শুক্রবার, ২৪ জুন, ২০১৬ ০০:০০ টা

সুখরঞ্জন রায় : রবীন্দ্রনাথের কথাসাহিত্যের প্রথম সমালোচক

যতীন সরকার

সুখরঞ্জন রায় : রবীন্দ্রনাথের কথাসাহিত্যের প্রথম সমালোচক

ডক্টর সুকুমার সেন তাঁর ‘বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস’ গ্রন্থের চতুর্থ খণ্ডের তৃতীয় সংস্করণে লিখেছিলেন—

‘আধুনিক বাঙ্গালা সাহিত্যের অগ্রণী সমালোচকদের মধ্যে সুখরঞ্জন রায় ছিলেন বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক ছিলেন তিনি। তাঁহার কবিপ্রকৃতি ও অধ্যাপকসুলভ অনুসন্ধিৎসা এ কাজে তাঁহার প্রতিভাকে  উদ্দীপ্ত করিয়াছিল। রবীন্দ্রনাথের উপন্যাস ও ছোটগল্পের আলোচনায় তিনিই সর্বপ্রথম প্রবৃত্ত হইয়াছিলেন। সে আলোচনা ধারাবাহিকভাবে ‘প্রতিভা’ পত্রিকায় (ঢাকা, ১৩১৮ সাল হইতে) প্রকাশিত। ‘মানসী ও মর্মবাণী,’ ‘প্রবাসী’, ভারতী,’ ‘বিচিত্রা’ প্রভৃতি পত্রিকায়ও প্রবন্ধ বাহির হইয়াছিল। রবীন্দ্রনাথের অন্যান্য রচনার এবং তাঁহার সামগ্রিক প্রতিভা বিশ্লেষণেও তিনি তত্পর ছিলেন। এই সমস্ত মূল্যবান প্রবন্ধগুলি পুস্তকাকারে প্রকাশের অপেক্ষায় আছে।... সেগুলির অপ্রকাশে থাকা বাঙ্গালা সাহিত্যের অগৌরবের কথা।’

সেই অগৌরব দূর করার দায়িত্বই নিজ হাতে তুলে নিয়ে সুখরঞ্জন পুত্র মিহিররঞ্জন রায় পিতার লেখা প্রবন্ধগুলোর যে সংকলন প্রকাশ করেছিলেন সেটিরই নাম— ‘রবীন্দ্রনাথ কাব্যের শিল্পসূত্র’ (ফাল্গুন ১৩৮৩)। নামটি সুখরঞ্জনের নিজের দেওয়া নয়। মিহিররঞ্জন জানিয়েছেন, ‘সংকলিত প্রবন্ধগুলি লেখার সময় এগুলি একত্রিত করে গ্রন্থাকারে প্রকাশ করার সুনির্দিষ্ট কোনো পরিকল্পনা লেখকের ছিল না বলেই মনে হয়। প্রতিটি প্রবন্ধই তাই স্বয়ংসম্পূর্ণ করেই লেখা হয়েছে।’

তবু, বলতেই হবে, গ্রন্থটির নামকরণ হয়েছে অত্যন্ত সার্থক। ৩৮৮ পৃষ্ঠার সংকলন গ্রন্থটির তিনটি অংশ-‘কথা সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথ’, ‘কাব্যে ও নাট্যকাব্যে রবীন্দ্রনাথ’ এবং ‘পরিশিষ্ট’। এর মধ্যে ‘কথাসাহিত্যে রবীন্দ্রনাথই রয়েছে গ্রন্থের দুই তৃতীয়াংশ স্থান জুড়ে।

আমরা জানি : রবীন্দ্রনাথ বায়ান্ন বছর বয়সে, উনিশ শো তেরো সালে, নোবেল পুরস্কার পান। এই আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিলাভের আগে কবির ভাগ্যে তাঁর স্বদেশবাসীর নান্দীর বদলে নিন্দাই জুটেছে বেশি করে। বিদগ্ধ সাহিত্যরসজ্ঞদের মধ্যেও প্রায় কেউই তার প্রতিভার স্বীকৃতি জানাননি।

