গল্প
ডাক্তার রুমার জীবনে অবসর বলে কিছুই নেই। সাতসকালে ঘুম থকে উঠে কোনোক্রমে একটু গুছিয়ে দৌড় দেন হাসপাতালে। অধিকাংশ দিন খেয়ে যাওয়ার সময় পান না। বাসায় গৃহকর্মী একজন আছে। সে ঠিকই সকালে উঠে নাশতা বানিয়ে রাখে। কিন্তু রুমার খাওয়ার সময় হয় না। ভ্যানিটি ব্যাগটা হাতে নিলেই ছুটে আসে গৃহকর্মী।
: কী হলো না খেয়েই বেরোনোর ব্যাগ হাতে নিচ্ছেন যে। খেয়ে নেন। টেবিলে নাশতা দেওয়া আছে।
: না রে সময় নেই। বাইরে কিছু খেয়ে নেব।
কথা শেষ না করেই দৌড় লাগান। ওর পিছু পিছু ছোটে প্রমা।
: খেয়ে যাও মা, খেয়ে যাও প্লিজ। একা একা খেতে ভালো লাগে না।
যেতে যেতে রুমা বলেন,
: তুই খেয়ে নে, মা। কাল আমি তোর সঙ্গে খেয়ে নেব ঠিকই।
প্রমা জানে এই ‘কাল’ কখনই আসবে না তার জীবনে। কখনই একসঙ্গে খাওয়া হবে না। এ কথা সে বহুবার শুনেছে।
প্রমা মুখ ভার করে খানিকক্ষণ ঘোরে। ওর চোখের কোণে পানি জমা হয়। মাকে আর জীবনে সে পেল কখন! মার কাছে তার রোগীরাই বড়। ওরাই যেন মায়ের আপন। ওদের নিয়েই মায়ের জীবন।
এ অভিমান প্রমার অনেক দিনের। এখন সে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। মার খুবই ইচ্ছে ছিল প্রমা তার মতো ডাক্তার হোক। কিন্তু প্রমা ভর্তির পরীক্ষাই দেয়নি। সে চায়নি একজন বড় ডাক্তার হয়ে নিজের পারিবারিক জীবন ধ্বংস করতে। এ নিয়ে মায়ের মনে খানিকটা কষ্ট। প্রমার একবিন্দুও নেই। ছেলেবেলা থেকে ও দেখছে মা দৌড়াচ্ছেন। সকালে হাসপাতালে যাচ্ছেন, সেখান থেকে চেম্বার। এক চেম্বার ছেড়ে আরেক চেম্বার। বাসায় যে ছোট্ট একটা মেয়ে আছে, সে মেয়েটা তাকে চায়, কখনই তা মনে হয়নি মায়ের। প্রমা বড় হয়েছে কাজের মেয়েদের হাতে। একজন গেলে আরেকজন এসেছে। বাবাকে সে পায়নি। বড় হয়ে শুনেছে দুর্দান্ত প্রেম করে নাকি বিয়ে করেছিলেন বাবা-মা। কিন্তু বেশি দিন সংসার টেকেনি। প্রমার জন্মের দুই বছরের মাথাতেই নাকি তাদের বিচ্ছেদ। বাবার এখন আরেক সংসার আছে। কেন তাদের বিচ্ছেদ হলো কেউ বলেনি তাকে। তবে প্রমার ধারণা, মার অতিরিক্ত ক্যারিয়ার বাতিকের জন্যই এটা হয়েছে।
বিয়ে করলেও বাবা তো মাঝে মাঝে মেয়েকে দেখতে আসতে পারেন। এমনই তো হয়। প্রমার দুজন বন্ধুর বাবা-মার ডিভোর্স হয়েছে। কিন্তু ওদের বাবারা তো ঠিকই মেয়েদের দেখতে আসেন। বেড়াতে নিয়ে যান, এটা ওটা গিফট করেন। প্রমার জীবনে সেটাও নেই। নাকি বাবা আসতে চান, মা-ই তাকে আসতে দেন না। কে জানে!
মাকে প্রচণ্ড ভালোবাসে প্রমা। অনেকবার বিভিন্নভাবে সে কথা মাকে বলেছে সে। মাকে নিয়েই যে তার জীবন। কিন্তু মা কি তার কথা ভাবেন! চেম্বার থেকে এসেও যেন মায়ের ক্লান্তি নেই। গভীর রাত পর্যন্ত রোগীদের সঙ্গে কথা বলা, মেডিকেল পারসনদের সঙ্গে যোগাযোগ, বিদেশে যোগাযোগ- এসব নিয়েই থাকেন মা। সেখানে প্রমার জায়গা কোথায়?
