শুক্রবার, ২৮ অক্টোবর, ২০২২ ০০:০০ টা

সেই জানালাটা

হারুকি মুরাকামি, ভাষান্তর : আকাশ মাহমুদ

সেই জানালাটা

শুভেচ্ছা।

যত দিন যাচ্ছে শীত ক্রমশই কমছে। এই তো, সূর্যালোক আসন্ন বসন্ত সময়ের মৃদু আভাস দিচ্ছে। দৃঢ় আশা, তুমি ভালো আছো।

তোমার সাম্প্রতিক চিঠিটি ছিল সত্যিই আনন্দদায়ী ও স্বাদু। বিশেষত, হ্যামবার্গারের মাংস আর জয়ফলের সঙ্গে পারস্পরিক সম্পর্কের বিষয়ে লেখা অংশটি সত্যিই চমৎকার। আমার মতে, নিত্য জীবনযাপনের নিরিখে এক ঋদ্ধ বর্ণনা। এতে বর্ণিত রসুইঘরের উষ্ণ সৌরভ কথা আর পিঁয়াজ টুকরো করবার সময় কাটিং বোর্ডের ও ছুরির সানন্দ ঘর্ষণশব্দ-নিখুঁত ও জীবন্ত।

পড়বার সময় তোমার চিঠির এই বর্ণনা হ্যামবার্গারের জন্য আমার ভিতরে এমন এক অদম্য আকাক্সক্ষা জাগিয়ে তুলল যে, সে রাতে আমাকে কাছের এক রেস্তরাঁয় ছুটে গিয়ে ইচ্ছেপূরণ করতে হয়েছে। কিন্তু আমার আবাসের কাছের ওই রেস্তরাঁটিতে আটটি বিভিন্ন প্রকারের হ্যামবার্গার বিক্রি হয় : টেক্সাস স্টাইল, হাওয়াইন স্টাইল, জাপানিজ স্টাইল এবং এমন আরও কয়েক প্রকার। টেক্সাস স্টাইলের হ্যামবার্গার বেশ বড়। আমি নিঃসন্দেহ, জাপানের এই অঞ্চলে কোনো টেক্সান তাদের এ খাবারটি দেখে অবাকই হবেন। হাওয়াইন স্টাইল হ্যামবার্গার আনারসের টুকরোয় সাজানো। ক্যালিফোর্নিয়া স্টাইল... আমি ঠিক মনে করতে পারছি না। জাপানি স্টাইলের হ্যামবার্গারে মুলোর মিহি গুঁড়ো ছড়ানো। রেস্তরাঁটি সুসজ্জিত, খুবই হ্রস্ব স্কার্টের পরিচারিকারা সুশ্রী ও আকর্ষণীয়া।

তবে এটা নয় যে, আমি ওই রেস্তরাঁয় গিয়েছিলাম অভ্যন্তরীণ সাজসজ্জা পর্যালোচনা বা পরিচারিকাদের উন্মুক্ত পা দেখার জরুরি উদ্দেশ্যে। গিয়েছিলাম কেবল হ্যামবার্গার খেতে-তাও টেক্সাস স্টাইল বা ক্যালিফোর্নিয়া স্টাইল অথবা অন্য কোনো স্টাইলের না, বরং সাদামাটা একটা হ্যামবার্গার।

পরিচারিকাকে আমি আদতে তাই বলতে চেয়েছিলাম। ‘দুঃখিত’-সে বলল, ‘আমাদের কাছে কেবল এই স্টাইলের হ্যামবার্গারই আছে।’

অবশ্য আমি পরিচারিকাকে দোষ দিই না। সে তো আর মেন্যু বানায়নি? সে তো নিজে আর এই পোশাক পছন্দ করেনি যা টেবিলের বাসনকোসন পরিষ্কার করার সময় প্রায় তার পুরো ঊরুকেই উদোম করে দেয়। আমি মৃদু হেসে তাকে হাওয়াইন স্টাইল হ্যামবার্গার দিতে বললাম। সে বললেও খাওয়ার সময় আমি হ্যামবার্গারে দেওয়া আনারসের টুকরোগুলো খুব একটা সরাইনি।

কী এক বিচিত্র ও বিস্ময়কর পৃথিবীতে আমরা বাস করি! চেয়েছিলাম শুধু সাদামাটা একটা হ্যামবার্গার খেতে। কিন্তু রাতের এই সময়ে সে জন্য খেতে পারতাম আনারস ছাড়া হাওয়াইন স্টাইল হ্যামবার্গার!

