শিরোনাম
শুক্রবার, ১০ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ ০০:০০ টা

অন্ধকার নামতে পারেনি - পর্ব ২

ইমদাদুল হক মিলন

অন্ধকার নামতে পারেনি - পর্ব ২

[পূর্ব প্রকাশের পর]

 

তোমারে এই বাড়ির মাইয়া মনেই হয় না। খালাম্মা খালুজানে যদি বিবাহ দেয় তয় অনেক ভালো ছেলের সঙ্গে তোমার বিবাহ হইব। পারলে আমি তোমার বিবাহ বন্ধ করতাম, আপা। আমি ছোট মানুষ। আমার কোনো ক্ষমতা আছে, কও? বাবায়ই পারল না।”

এবার দোলনের দিকে ফিরল অন্তু। ঘর অন্ধকার। বাইরের দিককার দরজার তলা দিয়ে বারান্দার এক চিলতে আলো ঢুকেছে। ঢুকে দরজার কাছেই শেষ হয়ে গেছে। দুবোন পড়ে আছে ঘোরতর অন্ধকারে।

অন্তু বলল, “বাবা কি বিয়ে নিয়ে মাকে কিছু বলেছিল?”

“বলছিল। তোমারে এখন সে বিবাহ দিতে চায় না। শুইনা বাবারে বিরাট ধমক দিছে মায়। আমার মনে হয়, গফুর গোপনে মারে টাকা পয়সা দিছে। এইজন্য মায় এত পাগল।”

দোলনকে জড়িয়ে ধরে আবার কাঁদতে লাগল অন্তু। “আমি এখন কী করব, দোলন? চলে আসার সময় খালু এমন করে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল, দেখে মনে হলো আমি আমার অসুস্থ বাবাকে মরণের মুখে ফেলে চলে এলাম।”

“তুমি পলাইয়া যাও আপা। এই বিবাহ কইরো না।”

‘পালিয়ে গেলে মা আবার গিয়ে ধরে আনবে। গফুরের সঙ্গেই আমার বিয়ে দেবে।”

দোলন কথা বলল না। দীর্ঘশ্বাস ফেলল।

“আমার জন্য আমাদের পরিবার এখন সচ্ছল। যে মানুষটা আমাদের জন্য এত কিছু করল, তাঁকে অসুস্থ ফেলে চলে এলাম? তিনি আমাকে মেয়ের মতো ভালোবাসেন। আমি তাঁর সঙ্গে বেইমানি করলাম, দোলন।”

“এইটা তোমার দোষ না আপা। তুমি পলাইয়া যাও। মায় আনতে গেলে আসবা না। পুলিশের ভয় দেখাইবা। এখন অনেক মেয়ে নিজের বিয়ে নিজে বন্ধ করে। বাল্যবিবাহ বাংলাদেশে নিষেধ। ভোর হওয়ার আগেই পলাইয়া যাও। তোমার কাছে টাকা-পয়সা আছে না?”            

“আছে। ঈদের সময় অনেক ‘সালামি’ পাই। সাত হাজার টাকার মতো আছে।”

“তবে আর কী! পলাইয়া যাও।”

‘দেখা যাক।”

কিন্তু ভোরবেলা অন্তু পালাল না। ঘুম ভাঙার পর দোলন ইসারায় জানত চাইল সে পালায়নি কেন? অন্তুও ইসারায় বলল, দুয়েকদিন দেখে তারপর যা করার করবে।

সেদিন ঘটল এক জঘন্য ঘটনা।

সকালবেলা চমৎকার রোদ উঠেছে। অন্তুদের গাছপালা ঘেরা ছোট্ট বাড়ি রোদে ঝলমল করছে। হাওয়া বইছে, পাখি ডাকছে। পালাবার চিন্তা মাথায় আছে বলে অন্তু আজ অনেকটা স্বাভাবিক। কালরাতে বাড়ি এসে সেই যে ঘরে ঢুকেছিল আর বেরোয়নি। রাতের ভাত সামান্য খেয়েই রেখে দিয়েছিল। আজ সকালে দালান ঘরের পিছনের বারান্দায় এসে অবাক। উঠোনের উত্তর পুবকোণে বড় আমগাছটা ঘেষে দোচালা টিনের ছোট সুন্দর একটা ঘর উঠেছে। সকালবেলার রোদে ঘরের টিন চকচক করছে। মরিয়ম ছিল রান্নাঘরে। অন্তুকে দেখে হাসিমুখে এগিয়ে এলো। “তোর বিবাহের জন্য ঘর তুলছি। বাপের বাড়িতে আসলে জামাই লইয়া এই ঘরে থাকবি।”

