শুক্রবার, ১৭ জুন, ২০১৬ ০০:০০ টা

করোটির ভিতরে শুনি সময়ের গর্জন

ইকবাল হাসান

করোটির ভিতরে শুনি সময়ের গর্জন

কবিতা কি? কবিতা কি দিতে পারে? কি চাই আমরা একজন কবির কাছে? কি চায় মানুষ? তার ঋদ্ধ উচ্চারণের ভিতর কি প্রত্যাশা সমাজের কাছে? কবিতা কি নিজের আত্মা থেকে উত্থিত এক সীমাহীন স্রোতধারা? এক অনির্বচনীয় আনন্দের খেলা? শৈলী, শিল্প, স্থাপত্য, নৃতত্ত্ব, বিজ্ঞান, মিথ, মৃত্যু, নারী, যৌনতা, ক্রোধ ও প্রেম-বিরহের এক অত্যাশ্চর্য প্রতিভাস?

শুনে হেসে উঠলেন তিনি, টেলিফোনের অপরপ্রান্তে আটলান্টিকের ওপারে সুদূর লন্ডন থেকে ভেসে এলো তার কণ্ঠস্বর। বললেন, গাছকে যদি বোটানি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হয়, তাহলে গাছ কি বলবে? আমার ধারণা, ধারণাই বা বলছি কেন, কবিতা একটি সংকেতপ্রধান মাধ্যম। উপমা, উেপ্রক্ষা, প্রতীক আর চিত্রকল্পের মাধ্যমে এই সংকেতগুলোই আমি তৈরি করে চলেছি, তৈরি করে চলেছি সিরিজ অব সিগনালস। আমি যখন তাকে শোনাই, ...চারদিকে রোদের তেজ দেখে মনে হয়, কোথাও উৎসব হবে

ভোজন উৎসব,

রঙ, সুঘ্রাণ, শিমুলের লাল, হাজার হাজার লোক,

আমাদের রক্তের ভেতরে অনুভূত হয়

পাড়াগাঁর সেইসব উৎসবের নিমন্ত্রণ

যার কথা পিতামহদের মুখে শুনেছি— চোখ ভিজে আসে, কিন্তু আমরা বুঝি না কেন চোখ ভিজে যায়...

শুনে তিনি বলেন, শুধু কবিতা কেন, যে কোনো শিল্পমাধ্যমই হচ্ছে সিরিজ অব সিগনালস। এজন্য কমিউনিকেশন বুঝতে হবে। আমার মনে, আমার উপলব্ধিতে ব্যাপারটা আসছে, আমি লিখছি। যিনি পড়ছেন, তিনি নিজের মতো করে অনুবাদ করে নিচ্ছেন। একজন লেখক ও কবি হিসেবে আমার কাজ হচ্ছে, পাঠকের কাছে, মানুষের কাছে এফিশিয়েন্ট সিগনাল পাঠনো। কবি-লেখকের জন্য এটাই অপরিহার্য।

সৈয়দ শামসুল হক বাংলা সাহিত্যের এক অনন্যসাধারণ অতুজ্জ্বল প্রতিনিধি যার শোনিতে একই সঙ্গে নিরন্তর বহে চলে ক্ষরণ ও নির্মাণ। প্রেম-অপ্রেম, গণতন্ত্র-স্বৈরাচার, দেশপ্রেম ও দুঃশাসন কখনো ভগ্ন, কখনো পূর্ণচিত্রে আমরা এই সত্য আবিষ্কার করি। আবিষ্কার করি এবং বিস্মিত হই এই ক্ষমতাবান লেখকের কলমের ধার দেখে। বিস্মিত হই যখন দেখি, তার হাতের কলম ঝলসে উঠছে দামেস্ক কিংবা বাগদাদের ভারী তরবারির মতো। তবে আমরা আদৌ বিস্মিত হই না যখন দেখি, এই অসাধারণ ধীমান লেখক তার আত্মার গহিন প্রদেশ থেকে উত্থিত জ্যোত্স্নার স্রোতধারায় দূর করতে প্রয়াসী হন আমাদের করোটির অন্ধকার।

জ্যোত্স্না আর অন্ধকারের কথা যখন তুল্লে, ওই লাইনটির কথা মনে আছে? অই যে, ‘...সন্ধ্যার অন্ধকারে আরও এক অন্ধকার দিয়ে নির্মিত মনে হয় তার দেহ...’, সৈয়দ হক বললেন, ‘...আয়, আবার আমরা বন্দুক হাতে নেই তবে’।