কেবল মোহিত চন্দ্র সেন আর অজিত কুমার চক্রবর্তী— এই দুজন সমালোচক রবীন্দ্রনাথের কাব্য সাহিত্য নিয়ে উল্লেখযোগ্য আলোচনার সূত্রপাত ঘটান। মোহিত চন্দ্র ‘কাব্যগ্রন্থ’ নাম দিয়ে রবীন্দ্রনাথের কবিতাসমূহের একটি সংকলন প্রকাশ করেন। সেই সংকলন গ্রন্থটিতে তিনি যে ভূমিকা সংযোজন করেছিলেন সেটিকেই রবীন্দ্র কাব্যের যথার্থ আলোচনা বলে ধরা যেতে পারে। এরপর অজিত কুমার লেখেন ‘রবীন্দ্রনাথ’ নামে একটি সুদীর্ঘ প্রবন্ধ। সে প্রবন্ধেও রবীন্দ্রনাথের কবিতারই শুধু আলোচনা করা হয়, তখনো পর্যন্ত কেউই তাঁর ছোটগল্প বা উপন্যাসের মূল্যায়নে মনোযোগী হননি। অথচ, সে সময়েই, বয়স পঞ্চাশ হওয়ার আগেই, রবীন্দ্রনাথ ‘বৌ ঠাকুরানীর হাট; ‘রাজর্ষি,’ ‘চোখের বালি,’ নৌকাডুবি’ ও ‘গোরা’র মতো উপন্যাস রচনা করে ফেলেছেন। ‘বৌ রাকুরানীর হাট’-এ বঙ্কিমের প্রভাব চিহ্নিত করা গেলেও অন্যগুলো সম্পূর্ণ মৌলিক ও ভিন্নধর্মী, বাংলা উপন্যাসে নতুন ধারার সূচনাকারী। আর বাংলা ছোটগল্পের প্রবর্তক ও প্রাণ-প্রতিষ্ঠাতা তো রবীন্দ্রনাথই। আঠারো শো ছিয়ানব্বই সালের মধ্যেই তিনি ৩৭/৩৮টি ছোটগল্প প্রকাশ করে ফেললেন। তবু, উনিশ শো দশ সাল নাগাদও রবীন্দ্রনাথের গল্প উপন্যাসের দিকে কোনো সমালোচকের দৃষ্টি পড়ল না। উনিশ শো এগারো সালে (কবির বয়স পঞ্চাশ পূর্ণ হয়েছে যে বছরে) এমন একজন তরুণ সমালোচকের আবির্ভাব ঘটল যিনি রবীন্দ্রনাথের গল্প উপন্যাসের সমালোচনার সূত্রপাত্রই ঘটালেন না শুধু, বাংলা সাহিত্যে তাঁর যথার্থ স্থানটিও চিহ্নিত করলেন। এই সমালোচকেরই নাম সুখরঞ্জন রায়।

রবীন্দ্রনাথের কাব্য সাহিত্যের যাঁরা প্রথম সমালোচক, সেই মোহিত চন্দ্র সেন ও অজিত কুমার চক্রবর্তী ছিলেন রবীন্দ্র পরিমণ্ডলেরই মানুষ। একান্তভাবে রবীন্দ্র পরিমণ্ডলের অন্তর্ভুক্ত থাকার ফলেই তাদের সমালোচনায় রবীন্দ্র সৃষ্টির প্রতি মুগ্ধতার প্রকাশ যত ঘটেছে, বিচারশীলতার পরিচয় তত ফুটে ওঠেনি। অন্যদিকে রবীন্দ্র কথাসাহিত্যের প্রথম সমালোচক সুখরঞ্জনের অবস্থান রবীন্দ্র-পরিমণ্ডলের  বাইরে ছিল বলেই অতি মুগ্ধতায়  তাঁর সমালোচনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। সুখরঞ্জনের সমালোচনায় সহৃদয় রসজ্ঞতাও ছিল, বস্তুনিষ্ট বিচারশীলতাও ছিল।