অন্তু কথা বলল না।

পর পর দুটো রাত ঘুমাতে পারেনি। তার সঙ্গে দোলনও কালরাত জেগে কাটিয়েছে। এজন্য দুপুরবেলা ঘুমিয়ে পড়েছিল দুবোনই। অন্তু আজ খেয়েছেও ঠিক মতো। পলাবার চিন্তাটা মাথায় আছেই। একটু স্থির হয়েই কাজটা সে করবে। এজন্য ব্যাগ থেকে সাত হাজার টাকা বের করে বুকের কাছে গুঁজে রেখেছে। মোবাইলটা রেখেছে হাতের কাছে।

বিকেলবেলা ঘুম ভাঙল মরিয়মের ডাকাডাকিতে। অন্তুকে আদুরে স্বরে বলল, “ভালো কইরা হাত মুখ ধো। চা বানাইছি, চা খা।” আর দোলনকে দিল ধমক। “তোর এত ঘুমের কী হইছে? বইনরে পাইয়া আল্লাদ হইছে, না? ওঠ, তাড়াতাড়ি ওঠ।”

অন্তু এখন আর দুধ চা খায় না। মোরশেদ সাহেবের বাড়িতে রং চা খাওয়ার নিয়ম। এই বাড়িতে গরুর দুধের চা। অভ্যাস নেই বলে দুধ চা ভালো লাগল না। তবু খেল।

সন্ধ্যার দিকে মরিয়ম বলল, “তোর বিবাহের জন্য নতুন ঘর তুললাম, সেই ঘর তুই দেখলিই না। চল, ঘরটা দেখাই।”

অন্তু বিরক্তির গলায় বলল, “বাইরে থেকে দেখেছি তো।”

মরিয়ম হাসল। “ঘরের বাইর একরকম, ভিতর আরেক রকম। ভিতরটা দেখ।”

অন্তুর হাত ধরে টানল সে। “চল।”

নতুন ঘরের দরজায় শিকল টানা। ঘরের কাছে এসে মরিয়ম বলল, “ঘরে ঢোক মা। লাইট জ্বাল। দরজার পাশেই সুইচ। তোর ঘর তুই দেখ। মোবাইলটা আমার হাতে দে।”

মোবাইল মায়ের হাতে দিল অন্তু। মরিয়ম নিজেই শিকল খুলে দিল। অন্তু ঘরে ঢুকল। বেশ অন্ধকার জমেছে ঘরে। দরজার পাশ হাতড়ে সুইচ খুঁজতে গিয়ে টের পেল, দরজা বাইরে থেকে টেনে দিচ্ছে মরিয়ম। শিকল তুলে দিচ্ছে।

“কী ব্যাপার?”

ততক্ষণে সুইচ পেয়ে গেছে অন্তু। আলো জ্বেলে সে একেবারে হকচকিয়ে গেল। ঘরে সস্তা কাঠের নতুন খাট আর সেই খাটে একটা লোক শুয়ে আছে। অন্তুকে দেখে হাসিমুখে উঠে বসল।

অন্তু দিশেহারা গলায় বলল, “আপনি কে? এই ঘরে কী করছেন?”

“আমার নাম গফুর। আমার সঙ্গেই তোমার বিবাহ হবে? তবে এই কাজটা আমার বুদ্ধিতে হয় নাই। বুদ্ধি তোমার মা’র। দুপুরে তোমাদের বাড়িতে আসার পর তোমার মা’য় এই বুদ্ধি করছে। তোমারে আমারে এই ঘরে ঢুকাইয়া তালা লাগাইয়া দিব। যাতে তোমার আমার মধ্যে একটু ভাব ভালোবাসা হয়। হা হা হা।”

অন্তুর মনে হলো সে আর বেঁচে নেই। এইমাত্র মরে গেছে। কোনো রকমে শুধু বলল, “বাইরে থেকে তালা লাগিয়ে দিয়েছে?”

“হ। তুমি বসো। ঠান্ডা হইয়া বসো। ঘাবড়াইয়ো না। আমি লোক খারাপ না। যার সঙ্গে বিবাহ হবে তার সঙ্গে জোরাজোরি করব না। দেশ গ্রামের অনেকেই মেয়ে দিতে চাইছে আমারে। চাইব না ক্যান, কও? সৌদিতে থাকি। টাকা-পয়সা আছে। তবে আমার পছন্দ হইছে তোমারে। এই জন্য তোমারেই বিবাহ করতে চাইছি। তোমার মা’রে নগদ দিলাম পঞ্চাশ হাজার। লাখখানেক খরচা কইরা এই ঘর তুইলা দিলাম। আমার সংসারে তুমি ভালো থাকবা। বছরে দুইমাস দেশে থাকি আমি। বাড়িতে শুধু বুড়া মা আর ছোটভাই। বসো, বসো।”

অন্তু বুঝে গেল মা তাকে কোন ষড়যন্ত্রের জালে জড়িয়েছে! গফুরের সঙ্গে এই ঘরে রাত কাটাতে হবে। এইভাবে রাত কাটাবার পর গফুরকে বিয়ে না করে উপায় থাকবে না। মা হয়ে এমন কাজ করল মরিয়ম?

বুক ঠেলে গভীর কষ্টের কান্না উঠে এলো চোখে। জোর করে কান্না চেপে রাখল সে। না, এখন কান্নাকাটি করবে না। দেখা যাক বুদ্ধি খাটিয়ে গফুরকে সামলানো যায় কিনা। যদি সামলাতে পারে তাহলে সকালবেলা মা যখন দরজা খুলবে তখন যা করার করবে।

অন্তু মাথা ঠান্ডা রাখার চেষ্টা করতে লাগল।

গফুর মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকে। বলল, “তোমার ফটো দেখছি। তুমি ফটোর চেয়ে অনেক বেশি সোন্দর। তোমার তুলনায় আমার বয়স বেশি। তাতে কোনো অসুবিধা নাই। বয়স্ক স্বামী ভালো। স্বামী তো তারা থাকেই, তারপর হয় বাপের মতো। বউরে মেয়ের মতন আগলাইয়া রাখে। হা হা হা। বসো অন্তু, বসো। আমি লোক খারাপ না।”

নিজেকে সামলে বেশ সাবলীল ভঙ্গিতে খাটের এক কোণে বসল অন্তু। “আপনি যে লোক খারাপ না, বুঝতে পারছি। কিন্তু মাকে এই কাজটা করতে মানা করেননি কেন? কয়েকদিন পর আপনার সঙ্গে আমার বিয়ে হবে। বিয়ের বর কনে দুজনেই বাসররাতের জন্য অপেক্ষা করে। সেটা একটা আনন্দের রাত। বিয়ের আগেই কি সেই আনন্দটা আমরা নষ্ট করে ফেলব?”

গফুর পট পট করে চোখে দুটো পলক ফেলল। “খুবই দামি কথা বলছ! সত্যকথা। বাসররাতের স্বপ্ন আমিও দেখছি। সেইটা তো এইভাবে নষ্ট করা ঠিক হবে না। না না, নষ্ট আমি করব না। কথা দিলাম। তবে রাতটা আমরা একসঙ্গে কাটাব। তোমার মা দুইজনের খাবার রাইখা গেছে। আমরা একসঙ্গে খাওয়া-দাওয়া করব আর গল্প করব। তোমার বডিতে হাত দিব না। আমি এক কথার মানুষ।”                [চলবে]

সর্বশেষ খবর