তোমার বানানো হ্যামবার্গার সাদামাটা স্টাইলেরই হবে বলে মনে হচ্ছে। চিঠির জন্য ধন্যবাদ। আমার একান্ত বাসনা, তোমার হাতে তৈরি পুরোপুরিই সাধারণ একটা হ্যামবার্গার কখনো খেতে যেন পারি।

অন্যদিকে, চিঠিতে জাতীয় রেলওয়ের টিকিট কাটার যন্ত্র নিয়ে লেখা অংশটি আমাকে তেমন গভীরভাবে নাড়া দেয়নি। এই সমস্যা প্রসঙ্গে তোমার চিন্তা ভালো, কিন্তু পাঠকের কাছে সে সমস্যা খুব স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান হচ্ছে না। তাই বলি, এত খুঁটিয়ে সবকিছু দেখার বিষয়ে সচেষ্ট হয়ো না। পত্র লেখা আসলে জীবনের এক সাধারণ ব্যবস্থামাত্র।

সর্বশেষ এই চিঠিটির জন্য তুমি সাকুল্যে ৭০ নম্বর পেতে পার। তোমার প্রকাশশৈলী সুস্পষ্টভাবে ক্রমেই উন্নত হচ্ছে। অধৈর্য হয়ো না। সব সময়ের মতোই তুমি আন্তরিক ও কঠোর পরিশ্রম করে যাও। পরের চিঠির জন্য আমি সাগ্রহে অপেক্ষমাণ। আশু বসন্তকালের ছোঁয়ায় সেই চিঠিটি কী চমৎকার সুন্দর হয়ে উঠবে না!

পুনশ্চঃ নানা রকমের বিস্কুটের বাক্সটির জন্য ধন্যবাদ। ওগুলো সুস্বাদু। জেনো, আমাদের সঙ্ঘের বিধি এই যে চিঠির বাইরে ব্যক্তিগত যোগাযোগ অবশ্যই পরিহার্য। তাই ভবিষ্যতে তোমার এমন সহমর্মিতাকে নিয়ন্ত্রণ করতে অনুরোধ করি।

যা হোক, পুনরপি ধন্যবাদ।

বর্তমান খণ্ডকালীন কাজটি বছরখানেক ধরে করছি। শুরুর সময় আমি ছিলাম বাইশে।

ইদাবসি জেলায় ‘কলমসঙ্ঘ’ নামের একটি অভূতপূর্ব ক্ষুদ্র কোম্পানিতে পত্রপ্রতি ২ হাজার ইয়েনের বিনিময়ে আমি মাসে ত্রিশ বা ততোধিক পত্রের সংশোধনের কাজ করতাম।

‘তুমিও এখানে চমৎকার মনোমুগ্ধকর চিঠি লেখা শিখতে পারো’-কোম্পানির বিজ্ঞাপন করে বললাম। নতুন সদস্যদের প্রাথমিক ভর্তি ফিসহ প্রতি মাসে প্রয়োজনীয় ফি দিতে হয়। বিনিময়ে তারা মাসপ্রতি চারটি চিঠি সঙ্ঘের কাছে লিখতে পারে। তখন আমরা, সঙ্ঘের কলমশিক্ষকরা, সেগুলোর উত্তর দিয়ে থাকি ওপরে উদ্ধৃত চিঠিটির মতো আমাদেরও চিঠিসহ। সে চিঠিতে প্রেরকের চিঠির প্রয়োজনীয় সংশোধন, মন্তব্য এবং ভবিষ্যতে চিঠি লেখার উন্নতিকল্পে দরকারি নির্দেশনা দিতাম। সাহিত্য বিভাগের ছাত্র-দফতরে সাঁটানো এক বিজ্ঞাপন দেখে আমি একদা চাকরির জন্য সাক্ষাৎকার দিতে গিয়েছিলাম। সে সময় কিছু কারণে আমাকে গ্র্যাজুয়েশন কোর্স এক বছরের মতো পেছাতে হয়েছিল। এদিকে বাবা-মাও জানিয়ে দিয়েছিলেন যে ক্রমান্বয়ে তাঁরা আমার মাসিক আর্থিক বরাদ্দ কমিয়ে আনবেন। সে জন্য সেই প্রথমবারের মতো আমাকে জীবিকার্জনের চেষ্টা শুরু করতে হয়। সাক্ষাৎকার-পর্বে  তাঁরা আমাকে বিভিন্ন রকমের রচনা লিখতে দেন। এর এক সপ্তাহ পর আমার চাকরিটি হয়। তারপর দাফতরিক কাজে, চিঠিপত্রে সংশোধন-সংযোজন-বিয়োজন, যথার্থ পরামর্শ প্রদানসহ বিবিধ কৌশল শেখার জন্য এক সপ্তাহের প্রশিক্ষণে অংশ নিতে হয়। এগুলোর কিছুই তেমন কঠিন বিষয় ছিল না।