নাটকে, গল্পে, উপন্যাসে, কবিতায়, বক্তৃতায়, আলোচনায়-আড্ডায়, কথোপকথনে তিনি বারবার আমাদের স্মরণ করিয়ে দেন ভুলে যাওয়া সেই ঐতিহাসিক মুক্তিযুদ্ধের কথা। আমাদের বোধ থেকে, আমাদের চেতনা থেকে, আমাদের বিবেক ও উপলব্ধি থেকে প্রায় মুছে যাওয়া সেই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের ভয়াবহ দৃশ্যাবলী পুনঃপুনঃ উপস্থাপন করে তিনি আমাদের স্মরণে নিয়ে আসেন অতীত ও ইতিহাস। স্মৃতি ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে আমাদের হূদয়। চোখ জলে ভিজে যায়, চোখ ভেসে যায় জলে। দগ্ধ হই আমরা, একজন মুক্তিযোদ্ধার কবরের পাশ দিয়ে যেতে যেতে।

                                              

দুই.

আমরা তখন ক্ষমাহীন অপরাধের দায়ভার থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য চিৎকার করে উঠি; রক্তাক্ত করে তুলি আমাদের আত্মাকে। তার লেখা আমাদের দিশাহারা করে তোলে ইতিহাস ভুলে যাওয়ার বেদনায়। ‘...স্মরণ হবে যে, উনিশশো একাত্তর সালে বাংলাদেশ স্বাধীনতার জন্যে যুদ্ধ করেছিল। এবং স্মরণ হবে যে, সেই একদা ত্রিরিশ লক্ষ মানুষ বুলেট-বেয়নেটে প্রাণ দিয়েছিল, ধর্ষিতা হয়েছিল দশ লক্ষ নারী, এক কোটি মানুষ দেশত্যাগ করেছিল এবং আরও এক কোটি মানুষ দেশের ভিতরেই ক্রমাগত ঠিকানা পরিবর্তন করে চলছিল। হয়তো স্মরণ হবে, আমাদের ভিতরে সেদিন এমন একটি চেতনা এসেছিল, ইতিহাসের করতল ছিল যার উৎস।

কোথায় সেই করতল? কোথায় সেই চেতনা? কোথায় সেই ক্রন্দন? কোথায় সেই ক্রোধ? কোথায় এখন আমরা? এবং কোথায় এখন এই দেশ?’

সৈয়দ শামসুল হকের স্পষ্ট-স্বচ্ছ একটি রাজনৈতিক চরিত্র আছে। সৎ, সাহসী ও আন্তরিক। মাঝে মাঝে রাজনৈতিক মঞ্চে আমরা তাকে ঝলসে উঠতে দেখি। তিনি একজন আদর্শ দেশপ্রেমিক যিনি বাঙালি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাস করেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে ভালোবাসেন। বিশ্বাস করেন যে, আমাদের সামনে এক বিপন্ন ভবিষ্যৎ, আমাদের যাত্রা এক ভয়ঙ্কর অন্ধকারের দিকে।

আর এ জন্যই কি সমাজসচেতনতা এতটা অপরিহার্য হয়ে ওঠে তার লেখায়? এই অপরিহার্য হয়ে ওঠার ব্যাপারটা এতটা ব্যাপ্ত হলে তা লেখার শিল্প-ঘনত্বকে তরল করে দেয় নাকি?

এর একটি উত্তর, একটি ব্যাখ্যা আমার আছে; সৈয়দ শামসুল হক বললেন, আমরা বাস করি একটা সময়ের মধ্যে। সমাজের ভিতরে ও বাইরে বাস করি। সময়ের ফ্রেমের ভিতর বাস করি বলেই সোশ্যাল রেস্পন্সের প্রতিক্রিয়া-বিক্রিয়া লক্ষণীয় হবে, স্বাভাবিক। কবির করোটির ভিতর সময়ের গর্জন তো থাকবেই। মানুষ শুনতে পারে সময়ের নিঃশ্বাস। ১৯৫২ থেকে আজতক আমার প্রায় প্রতিটি লেখায় সমাজসচেতনতার ছাপ রয়েছে। ...এই তো বিগত শতাব্দীতে ফ্রয়েড এবং মার্কস সাহিত্যের বাইরের মানুষ হয়েও এক বিশাল প্রভাব বিস্তার করেছিলেন। এই প্রভাব ছিল সময়ের প্রতি তাদের সোশ্যাল রেস্পন্সেরই প্রতিচ্ছবি। তবে তাদের বিশ্বাস, মতবাদকে আমি কখনোই আমার রচনার ধারা হিসেবে বেড়ে ওঠতে দেইনি।