তা ছাড়া সমালোচক সুখরঞ্জনের অবস্থান সম্পর্কে আরেকটি তথ্যও বিবেচনায় রাখা প্রয়োজন। তিনি শুধু রবীন্দ্র পরিমণ্ডলের বাইরের মানুষই ছিলেন না, সেকালের বাংলার সাহিত্য সংস্কৃতির কেন্দ্রস্থল কলকাতা থেকেও দূর মফস্বলে ছিল তার অবস্থান। ঢাকা শহরে অধ্যাপনা করার সময়েই তিনি সাহিত্য সমালোচনার কাজে ব্রতী হন। বিশ শতকের সেই সূচনালগ্নেও ঢাকা তো মফস্বলই। কলকাতার এলিটরাও তখন ঢাকাকে দেখতেন উন্নাসিকের চোখ দিয়ে। শুধু ঢাকা নয়, সমগ্র পূর্ববঙ্গবাসী ‘বাঙাল’দের  প্রতিই ছিল তাদের অবজ্ঞার দৃষ্টি। বাঙালদের ভাষাভঙ্গি, জীবনাচরণ, মানস সংস্কৃতি -সবকিছু নিয়েই তাঁরা ঠাট্টামস্করা করতেন। অন্যদিকে, ঢাকাইয়া তথা বাঙালদেরও গোঁ একেবারে কম ছিল না। তাঁরাও উনিশ শতক থেকেই কলকাতার বিপরীতে ঢাকাকে পূর্ববঙ্গীয় মননচর্চার একটি কেন্দ্র রূপে গড়ে তুলতে থাকেন। এখানে সাধারণভাবে বৃহত্তর ও উদার বাঙালিত্বের সাধনা করা হয়েছে অবশ্যই, তবে সে সাধনায় ‘বাঙাল’এর স্বাতন্ত্র্য চেতনারও স্পষ্ট প্রকাশ থাকত। উনিশ শতকেই ঢাকা থেকে প্রকাশিত ‘ঢাকা প্রকাশ’ কিংবা ‘বান্ধব’ পত্রিকা বাঙালি সংস্কৃতিকে বাঙালের অবদান দিয়ে সমৃদ্ধ করেছে। বিশ শতকের গোড়ায় সে সমৃদ্ধিকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে ঢাকার মাসিক পত্রিকা ‘প্রতিভা।’ সেই ‘প্রতিভা’র পাতাতেই সর্বপ্রথম রবীন্দ্রনাথের উপন্যাস ও ছোটগল্পের গভীর ও বিস্তৃত সমালোচনা লেখেন ‘বাঙাল’ সমালোচক সুখরঞ্জন রায়। সেই বাঙালদের দেশ পূর্ববঙ্গ যখন স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ রূপে বিশ্বের মানচিত্রে সগৌরবে স্থান করে নিয়েছে তখন এই তথ্যটি স্মরণ করে আমরা অবশ্যই বিশেষ গৌরব বোধ করতে পারি। অথচ, খুবই দুঃখ ও লজ্জার বিষয় : অনেক বিলম্বে হলেও বাংলা ১৩৮৩ সালের ফাল্গুনে (অর্থাৎ ১৯৭৭-এর ফেব্রুয়ারিতে) যখন কলকাতার ‘মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স’ থেকে সুখরঞ্জন রায়ের ‘রবীন্দ্র কথা কাব্যের শিল্পসূত্র’ প্রকাশিত হলো তখনো গৌরববোধে উজ্জীবিত হওয়া তো দূরের কথা, রবীন্দ্রনাথের কথাসাহিত্যের প্রথম সমালোচক সম্পর্কে আমরা সচেতনই হলাম না। বইটি প্রকাশিত হওয়ার পরপরই যদি বাংলাদেশে আমরা একটি জাতীয় সেমিনারের আয়োজন করে সুখরঞ্জন রায়কে (যাঁর জন্ম ১৮৮৯ সালে ও মৃত্যু ১৯৬৪-তে) স্মরণ করতাম, এবং রবীন্দ্রনাথের গল্প ও উপন্যাসের প্রথম সমালোচক রূপে তাঁর পরিচয় দেশের সাহিত্য রসিকদের কাছে তুলে ধরতাম, তবে তাই হতো যথার্থ সারস্বত দায়িত্ব পালন।

যাই হোক, তখন করিনি বলে এখন যে সে দায়িত্ব পালন করা যাবে না, তা তো নয়। বিগত একশো বছরেরও বেশি সময়ে রবীন্দ্র সাহিত্যের বিশ্লেষণ করে অজস্র রচনা প্রকাশিত হয়েছে। সেসবের মধ্যে রবীন্দ্রনাথের কথাসাহিত্যের সমালোচনার সংখ্যাও মোটেই কম নয়। তবুও সেই ভূরি ভূরি রচনার ভিড়েও রবীন্দ্র কথাসাহিত্যের প্রথম সমালোচক সুখরঞ্জন রায়ের সমালোচনাগুলোকে আজও মোটেই নিষ্প্রভ মনে হবে না। আজও যে কোনো ধীমান ও রসজ্ঞ পাঠক সুখরঞ্জনের সমালোচনায় তাঁর অন্তরদৃষ্টি ও মৌলিকতার পরিচয় পেয়ে চমত্কৃৎ হয়ে যাবেন। আমার তো মনে হয়, এ যুগের সমালোচকদেরও সুখরঞ্জনের কাছ থেকে শিক্ষা নেওয়ার মতো অনেক কিছুই আছে।