সঙ্ঘ সদস্যদের তাদের বিপরীত লিঙ্গের বিভিন্ন কলমশিক্ষকদের মাঝে বণ্টন করে দেওয়া হতো। আমার ছিল চৌদ্দ থেকে তিপ্পান্ন বছর বয়সী চব্বিশজন সদস্য। এর মধ্যে বেশির ভাগই পঁচিশ থেকে পঁয়ত্রিশ বছরের। সত্যি বলতে কি, তাদের অধিকাংশই বয়সে আমার চাইতে বড়। কাজের প্রথম মাসে আমি একটু আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিলাম: মেয়েরা আমার চাইতে বেশ ভালো লিখত আর তাদের অনেকের সংবাদদাতা রূপে বেশ ভালো অভিজ্ঞতা। বাস্তবিক, আমি জীবনে গভীর ভাবের চিঠি খুব কমই লিখেছি। ঠিক মনে করতে পারছি না কীভাবে প্রথম মাসটি পার করেছি। সর্বদাই শীতল চিকন ঘামে ভিজতাম। মনে হতো, হয়তো তাদের অনেকেই আমাকে বাদ দিয়ে নতুন কলমশিক্ষক চাইবেন। সঙ্ঘের বিধানে এমন সুযোগ আছে।

একটি মাস কেটে গেল-কিন্তু সদস্যদের কেউই আমার লেখা শেখানোর বিষয়ে একটি অভিযোগও করেনি। তার ওপর, মালিক জানাল যে আমি জনপ্রিয়। আরও দুই মাস গেল। মনে হলো আমার দায়িত্ব পালনে যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে। আমার লৈখিক উন্নয়নের পরামর্শ প্রদান পদ্ধতি এ জন্য ধন্যবাদ প্রাপ্য। ব্যাপারটা অদ্ভুত। এই মহিলারা তাদের শিক্ষক হিসেবে আমার দিকে পরিপূর্ণ আস্থার দৃষ্টিতে তাকাত। এটা বুঝতে পারবার পর কলমশিক্ষক হিসেবে দুশ্চিন্তাহীন অনায়াসে ঝটপট তাদের লেখার আলোচনা-সমালোচনা করতে পারতাম।

সে সময় আমি বুঝিনি, এই নারীরা সতত নিঃসঙ্গ (সঙ্ঘের পুরুষ সদস্যদের অবস্থাও তথৈবচ)। তারা লিখতে চাইলেও কেউ ছিল না পাঠাবার। তারা এমন স্বভাবেরও নয় যে অনুরাগী ভক্ত হিসেবে কোনো বিশেষ মানুষকে চিঠি পাঠাবে। তারা আরও ব্যক্তিগত কিছু চাইত- হোক না সে চিঠি সংশোধন বা সমালোচনায় ভরা।

তো আমি আমার জীবনের বিশের দশকের প্রথম কিছু বছর এভাবেই এমনই পত্রাবলির ঈষদুষ্ণ হারেমে সিন্ধু ঘোটকের মতো গোঁফ চুবিয়ে বুঁদ হয়ে কাটিয়েছিলাম।

