছে মাথার ভেতর। বের করতে পারছেন না সেটা কোনোভাবেই। ড্রাইভার গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে রাস্তার কোনায়। হাত দিয়ে ইশারা করলেন তিনি তাকে। না, তিনি আজ বাইরে যাবেন না। পার্টি অফিসে জরুরি একটা মিটিং আছে, যেতে ইচ্ছে করছে না আজ সেখানেও।
৪.
সন্ধ্যায় মাজবুর ফাকির হঠাৎ অনুভব করলেন-আশপাশের সব কিছু কেমন যেন পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে তার কাছে। দেয়ালের ওপাশে কী আছে তিনি তা দেখতে পাচ্ছেন। এমনকি পাশের বিল্ডিংয়ের কী ঘটছে, দেখতে পাচ্ছেন সেটাও। একেবারে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছেন সব কিছু।
দু-হাত দিয়ে নিজের দু-চোখ ঢেকে ফেললেন মাজবুর ফকির। দু-পা গুটিয়ে বিছানার উপর বসে রইলেন অনেকক্ষণ। হঠাৎ মনে হলো, দু-হাতের হাড়-মাংস-চামড়া ভেদ করেও দেখতে পাচ্ছেন তিনি। চোখ আরও জোরে ঠেসে ধরলেন দু-হাত দিয়ে। না, অস্বস্তিটা যাচ্ছে না কিছুতেই। উপুর হয়ে, বিছানায় নাক-মুখ ঠেকিয়ে, দু-হাত দিয়ে চোখের দু-পাশ চেপে ধরলেন তিনি এবার। বুঁজে ফেললেন চোখ দুটোও। কোনো কিছু দেখতে চান না; কোনো কিছু চোখের সামনে ভেসে উঠুক, চান না এটাও।
দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলেন রুবিতা রহমান। স্বামীকে এভাবে উপুর হয়ে বসে থাকতে দেখে চমকে উঠলেন তিনি। কিছুটা এগিয়ে এসে বিরক্ত গলায় বললেন, ‘এভাবে উপুর হয়ে বসে থাকার মানে কী?’
নতজানু ভঙ্গিতেই মাজবুর ফাকির বললেন, ‘আমি কোনো কিছু দেখতে চাই না, রুবিতা।’
‘তোমাকে সব কিছু দেখতে কে বলেছে?’   
‘কেউ বলেনি। কিন্তু সব কিছু দেখতে পাচ্ছি আমি।’ মাজবুর ফাকির কথা শেষ করেই মাথাটা উঁচু করলেন একটু। রুবিতা রহমানের দিকে চোখ পরতেই শব্দ করে বললেন, ‘তুমি এখনো ন্যাংটো হয়ে আছো! তোমার গায়ের কাপড়-চোপড় কই?’
চোখ বড় বড় করে ফেললেন রুবিতা রহমান। ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে বসে পড়লেন স্বামীর পাশে। আলতো হাত রাখলেন তার মাথায়। কী যেন চিন্তা করলেন কিছুক্ষণ। তারপর উঠে গিয়ে ফোন করলেন ডাক্তারকে।
৫.
ডাক্তার শাহরিয়ার মামুন মাজবুর ফাকিরের একেবারে সামনে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘চোখ নিচু করে রাখবেন না, প্লিজ। আপনি আমার দিকে তাকান।’
‘না, আমি তাকাতে পারব না। আপনার পাশে আমার স্ত্রী, ছেলেমেয়ে দাঁড়িয়ে আছে, ওদের সরে যেতে বলুন। আমার অসুবিধা হচ্ছে।’
হাত দিয়ে ইশারা করলেন ডাক্তার তাদের। রুমের বাইরে চলে গেল তারা। ‘এবার আমার দিকে তাকান। বাইরে চলে গেছেন সবাই।’ মাজবুর ফাকিরের আরও একটু সামনে এসে বললেন ডাক্তার। ধীরে ধীরে মাথা উঁচু করলেন মাজবুর ফাকির। ডাক্তার শাহরিয়ার মামুন হাসতে হাসতে বললেন, ‘কী, আমাকে কি ন্যাংটো দেখা যাচ্ছে?’
মাজবুর ফাকির মাথা এদিক-ওদিক করলেন।
‘আমাকে ন্যাংটো দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু আপনার স্ত্রী, ছেলেমেয়েকে ন্যাংটো দেখছেন আপনি!’ ডাক্তার শাহরিয়ার মামুন একটু থামলেন, ‘ব্যাপারটা কেমন গোলমেলে মনে হচ্ছে না!’
‘হ্যাঁ, গোলমেলেই মনে হচ্ছে।’
‘আপনি বরং একটা কাজ করুন-আপনার এই রুম থেকে বের হওয়ার দরকার নেই কয়দিন। কিছু ওষুধ লিখে দিচ্ছি, ঘুম একটু একটু বেশি হবে। আশা করি তিন-চার দিনের মধ্যে ঠিক হয়ে যাবে সব কিছু।’
‘ডাক্তার।’ একটু থামলেন মাজবুর ফাকির, ‘ভালো তো লাগছেই না, আমার কেমন যেন ভয়ও করছে।’
 কিছুটা শব্দ করে হেসে উঠলেন ডাক্তার শাহরিয়ার মামুন, ‘আপনাকে দেখে এই এলাকার সবাই ভয় পায়, আর আপনি সেই নিজেই পাচ্ছেন ভয়!’ কাঁধে হাত রাখেন মাজবুর ফাকিরের, ‘বেশি চিন্তা করবেন না, সব ঠিক হয়ে যাবে।’
৬.
রাতে ভালো ঘুম হয়নি মাজবুর ফাকিরের। সকালের দিকে একটু ঘুম আসতেছিল, কিন্তু বিছানায় লাফ দিয়ে উঠে বসেন তিনি হঠাৎ। গায়ের সব কাপড় খুলে ফেলে চিৎকার করে বলতে থাকেন, ‘আমার এতো গরম লাগছে কেন! আমার এতো গরম লাগছে কেন!’ স্বামীর  চিৎকারে ঘুম ভেঙে যায় রুবিতা রহমানের। দ্রুত স্বামীকে চেপে ধরে বলেন, ‘কী হয়েছে তোমার?’
‘আমার এতো গরম লাগছে কেন?’
‘কই গরম লাগছে তোমার। এসির বাতাসে রুম তো ঠাণ্ডা হয়ে গেছে!’
‘আমার তবুও গরম লাগছে রুবিতা। দম বন্ধ হয়ে আসছে এই রুমের ভেতর। আমি বাইরে যাব।’ বিছানা থেকে দ্রুত নেমে পড়েন মাজবুর ফাকির। রুবিতা রহমান বাধা দেওয়ার আগেই দরজা খুলে বের হয়ে পড়েন তিনি বাইরে। বাসার বাইরের গেট খুলে দৌড়াতে থাকেন চার রাস্তার মোড়ের দিকে। পেছনে পেছনে রুবিতা রহমান, ড্রাইভার, দারোয়ান- সবাই।
চার রাস্তার মোড়ের মাঝখানে এসে হঠাৎ থমকে দাঁড়ান মাজবুর ফাকির। ট্রাফিক পুলিশের মতো হাত নাড়তে থাকেন তিনি দ্রুত। আশপাশে মানুষ জড়ো হয়ে গেছে। চারপাশের বিল্ডিংয়ের জানালা খুলে উৎসুক্য হয়ে তাকিয়ে আছে অনেকে। একটু পর অনেকগুলো টিভি চ্যানেলের গাড়ি এসে জড়ো হলো রাস্তার একপাশে। তারা সবাই দেখতে পেলেন- সম্পূর্র্ণ কাপড়হীন হয়ে এই সময়ের জাঁদরেল নেতা মাজবুর ফাকির হাত-পা নাড়ছেন পাগলের মতো। আর মাজবুর ফাকির দেখতে পেলেন মাত্র কয়েকটি মানুষকে, চারপাশে এতো মানুষ তার মাঝে মাত্র এগারজনকে। তাকে সমালোচনা করায়, তার বিরুদ্ধে কথা বলায় যে কয়জনকে তিনি তার লোক দিয়ে ন্যাংটো করে রাস্তায় ঘুরিয়েছিলেন, সেই এগারজনকে।
কয়দিন আগে শেষের জনকে ন্যাংটো করে তিনি বলেছিলেন, আর একজন হলেই একডজন হবে। সবার ন্যাংটো ছবি তোলা আছে। একডজন পুরো হলেই সবার ছবি দিয়ে একটা পোস্টার বানাবেন তিনি। নিচে লেখা থাকেবে- ওরা বারোজন। সেই পোস্টার সারা শহরে টাঙিয়ে দেবেন তিনি ইচ্ছেমতো।
সেই পোস্টারের জন্যই কিনা, চারপাশ থেকে কেউ ক্যামেরায়, কেউ মোবাইলে টপটপ করে ছবি তুলতে লাগলেন দিগম্বর নেতা মাজবুর ফাকিরের।

সর্বশেষ খবর