বিশ শতকের প্রথম দুই দশকেও বাঙালি পাঠক হৃদয়ে বঙ্কিমচন্দ্রেরই ছিল একাধিপত্য। রবীন্দ্রনাথের উপন্যাস থেকে রস আহরণ করার মতো পাঠকরুচি তখনো গড়ে ওঠেনি। বঙ্কিমের ‘বিষবৃক্ষ’ বা ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’ এর জমজমাট কাহিনী যাদের আনন্দে উদ্বেল করে তোলে, তাঁরাই আবার রবীন্দ্রনাথের ‘চোখের বালি’ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন। অর্থাৎ বাঙালি পাঠক তখনো উপন্যাসে ঘটনার ঘনঘটাই পছন্দ করেন, পাত্রপাত্রীর ‘আঁতের কথা’ জানতে তাঁদের তেমন আগ্রহ নেই। শুধু সাধারণ পাঠক নন, পাঠকদের মধ্যে যারা নিজেদের স্বতন্ত্র ও বিশিষ্ট বলে দাবি করেন সেই সমালোচককুলও বোধ হয় সে সময়ে রবীন্দ্র উপন্যাসের স্বাতন্ত্র্য ও অসাধারণত্বের স্বরূপ উপলব্ধি করতে পারেননি। তা না হলে রবীন্দ্রনাথের ‘চোখের বালি’ ‘নৌকাডুবি’ ও ‘গোরা’ প্রকাশের পরও তারা নীরব রইলেন কেন?

সুখরঞ্জন রায় শুধু সেই নীরবতাই ভঙ্গ করলেন না, ঔপন্যাসিক রবীন্দ্রনাথের স্বাতন্ত্র্য চিহ্নগুলো অত্যন্ত স্পষ্টভাবে তুলে ধরলেন, বঙ্কিমচন্দ্রের সঙ্গে তুলনামূলক আলোচনায় রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যিক বেশিষ্ট্যকে তিনিই প্রথম নৈপুণ্যের সঙ্গে উদঘাটন করলেন। ‘চোখের বালি’ ও ‘নৌকাডুবি’র প্রতিটি চরিত্রেরই অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণ তিনি উপস্থিত করেছিলেন; দুটো উপন্যাসেরই ঘটনাবৈচিত্র্য, রসবৈচিত্র্য, ভাষা ও রচনাভঙ্গির প্রকৃতি প্রাঞ্জলভাবে চিহ্নিত করেছিলেন; ‘বৌ ঠাকুররানীর হাট’ ও রাজর্ষিতে যে রাবীন্দ্রিক বৈশিষ্ট্যের পরিপূর্ণ প্রকাশ ঘটেনি— সে কথাও জানাতে ভুললেন না। সুখরঞ্জনের সমালোচনা- রীতিটি সেকালের জন্য ছিল  খুবই উপযোগী। একালেও বোধ হয় এ রীতিটিকে একেবারে বাতিল করে দেওয়া চলে না। এ রীতিতে সমালোচক শুধু মূল্যায়নকারী হয়েই থাকেন না, অনভ্যস্ত পাঠকের জন্য শিক্ষকের ভূমিকাও গ্রহণ করেন। সমালোচকের এ রকম ভূমিকা গ্রহণের প্রয়োজন একালেও নিশ্চয়ই ফুরিয়ে যায়নি। লেখকের সঙ্গে পাঠকের সেতুবন্ধন করে দেওয়ার দায়িত্ব তো সবকালের  সমালোচককেই বহন করতে হয়। পাঠকের মানসিক জড়তা ভাঙার জন্য যে রকম দরকার, সে রকম রীতিই যে কোনো যুগের যে কোনো সৎ সমালোচককেই খুঁজে নিতে হয়। সুখরঞ্জন, তাই অত্যন্ত সঙ্গতভাবেই এ রকম উপযুক্ত রীতিটি উদ্ভাবন করে নিয়ে রবীন্দ্র কথাসাহিত্যের পথিকৃৎ সমালোচকের দায়িত্ব পালন করেছিলেন।

সুখরঞ্জনের রবীন্দ্র-উপন্যাস-সমালোচনা অবশ্যি ‘চোখের বালি’ ও ‘নৌকাডুবি’ পর্যন্ত এসেই থেমে রইল। এরপর তিনি পুরো মনোযোগ নিবদ্ধ করলেন ছোটগল্পের আলোচনায়।