আর সে যে হরেক রকমের কত বৈচিত্র্যে ভরা চিঠির এক ঝাঁপি! বিরক্তিকর চিঠি, মজার চিঠি, দুঃখমাখানো চিঠি...। আমি কোনো চিঠিই নিজের কাছে রাখতে পারিনি। কারণ, কোম্পানির নিয়ম এই, সব চিঠিই তাদের কাছে জমা করতে হবে। এই ঘটনা অনেক আগের বলে আমি বিশদ মনেও করতে পারছি না সবকিছু। তবে এটুকু মনে  আছে যে, প্রায় চিঠিই সার্বিকভাবে মহত্তর থেকে তুচ্ছাতিতুচ্ছ জীবন জিজ্ঞাসা রসে টইটম্বুর। আবার কারও কারও পাঠানো কথামালায় আমার মনে হতো- যেমন বাইশ বছরের এক কলেজ শিক্ষার্থীর- তার চিন্তা বাস্তবতাবিচ্ছিন্ন এবং কখনো মনে হতো পুরোটাই অর্থহীন। আমার জীবনাভিজ্ঞতার কমতির কারণে কিন্তু এই উপলব্ধিটা জাগেনি। এখন ভাবি, অন্যকে যা জানাতে বা বোঝাতে চাই তা নয় বরং আমরা যা নির্মাণ করি তাই বাস্তবতাবোধ। এটাই আমাদের মনে অর্থবোধের জন্ম দেয়। তখন এটা বুঝিনি। এমনকি ওই নারীরাও তা বোঝেনি। তাই বোধহয় তাদের চিঠির বিষয়বস্তু আমার কাছে দ্বিমাত্রিক বলে মনে হওয়ার এটাই একমাত্র কারণ।

চাকরি ছাড়বার সময় ঘনিয়ে এলে আমার অধীন কলমসঙ্ঘের শিক্ষার্থীরা খুব দুঃখ প্রকাশ করে। অকপটে বলছি, আমি ক্রমেই অনুভব করছিলাম যে চিঠি লিখবার এই অন্তহীন কাজ যথেষ্ট হয়েছে। তবু আমার মন খারাপ হয়েছিল। এও বুঝতে পারছিলাম, এতগুলো মানুষের এমন নিষ্কপট সরলতায় উদার করে খুলে দেওয়া হৃদয় অবলোকনের সুযোগ আমি আর কখনো পাব না।

***

সেই হ্যামবার্গার! যে নারীটিকে উদ্দেশ্য করে প্রাগুক্ত চিঠিটি বিবৃত হলো তার হাতে তৈরি হ্যামবার্গার খাওয়ার সুযোগ আমার হয়েছিল।

সে ত্রিশ বছরের। এখনো সন্তানহীন। স্বামী কাজ করে দেশের পঞ্চম স্থান অধিকারী একটি বিদিত কোম্পানিতে। মাস শেষে চাকরি ছেড়ে দেওয়ার কথা তাকে আমার শেষ চিঠিতে জানাবার পর সে আমাকে তার বাড়িতে মধ্যাহ্নভোজের নিমন্ত্রণ দেয় এই লিখে, ‘আামি ওইদিন আপনাকে যথাযথভাবে তৈরি সাধারণ হ্যামবার্গারই খাওয়াব।’ কলমসঙ্ঘের বিধিতে নিষেধ থাকলেও ঠিক করলাম নিমন্ত্রণ রক্ষা করব। বাইশ বছর বয়সী এক যুবকের অন্তর্লীন ঔৎসুক্য অস্বীকার্য নয়।

তার অ্যাপার্টমেন্টটি ওদাকু লাইনের দিকে মুখ করা। ঘরের পারিপাট্য নিঃসন্তান দম্পতির জীবনের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ। ঘরের আসবাবপত্র, আলোর জন্য ব্যবহৃত বৈদ্যুতিক সরঞ্জামাদি, এমনকি মেয়েটির গরম জামাও তেমন দামি নয়- কিন্তু সুন্দর, রুচিশীল। আমরা পারস্পরিক বিস্ময়বোধ নিয়েই যেন পরিচিত হলাম-আমি তার তারুণ্যপূর্ণ সজীব উপস্থিতিতে আর সে আমার বয়স জেনে। সে মনে করেছিল আমি তার চেয়ে বড় হব। কারণ সঙ্ঘ আইনে কলমশিক্ষকদের বয়স সদস্যদের জানানো যায় না।

পারস্পরিক বিস্ময়বোধ কাটিয়ে প্রাথমিক পরিচয়পর্বের উত্তেজনা স্তিমিত হলো। খেলাম হ্যামবার্গার। পান করলাম কফি। মনে হচ্ছিল, আমরা ট্রেন না পাওয়া দুজন যাত্রী একত্রে স্টেশনে বসে। ট্রেনের কথা প্রসঙ্গে বলতে হয়, তার চারতলার অ্যাপার্টমেন্টের জানালা দিয়ে নিচের ইলেকট্রিক ট্রেন লাইন ও চলাচল দেখা যায়। ওইদিন আবহাওয়া চমৎকার ছিল। দালানের বারান্দাগুলোর রেলিংজুড়ে রোদে শুকাতে দেওয়া রকমারি বিছানা ও চাদরের রঙিন সমাহার। শোনা যাচ্ছে বারংবার রেলিংয়ের সঙ্গে বিছানার প্রান্তের আঘাতের শব্দ। সে শব্দ এখনো কানে বাজে। আশ্চর্যজনকভাবে এই বোধ এখনো বিদূরিত নয়।