হ্যাঁ, বিশেষ মতবাদ বা একটা নির্দিষ্ট দার্শনিক প্রত্যয়ে আচ্ছন্ন হওয়া যে কত অসহায় করে তুলতে পারে একজন কবিকে— সুভাষ মুখোপাধ্যায় তার জ্বলন্ত প্রমাণ নয় কি? তাকে আমার কখনোই ভালো লাগেনি। আমি তাকে শ্রদ্ধা করি। কারণ, তিনিই আমাকে এই জ্ঞানটি দিয়েছিলেন যে, ও রকম লিখতে নেই। তাই তিনি নমস্য।

...যা বলছিলাম, কবিতা কি দিতে পারে? আপাতদৃষ্টিতে কিছুই না। কবিতা কি সমাজ পাল্টে দিতে পারে? এর উত্তর, না। কবিতা কি স্তব্ধ করে দিতে পারে একটি অন্যায় আগ্রাসন? পারে না। তবে পারে, যেটুকু পারে তা হলো— শব্দ ও সুরের অনুরণন। এটুকুই বা কম কি!

কবিতার আবেদন কেন তাহলে কমে যাচ্ছে দিন দিন? পাঠক কেন ঝুঁকে পড়ছে ক্রমশ হালকা ও চটুল কথাসাহিত্যের দিকে?

সৈয়দ শামসুল হক উত্তর দিলেন এভাবে, ... একথা তো সত্যি, কবিতা দিয়ে কিছু করা যায় না। কিন্তু তাই বলে কবিতা অসহায় উচ্চারণ নয়। পৃথিবীর সব সমস্যার সমাধান যদি কবিতার হাতে ছেড়ে দেওয়া হয় তাহলে তো কবিতার অসহায়ত্বই প্রকাশ পাবে।

 

তিন.                            

কবিতা তো ত্রিকাল— অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নিয়ে কথা বলে। শুধু একটি কালকে আমাদের বিবেচনায় রাখলে চলবে না। ...দ্যাখো, আজ যদি সব পত্রিকার সম্পাদক মিলে সিদ্ধান্ত নেন যে, আগামী এক বছর তারা তাদের পত্রিকায় কবিতা ছাপবেন না— দেখবে, কিছুই হবে না। কারও কিছু এসে-যাবে না। আর চাওয়া ও প্রাপ্তির কথা বলছ? কবিতার কাছে চাইবার কিছু নেই। তবে কবিতা যদি নিজেই এগিয়ে এসে কিছু দেয় তো ভালো। কবিতার কাজ হচ্ছে, তোমার অভিজ্ঞতাকে একটা শেপ দেওয়ার, দেখার চোখটাকে একটু ঘুরিয়ে দেওয়ার। আর হ্যাঁ, কবিতা অনেক সময় এগিয়ে আসে। যেমন, জীবনানন্দ ও নজরুলের কবিতা। আমাদের কণ্ঠ যখন উচ্চারণ করে, বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি, তাই আমি পৃথিবীর রূপ খুঁজিতে যাই না আর— পরম বিস্ময়ে দেখি, একটি মানচিত্র এসে সামনে দাঁড়াতে।

সমাজসচেতনতার পাশাপাশি তার কবিতার সাঙ্গীতিক বিন্যাস আর এক বিস্ময়। ‘বৈশাখে রচিত পঙক্তিমালা’ কিংবা কাব্য-উপন্যাস ‘অন্তর্গত’র সংগীতময়তা মনোমুগ্ধকর। যেন এক সংগীতের সুর বেজে চলেছে নিরন্তর। ‘বৈশাখে রচিত পংক্তিমালা’ একই সঙ্গে আত্মজৈবনিক, সংগীতধর্মী। ‘...উপমা ভোলায় ঘুম, চিত্রকল্প নেশা/তবু যেন জলমগ্ন মাছের উপমা দিয়ে ফিরে আসে বারবার/...স্বপ্ন ও বিভ্রম ছুঁয়ে মেপেছি মুহূর্তগুলো/...বাংলার তারিখে আমার জন্মের দিন হোক লাল ছুটি’।