উপন্যাসের তুলনায় ছোটগল্পের প্রকৃত রসগ্রাহী ও বোদ্ধা পাঠক তো বরাবরই কম। বিশ শতকের সূচনায় আরও কম ছিল। তখন বাংলায় ছোটগল্পের প্রবতর্ক রবীন্দ্রনাথ ছাড়া অন্য কোনো সার্থক ছোটগল্পকার ছিলেনই না বলতে গেলে। সে সময়ে, তাই, সুখরঞ্জন রায় বাঙালি পাঠকদের কাছে ছোটগল্পের রূপ-প্রকৃতি ও তার ইতিহাস তুলে ধরার দায়িত্ব অনুভব করলেন। এভাবে ছোটগল্পের নানা দিক সম্পর্কে অবহিত করেই তিনি পাঠককে রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পের রস আহরণের জন্য প্রস্তুত করে তুলতে চেয়েছিলেন।

এ ব্যাপারেও, মনে হয়, সুখরঞ্জন অনুপ্রেরণা তথা দিক-নির্দেশনা পেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকেই। সমালোচকের দায়িত্ব সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের চিন্তার পরিচয় দিতে গিয়ে আচার্য সুকুমার সেন লিখেছিলেন—

‘সমালোচকের আসল কাজ, লেখকের ও পাঠকের মধ্যে না বোঝার অন্তরাল যথাসাধ্য অপসারণ করা এবং রচনায় কোনো মূল্য থাকিলে তাহাও পাঠকের গোচরে আনা। উঁচু সমালোচক হইলে তিনি রচনার মূল্য আবিষ্কার করিতে পারেন। তখন সমালোচক ও স্রষ্টার মধ্যে পার্থক্য ঘুচিয়া যায়। বাঙ্গালা সাহিত্যে এই কাজে রবীন্দ্রনাথ একক ও অপ্রতিম।’

সুখরঞ্জন রায়-যে যথার্থই একজন ‘উঁচু সমালোচক’ ছিলেন তাঁর লিখিত সমালোচনাসমূহই সে প্রমাণ বহন করে। বোঝা যায় : তিনি রবীন্দ্রনাথের চিন্তাকেই আপন সত্তায় ধারণ করে সাহিত্য সমালোচনায় প্রবৃত্ত হয়েছিলেন, এবং একই সঙ্গে তাতে স্বকীয় বৈশিষ্ট্যেরও প্রকাশ ঘটিয়েছিলেন।

সে সময়ে বাংলায় কথাসাহিত্য সমালোচনার উপযোগী ভাষাটিও তৈরি হয়নি। সেক্ষেত্রেও সুখরঞ্জনকে নিজের পথ নিজেই কেটে নিতে হয়েছিল, সমালোচনার পরিভাষাও তিনি নিজেই সৃষ্টি করে নিয়েছিলেন। ‘রোমান্টিসিজম’ বোঝানোর জন্য তিনি ব্যবহার করেছেন ‘কল্পপন্থা’ শব্দটি। তেমনই তার হাতে ‘মিস্টিসিজম’ হয়েছে ‘আলোকপন্থা’, ‘বিয়্যালিজিম’— ‘বস্তুপন্থা,’ ‘আইডিয়ালিজম।’— ‘শ্রেয়ঃপন্থা’ এবং ‘সিম্বলিজম’-‘বিগ্রহ পন্থা।’ এসব পন্থা রবীন্দ্রনাথের কোন ছোটগল্পে কোনভাবে প্রকাশ রূপ লাভ করেছে তার বিস্তৃত আলোচনা করেছেন সুখরঞ্জন। সে আলোচনায় কখনো কখনো তিনি পাশ্চাত্যের দিকপাল লেখকদের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের তুলনা টেনে এনেছেন। এরকম তুলনামূলক সমালোচনার উত্কৃষ্ট উদাহরণ সুখরঞ্জনের ‘অলোকপন্থায় পো ও রবীন্দ্রনাথ’ প্রবন্ধটি। ‘আমেরিকার গল্পের রাজা এডগার এ্যালেন পো ও বাংলার গল্পের রাজা রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পে অলোকপন্থা কীভাবে ফুটিয়া উঠিয়াছে’— ওই প্রবন্ধটিতে রয়েছে তারই সুনিপুণ বিশ্লেষণ। এ ধরনের বিশ্লেষণ আমাদের সমালোচনা-সাহিত্যে খুব বেশি আছে বলে মনে হয় না।

‘রবীন্দ্র কথাকাব্যের শিল্প সূত্র’ গ্রন্থটি পাঠ করার পর মানতেই হয় যে রবীন্দ্রনাথের কথাসাহিত্যের সমালোচনায় সুখরঞ্জন রায় শুধু পথিকৃৎই ছিলেন না, তিনি ছিলেন একান্ত সার্থক এবং প্রকৃত রসগ্রাহী ও সূক্ষ্মদর্শী একজন সমালোচক।

সর্বশেষ খবর