হ্যামবার্গারটি নিখুঁতভাবে বানানো। এর সৌরভও অপূর্ব। বাইরের দিকটি ঘনবাদামি ও মচমচে করে ভাজা। ভিতরটা রসালো। সসও চমৎকার। আমার জীবনে এমন সুস্বাদু হ্যামবার্গার কখনো খাইনি তা হলফ করে বলতে না পারলেও এ কথা নির্দ্বিধায় বলতে পারি অনেক দিন পরে খুব ভালো একটা হ্যামবার্গার আজ খেলাম। তাকে কথাটি বললে সে খুব খুশি হলো।

কফি পান শেষে রেকর্ডে বার্ট বাকেরাকের গান শুনতে শুনতে আমরা পরস্পরের জীবনের কথা বলছিলাম, শুনছিলাম। বলার মতো জীবনের গল্প আমার এখনো জমেনি। তাই বেশির ভাগ কথা সে-ই বলছিল। কলেজজীবনে সে লেখক হতে চেয়েছিল। তার অন্যতম প্রিয় লেখক ফ্রাঙ্কোইস সাগান। সাগান আমার যে অপছন্দ তা নয়। অন্য অনেকের মতো আমি তাকে হালকা মনে করি না। এমন কোনো আইন নেই যে সবাইকে হেনরি মিলার বা জাঁ জেনের মতো উপন্যাস লিখতে হবে।

‘আমি তো লিখতে পারি না’ সে বলল।

‘এখন লেখালিখি শুরু করা বিলম্বের কোনো বিষয় নয়’ আমি বললাম।

‘না, জানি আমি লিখতে পারি না। আপনিই তো সে কথা আমাকে জানিয়েছিলেন।’-মৃদু হেসে সে বলল। ‘কলমসঙ্ঘে আপনাকে চিঠি লিখে সেটা আমি বুঝতে পারি। আমার সে প্রতিভা নেই।’

লজ্জায় লাল হলাম। অবশ্য এমন এখন আমার তেমন হয় না। তবে বাইশ বছর বয়সে সর্বদাই লাজ রক্তিম হওয়ার অভ্যেস ছিল। ‘এটা অবশ্য সত্যি, আপনার লেখায় কিছুটা সারবস্তু থাকত।’

জবাব না দিয়ে সে হাসল- চিলতে একটি হাসি।

‘একটি চিঠি তো আমাকে হ্যামবার্গার খেতে বাইরে টেনেও নিয়ে গিয়েছিল।’

‘আপনার নিশ্চয়ই তখন খিদে পেয়েছিল।’

কী জানি! হয়তো আমার খিদেও ছিল!

জানালার নিচে দিয়ে ঠনঠন শুকনো শব্দে একটি ট্রেন চলে গেল।

৫টা বাজবার সংকেত ধ্বনি দিল ঘড়িটা। এবার যেতে হয় জানিয়ে বললাম, ‘আপনার তো নিশ্চয়ই এখন স্বামীর জন্য রাতের খাবার বানাতে হবে।’

‘ও বেশ রাত করেই ঘরে আসে’ হাতে চিবুক রেখে সে বলল। ‘মাঝরাতের আগে সে আসবে না।’

‘তিনি নিশ্চয়ই খুব ব্যস্ত মানুষ।’

‘তাই মনে হয়’ বলে একটু থামল। ‘মনে আছে এক চিঠিতে আমার সমস্যার কথা লিখেছিলাম। কিছু বিষয় আছে যা আমি তার সঙ্গে বসে সত্যিই আলাপ করতে পারি না। আমার কথা, চিন্তা বা অনুভূতি তার মর্মে পৌঁছায় না। অনেকবারই মনে হয়েছে আমরা দুই ভিন্ন ভাষায় পরস্পর ভাব বিনিময় করছি।’

কী বলব তাকে ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলাম না। আমি এও বুঝতে পারছিলাম না যে দম্পতিরা দুজন পরস্পরের কাছে হৃদয়ের কথা না বলে কীভাবে জীবনযাপন করে!