সৈয়দ হক বললেন, এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা বললে। কবিতা পাঠের পর তার অনুরণনটা থেকে যায়। এই অনুরণন, শব্দ ও সুরের ঝংকার কবিতার জন্য খুব জরুরি। তবে তোমাকে একটা কথা বলছি, এখনকার কবিতা নিয়ে আমি শঙ্কিত। এটা ডেড ওয়ার্ল্ড। মরা সংসার। কবিতা কিচ্ছু হচ্ছে না। যাচ্ছেতাই। ...আমি অনেক দেবতার পতন দেখেছি, এখন দেখছি আমার সামনে। বুঝলে ইকবাল, বাহান্ন বছরের লেখালেখির জীবন আমার। এখন আমার কাছে লেখালেখি একটা পৈতৃকভূমির মতো। ফলে দুঃখ পাই, যখন কবিতার দুর্গতি দেখি। বেদনায় ভরে ওঠে মন। কেউ যাচ্ছে না ভিন্নপথে। সব কথা যেন ফুরিয়ে গেছে। যেন বলার মতো অবশিষ্ট কিছু নেই আর।

সৈয়দ শামসুল হক সেই বিস্ময়কর লেখকদের একজন, ভাষা যার হাতে স্বাধীনতা পায়। ঝিলিক দিয়ে ওঠে মুক্তির আনন্দে। লেখার মধ্য দিয়ে তিনি নিরন্তর নির্মাণ করে চলেছেন ভাষা। আসাধারণ তার নির্মাণনৈপুণ্য। নিরলস এই শ্রমসাধ্য কাজটি বাংলা সাহিত্যে খুব কম লোকের দ্বারা সম্পন্ন হয়েছে। সর্বত্র ছড়ানো তার ক্ষমতার দাপট, গল্প-উপন্যাস, কবিতা-নাটক, প্রবন্ধ-কলাম, অই যে বললাম, বাগদাদের রৌদ্রালোকিত আকাশের নিচে ঝলসে ওঠা ভারী তরবারির মতো—... কখনো স্বপ্ন, কখনো স্বপ্নভঙ্গ, কখনো প্রেম আর কখনো যৌনতার এক অতুজ্জ্বল প্রতিভাস। তিনি নিজেকে কখনো দূরত্বে স্থাপন করেন, কখনো স্থিত রাখেন নিরপেক্ষতায়। আবার কখনো দেখি, যেন তিনি অতিমাত্রায় আত্মজৈবনিক, লেখা যেন হয়ে ওঠে আত্মপ্রতিকৃতির জীবন্ত ভাস্কর্য।

বললেন, এই যে একটু আগে তুমি ভাষার কথা তুললে, ভাষা নির্মাণের কথা বললে— এ নিয়ে কথা বলার মতো দীর্ঘ সময় আছে। দেখো, শক্ত কাজ। অর্থাৎ শক্তকে সাজিয়ে, বাক্যে সুবিন্যস্ত, গ্রন্থিত করে সংকেত পাঠানোর জন্য ভাষা জরুরি। আমার ক্ষেত্রে লিখতে লিখতে হয়েছে— এমন বলা যায় না। দ্যাখারও একটা ব্যাপার আছে। অর্থাৎ কীভাবে দেখছো তুমি, এই দ্যাখার উপরও অনেক কিছু নির্ভর করে। এটা লেখার ব্যক্তিত্ব। রবীন্দ্রনাথের মেজাজ দ্যাখো। ...আমাদের সাহিত্যে ভাষা পড়ে যাচ্ছে। সাহিত্য সমাজকে রিফ্লেক্ট করে।

চার.

জীবনে, সংসারজীবনে, বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ডে বাংলা ভাষার পতন পীড়াদায়ক। খুব কষ্ট পাই যখন দেখি ভুল বাংলার, ভুল ভাষার চর্চায় দেশ ছেয়ে যাচ্ছে। ভাষাবোধ আমরা হারিয়ে ফেলেছি দিন দিন।

উপন্যাসে তিনি যে কাজটি করে চলেছেন নিরন্তর, তাকে মূলত একটি মানচিত্র রচনার প্রয়াস বলা যায়। আমাদের মানস মানচিত্র। যে মানচিত্রে চড়াই উতরাই, সজল বনভূমি, পোড়ামাটি আছে; পথ কোথাও প্রবাহিত, কোথাও স্তম্ভিত— যেন এরই ভিতরে গতি, এরই ভিতরে থেমে না থাকা মানুষ।

লেখালেখির ব্যাপারটা তার কাছে অনেকটা এরকম, ...একটি লেখা লিখে উঠার পর আমার ভিতর থেকে একটি ক্ষরণধারা সমাপ্ত হয়ে যায়। আমি যেন চিকিিসত হয়ে উঠি। যেন বা একটি বেদনার অবসান ঘটে। আর নিরাময় শেষে আমি হয়ে উঠি সুস্থ এক নতুন মানুষ। এভাবেই আমার লেখা, এভাবেই আমি লিখি।

আর উপন্যাস কাকে বলা যাবে? সেই ব্যাখ্যা সৈয়দ হক স্পষ্ট করে তোলেন এভাবে, ...আমার কাছে ছোটগল্প সেটিই যার অন্তর্গত বোধ এবং ঘটনাপ্রবাহ, ঘটনা এবং চরিত্র আলোড়ন এমনই যে, তার স্থায়িত্ব জীবনব্যাপী নয়; অন্যদিকে উপন্যাসের পৃষ্ঠায় যে ঘটনাগুলো ঘটে যায়, যে বোধ ও অভিজ্ঞতাগুলো উপস্থিত হয় তার প্রভাব সেই উপন্যাসের প্রধান চরিত্রসমূহের এবং উপন্যাস পাঠকের মানসিক কাঠামোকে মৌলিকভাবে বদলে দেয়, ফলত আমাদের চোখও বদলে যায় জগৎ, সময় ও মানুষকে দেখার। একটি গল্প পাঠের পর এটি যখন ঘটে, তাকেই আমি উপন্যাস বলা সাব্যস্ত করি।

তার উপন্যাস-গল্প-কবিতা, বিশেষ করে তার কাব্যচিন্তায় বসত করেন বোদলেয়ার। এই সত্যের পুনরাবৃত্তি আমরা দেখি তার ‘বৈশাখে রচিত পঙিক্তমালা’ ও ‘খেলারাম খেলে যা’য়। তিনি অনেকটাই যেন বোদলেয়ারে সমর্পিত। কিছু উপন্যাসে দেখি, তিনি খাজনা দিচ্ছেন কাম্যু ও কাফ্কাকে। কেন এই উজ্জ্বল অপ্রতিরুদ্ধ পক্ষপাত?

আমি যেন আটলান্টিকের এপাড় থেকে স্পষ্ট দেখতে পেলাম, মেঘের ফাটল থেকে আকাশে ঝিলিক দিয়ে ওঠা এক টুকরো হাসি তার ঠোঁটে, অতি সূক্ষ্ম এবং ক্ষণস্থায়ী; বললেন, একটা কথা বলি তোমাকে, বিস্তর লিখেছি আমি। ফলে একটি দুটি জায়গা দেখে বলা ঠিক হবে না যে, আমি কাফ্কা-কাম্যু-বোদলেয়ারে অবলম্বিত হয়ে আছি। সমর্পিত হয়ে আছি।

...অই যে সংকেতের কথা বললাম কিছু আগে, ...নানা আলো আমার উপর পড়েছে বলেই আমাকে দেখতে পাওয়া যায়। তবে আমি যে স্বতন্ত্র, আমি যে একান্ত নিজস্ব— আমি আমার লেখায় তা স্পষ্ট করে তুলতে পেরেছি বলেই আমার বিশ্বাস। আর অই যে আলো দেখার কথা বললাম তোমাকে— কবি ও লেখক জীবনে শুধু আলো নয়, মানুষও তো ছায়া ফেলে যাচ্ছে প্রতিদিন।

আর হ্যাঁ ইকবাল, শেষে তোমার শুরুর প্রশ্নটিতে ফিরে আসি। যদি ‘কবিতা কি’, এই প্রশ্ন আমাকে কর, তাহলে এককথায় বলব, আমার কাছে কবিতা এক অন্তর্গত নাটক। যার চরিত্র আছে— এমন এক অন্তর্গত নাটকের নাম কবিতা।

 

বিশেষ দ্রষ্টব্য : আমাদের সাহিত্যের সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক এখন লন্ডনের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন। টেলিফোনে তিনি জানিয়েছেন, মরণব্যাধিকে পরাস্ত করে যথাসম্ভব শিগগিরই তিনি আমাদের মধ্যে ফিরে আসবেন। আমরা অপেক্ষায় থাকলাম, ‘সময়ের সাহসী সন্তান’ ও ‘সভ্যতার অতন্দ্র প্রহরী’র ফিরে আসার।

সর্বশেষ খবর