মা তার খবর একেবারেই নেন না এমনটা বলতে পারবে না প্রমা। কখনোসখনো চেম্বার বা হাসপাতাল থেকে ফোন করে জিজ্ঞাসা করেন,
: খেয়েছ তো? দুপুরে ঘুমিয়েছিলে ঠিকমতো?
এসব ছোটবেলার ব্যাপার। বড় হওয়ার পর মায়ের দায়িত্ব যেন আরও কমে গেছে। কালেভদ্রে কখনো-সখনো প্রশ্ন করেন,
: তোমার পড়াশোনা কেমন চলছে? কোন সেমিস্টার যেন এবার?
প্রমার ধারণা, সে কি পড়ে আর কোথায় পড়ে তাও বোধহয় মা ঠিকমতো জানেন না।
ভার্সিটি থেকে আসার পর একদম একা হয়ে যায় প্রমা। রাত সাড়ে এগারো-বারোটার আগে মা ফেরেন না। খালা সাড়ে ছয়টা থেকে সিরিয়াল দেখতে বসে যায়। দশটা নাগাদ ড্রইংরুমেই ঘুমে ঢলে পড়ে। মা এসে তাকে উঠিয়ে ঘুমাতে পাঠান। এই এত বড় বাড়িটাতে প্রমার দম বন্ধ লাগে। লোক নেই, জন নেই, এত বড় বাড়ি কেনার দরকার কী ছিল! মার সবেতেই বাড়াবাড়ি।
সেদিন ভার্সিটিতে পিছু ডাকল একটা ছেলে। প্রমার সঙ্গেই পড়ে সে, ভিন্ন সাবজেক্টে। ছেলেটাকে আগেও দেখেছে প্রমা। দেখতে শুনতে বেশ। বন্ধুরা বলছিল, মেয়েরা নাকি ওকে দেখে ক্রাশ খায়। ওকে দেখে সে কথা মনে হতেই হাসি পেয়ে গিয়েছিল প্রমার। ছেলেটি তা দেখে বলেছিল,
: হাই! আমি শাহেদ, হাসছ কেন?
: আমি প্রমা
: হাসছ কেন?
: না মানে
: না মানে কী? বলে ফেল ঝটপট? ছেলেটা খুব সপ্রতিভ।
: বন্ধুরা বলছিল, মেয়েরা নাকি তোমাকে দেখে ক্রাশ খায়।
হো হো করে হেসেছিল শাহেদ। ওর দিকে পরিপূর্ণ দুচোখে মেলে বলেছিল,
: তুমি খাও না?
কী কাণ্ড, এভাবে কেউ তাকায় নাকি? প্রমার অন্তর্মূল পর্যন্ত কেঁপে উঠেছিল। হ্যাঁ-না কিছুই বলেনি।
ওদের প্রেম হয়ে গিয়েছিল ভালো করে দুজনকে জানার আগেই। শাহেদ জেনে গিয়েছিল প্রমার দুর্বল জায়গা। ও বড় একা, মা ব্যস্ত, বাবা নেই। ও কারও সঙ্গ চায়। সেই সঙ্গী হয়েছিল শাহেদ। সর্বক্ষণের সঙ্গী। কখনো বাসায়, কখনো বাইরে। প্রমার লেখাপড়া মাথায় উঠেছিল।
প্রমা খুব খুশি ছিল। এই প্রথম কেউ তার সার্বক্ষণিক খোঁজখবর নিচ্ছে। তার ভালোমন্দে পাশে দাঁড়াচ্ছে। তার পছন্দের খাবার, পছন্দের পোশাক এনে দিচ্ছে। দূরে থেকেও যেন কত কাছে আছে সারাক্ষণ।
কিন্তু মাকে বলার সুযোগ পায়নি সে। যখনই বলতে গেছে মায়ের ব্যস্ততা দেখে ফিরে এসেছে। বলা হয়ে ওঠেনি। একসময় মনে হয়েছে, থাক মার জানার দরকার নেই। মার যখন কোনো আগ্রহই নেই তার ব্যাপারে। মা ভেবেছেন, অফুরন্ত টাকা মেয়ের হাতে দিলেই বুঝি সব দেওয়া হয়ে যায়। বোকা মা জানতেও পারলেন না, টাকা দিয়ে ভালোবাসা পাওয়া যায় না।
কিন্তু টাকা দিলে ভালোবাসা পাওয়া যায়, এ বিশ্বাসে বিশ্বাসী শাহেদ। সম্পর্কের শুরুতেই সে প্রমাকে জানিয়েছিল, তাদের মধ্যে পার্থক্যের কথা। শাহেদের বাবা দরিদ্র, টাকা নেই। অনেক কষ্টে ছেলেকে পড়াচ্ছেন। কাজেই প্রমার মা কিছুতেই রাজি হবেন না। এই আশঙ্কা হেসে উড়িয়ে দিয়েছিল প্রমা।
: ওটা নিয়ে ভেবো না। আমার ওটা বিস্তর আছে। আমার নামেই প্রচুর ব্যাংক ব্যালেন্স।
: সে টাকা তো তোমার। আমার ওতে অধিকার নেই।
: কী যে বলো, এমন করে বললে আমি কষ্ট পাব। তোমার আমার বলে কিছু নেই, আমাদের।
শাহেদের লাইফস্টাইল বদলে গিয়েছিল। পকেটে মোটা মানিব্যাগে চকচকে নোটের সম্ভার। প্রতিদিন দেখা হলেই কিছু না কিছু গিফট দিত প্রমা। নিয়মিত টাকা দিত। বুদ্ধিমান শাহেদ কইয়ের তেলে কই ভাজত। সে টাকা থেকেই প্রমার জন্য এটা ওটা কিনে আনত। তাতে খুশি হয়ে প্রমা দুহাতে ঢেলে দিত। আর শাহেদও তাড়িয়ে তাড়িয়ে আস্বাদ করছিল টাকা আর নারী শরীরের উত্তাপ।
তারপর একদিন এক বর্ষণমুখর সন্ধ্যায় ওরা একাকার হলো। প্রমার খানিকটা ভয় সংকোচ দ্বিধা ছিল। শাহেদ ভালোবাসার তীব্রতায় সব দ্বিধা উড়িয়ে দিল। ওরা দুর্বার হলো। এ চাহিদা যে কোনো চাহিদার চেয়ে মারাত্মক। একবার ঘটলে বারবার ঘটতে থাকে। সেটাই ঘটল।
২
প্রমাকে নিয়ে নিশ্চিন্ত ছিলেন রুমা। প্রমা খুবই ভদ্র বিনয়ী আর বুদ্ধিমান মেয়ে। ও অল্প বয়সেই অনেক ম্যাচিউরড। পড়াশোনায় ভালো। নিয়মিত ভার্সিটিতে যায়, ক্লাস করে। গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিট করলে ওকে মাস্টার্স করতে বিদেশের কোনো নামি বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠিয়ে দেবেন রুমা। প্রমাই যে ওর একমাত্র অবলম্বন। প্রমার বাবা চলে গিয়েছিলেন একেবারেই অকারণে। রুমার সাফল্য তিনি সহ্য করতে পারেননি। রুমার ক্রমাগত ওপরে ওঠা তাকে ক্রোধে উন্মত্ত করে ফেলেছিল। রুমা অনেক চেষ্টা করেছিলেন মানিয়ে চলতে। হয়নি। দুই মাসের বাচ্চাকে ফেলে চলে গিয়েছিলেন তিনি। এরপর একটি দিনের জন্যও মেয়ের খবর নেননি। তারপর তো বিয়ে করলেন। সন্তানদের নিয়ে দিব্বি আছেন। তার যে একটা মেয়ে আছে, এ কথা বোধহয় ভুলেও মনে পড়ে না তার। রুমা বোঝেন, প্রমার মনে পিতার অভাববোধ আছে। সব সন্তানেরই থাকে। রুমা অনেক চেষ্টা করেছিলেন যোগাযোগ করতে, যাতে মাঝে মাঝে মেয়েটাকে দেখে যায়। ফোনই তোলেননি।
প্রমাকে অনেক কষ্টে মানুষ করেছেন রুমা। ও যখন ছোট ছিল ঠিকমতো হাসপাতালে যেতে পারেননি। ওকে সঙ্গে নিয়ে কাজের মেয়েসহ হাসপাতালে গিয়ে অনেক কটূক্তি আর বসের বকুনি শুনেছেন দিনের পর দিন। প্রথম প্রথম ও যখন স্কুলে ভর্তি হয় তখন ওকে স্কুল থেকে আনতে যেতেন রুমা। সেটা নিয়েও অনেক সমস্যা হয়েছে। এখন মেয়ে বড় হয়ে গেছে, আর সমস্যা নেই। হ্যাঁ, প্রমাকে তিনি যথেষ্ট সময় দিতে পারেন না। একসঙ্গে খেতে পারেন না, ওকে নিয়ে বেড়াতে যেতে পারেন না। রুমা মনে মনে ঠিক করেছেন, তিনি ব্যস্ততা কমিয়ে আনবেন। মেয়েকে সময় দেবেন। অনেক দিন ধরে চেষ্টা করছেন, পারছেন না। সমস্যা হচ্ছে তিনি ছেড়ে দিতে চাইলেও রোগীরা তাকে ছাড়েন না। ভালো গাইনোকোলজিস্ট হিসেবে তার সুনাম আছে। রোগীদের প্রতিও তার দায়িত্ব আছে ডাক্তার হিসেবে। প্রমা নিশ্চয়ই তা বোঝে। প্রমা তার সোনা মেয়ে। কদিন ধরে প্রমা কী যেন বলতে চাইছে। শোনা হয়ে ওঠেনি। শুনতে হবে।
দুই মাস পর প্রমা চমকে উঠল। নিয়মিত ঋতুস্রাব হলো না তার। শাহেদকে জানাল। দুজনে গিয়ে প্রেগন্যান্সি টেস্ট করে কনফার্ম হওয়ার পর প্রমা বলল,
: চলো আমরা বিয়ে করে নিই। মাকে বলি।
: বলছ কী তুমি! আমরা ছাত্র। বাচ্চাটাকে ফেলে দাও।
কথাটা কানে লাগল প্রমার। ঠিক যেভাবে তাকে ফেলে তার বাবা চলে গিয়েছিলেন, শাহেদও যেন সেভাবে বাচ্চাটাকে ফেলে দিতে চাইছে। অবাক হয়ে তাকাল,
: বলছ কী?
: ঠিকই বলছি, তোমার মা ডাক্তার। এসব তো তোমাদের জন্য ডাল-ভাত
যেন প্রতিদিন এমন দু-একটা ফেলে দিচ্ছে সে আর তার মা মিলে।
: এসব কী কথা। আজই মাকে বলি, মা ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যে বাধা দেন না। বিয়েতে বাধা দেবেন না।
: তোমার মা বাধা না দিলেই কী, আমার বাধা আছে। তাছাড়া এটা যে আমার তার নিশ্চয়তা কী?
অবাক প্রমার চোখের সামনে থেকে দ্রুত চলে গিয়েছিল শাহেদ। ফেরেনি। মা ফিরে এলে তার কাছাকাছি অনেকক্ষণ ঘোরাঘুরি করেছিল প্রমা। মার কী যেন একটা জরুরি কাগজ হারিয়ে গিয়েছিল। সেটা নিয়ে মা ছিলেন ব্যতিব্যস্ত। তার মধ্যেও প্রমা বলেছিল,
: মা তোমাকে একটা জরুরি কথা বলার আছে এখনই
: কাল বলো, দেখছ তো আমার অবস্থা।
৩
পরদিন হাসপাতালে গিয়ে বরাবরের মতো ফোন সাইলেন্ট করেছিলেন রুমা। রোগী দেখার সময় ফোন বাজলে তার মনোযোগ নষ্ট হয়। রোগীদের সময় পুরোটাই ওদের। বেলা দেড়টা পর্যন্ত একটানা রোগী দেখে রুমে এসে মোবাইলের দিকে তাকিয়ে চমকে ওঠেন রুমা। প্রমার এগারোটা মিসকল। সঙ্গে সঙ্গে ফোন করেন রুমা। বারবার ফোন করেন। ফোন বেজে যায়।
প্রমা ধরে না। প্রমা আর কোনো দিন রুমার ফোন ধরেনি। সুইসাইড করেছিল প্রমা। মরার আগে শেষবারের মতো মাকে চেয়েছিল, পায়নি।
রুমা আজও একমনে রোগী দেখে আর প্রতিটা রোগীর মুখে খোঁজে প্রমার মুখ।