‘যাক, এসব কিছু না এমন’ সে যে নরম স্বরে ও ভঙ্গিতে বলল যেন মনে হলো সবই ঠিকঠাক চলছে। ‘এই কয়েক মাস ধরে আমার কাছে চিঠি লিখবার জন্য ধন্যবাদ। খুব উপভোগ করেছি। সত্যিই। আর আপনার কাছে প্রতিউত্তর লেখা ছিল আমার জন্য বন্দিত্বমুক্তি।’

বললাম, ‘আমিও এই চিঠি লেখালিখিতে খুব আনন্দ পেয়েছি।’ অবশ্য সে কী কী লিখেছিল তার সব ঠিক সেই মুহূর্তে মনে করতে পারছিলাম না। 

কিছুক্ষণ কাটল কথাহীন নীরবতায়। সে দেয়ালঘড়ির দিকে তাকিয়ে যেন বহমান সময় গতিকে মনোযোগ দিয়ে দেখছিল।

‘গ্র্যাজুয়েশনের পর কী করবেন আপনি?’ সে জানতে চাইল।

তাকে জানালাম যে, আমি এ ব্যাপারে কিছুই ভাবিনি। কী করব বা হবে তাও জানা নেই। এ কথা বলবার সময় দেখি সে মৃদু হাসছিল। ‘লেখালিখি সম্পৃক্ত কোনো কিছুতে হয়তো আপনি নিয়োজিত হবেন।’ বলল সে। ‘আপনার আলোচনা ও সমালোচনা সত্যিই চমৎকার। সব সময়ই আমি আপনার তেমন চিঠি পেতে উন্মুখ হয়ে থাকতাম। সত্য বলছি। আপনাকে খুশি করতে একটুকুও বাড়িয়ে নয়। অবশ্য এটাও ঠিক যে আপনি সেসব চিঠি চাকরির স্বার্থেই লিখতেন; কিন্তু তবুও তা ছিল স্বতঃস্ফূর্ত অনুভূতির অভিপ্রকাশ। সবই আমি জমিয়ে রেখেছি। সময় সময় সেগুলো বের করে আবারও পড়ি।’

‘ধন্যবাদ’ বললাম, ‘আর হ্যামবার্গারের জন্যও অসংখ্য ধন্যবাদ।’

দশ বছর কেটে গেছে। কিন্তু যখনি ওদাকু লাইনের পাশের এলাকা দিয়ে যাই আমি তার এবং সেই মচমচে ভাজা স্বাদু হ্যামবার্গারের কথা ভাবী। রেললাইনের পাশের সারিবদ্ধ দালানগুলোর দিকে তাকিয়ে নিজেকে জিজ্ঞেস করি ঠিক কোন জানালাটা তার অ্যাপার্টমেন্টের। সেই জানালাটা থেকে দেখা বাইরের দৃশ্যপটের কথা ভাবী এবং চেষ্টা করি ঠিক কোনটা তার সেটা বুঝতে। কিন্তু ঠিক মেলাতে পারি না।

মনে হয় সে আর ওখানে নেই। থাকলেও সে হয়তো সেই জানালার অপর পাশে বসে অবসরে শুনছে বার্ট বাকারাকের গানের রেকর্ড।

আমার কি সেদিন তার সঙ্গে বিছানায় ঘুমানো উচিত ছিল?

এই আখ্যানের সেটাই মুখ্য জিজ্ঞাসা।

এর উত্তর আমার বোধের বাইরে। এখনো এটি আমি বুঝে উঠতে পারি না। আমাদের বয়স যতই বাড়ুক আর অভিজ্ঞতার ব্যাপ্তি যাই হোক না কেন জীবনের অনেক কিছুই তো বোঝার ও বোধের বাইরে। এখন আমি কেবল পথিমধ্যে ট্রেন থেকে সারি সারি জানালার দিকে তাকিয়ে থেকে ভাবতে পারি ওইটি বোধ হয় সেই জানালা। কখনো কখনো মনে হয় প্রত্যেকটিই তার সেই জানালা কিংবা আবার কখনো ভাবী কোনোটাই তার সেই জানালা নয়। দেখি ওখানে দালানে অনেক অনেক অনেক জানালা।

* গল্পটি ভিনটেজ বুকস, লন্ডন কর্তৃক প্রকাশিত হারুকি মুরাকামির দ্য অ্যালিফেন্ট ভেনিসেস গল্পগ্রন্থে গ্রন্থিত। জাপানি ভাষা থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ জে রবিন।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর