শনিবার, ৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ ০০:০০ টা
মূল রচনা

জীবনযুদ্ধে সফল ডাক্তার শিউলি

কাজী শাহেদ, রাজশাহী

জীবনযুদ্ধে সফল ডাক্তার শিউলি

ছোটবেলা থেকেই প্রচণ্ড মেধাবী ছিলেন শিউলি। পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণিতে বৃত্তিও পেয়েছিলেন। সেই বৃত্তির টাকা দিয়ে পড়াশোনাটা চালাচ্ছিলেন। কিন্তু বাবা-মায়ের অভাব অনটনের সংসারে কন্যাসন্তান বড়ই বোঝা হয়েছিল। এ কারণে নবম শ্রেণিতে পড়ার সময় পদার্থবিজ্ঞান পরীক্ষার আগের দিন রাতে হঠাৎ তার বিয়ে দিয়ে দেয় পরিবার।

ভেবেছিলেন এখানেই সবকিছু শেষ। কিন্তু না। ছোটবেলার এক জেদ শিউলির মনে তাড়না দেয়, যেভাবেই হোক পড়াশোনা চালিয়ে যেতে হবে। বড় হয়ে ডাক্তার হতে হবে। শিউলির সেই স্বপ্ন পূরণ হওয়ার পথে। এরই মধ্যে এমবিবিএস শেষ করেছেন তিনি। গত ১ ফেব্রুয়ারি শুরু হয়েছে তার ইন্টার্নশিপ। ছোটবেলার পরিবারের অভাব-অনটন, অল্প বয়সে বিয়ে, শ্বশুরবাড়ির নানান বাধা ও সন্তান পরিবার সামলিয়ে কীভাবে ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন পূরণ হচ্ছে সেই গল্প শোনাচ্ছিলেন শিউলি। তিনি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, স্বামী রাশেদুর রহমানকে নিয়ে রাজশাহী নগরীর মেহেরচণ্ডী মধ্যপাড়া এলাকায় একটি ভাড়া বাসায় থাকেন। শিউলির মা সাবিয়া বেগমও মেয়ের সঙ্গেই থাকেন।

এটা তার জীবনের সবচেয়ে হতাশার সময়। তীরে এসে তরী ডুবে যাওয়ার মতো দশা। নিজেরা কিছুই করতে পারছেন না।  স্বামীর বেতনটা শুধু দেড় হাজার থেকে বেড়ে ৩ হাজার ৬০০ টাকা হয়েছে।

শিউলি জানালেন, তার বাবার বাড়ি রাজশাহীর চারঘাট উপজেলার মোক্তারপুর খলিফাপাড়া গ্রামে। সরদহ ট্রাফিক মোড়ে তার বাবার একটি চায়ের দোকান ছিল। এটিই ছিল তাদের পরিবারের আয়ের একমাত্র উৎস। কিন্তু একমাত্র আয়ের উৎস সেই চায়ের দোকানটিও একসময় পুড়িয়ে দেয় দুর্বৃত্তরা। তার শিক্ষাজীবনের শুরুই হয়েছে যেন অবহেলার মধ্য দিয়ে। পড়ার জন্য এক শিক্ষকের বাসায় গিয়েছিলেন। সেখানে তার মাকে একটি ভাঙা চেয়ারে বসতে দেওয়া হয়েছিল। অন্যদের বসানো হয়েছিল ভালো জায়গায়। তার শিশুমনে এটি তখন দাগ কেটেছিল। তখন থেকেই তার জেদ, যে কোনো মূল্যে পড়াশোনা চালিয়ে যাবেন। কিন্তু অভাবের সঙ্গে দৈনিক তাকে যুদ্ধ করতে হয়েছে। ভাঙা ঘরে বৃষ্টির রাতে ঘুমানো যেত না। না খেয়েও স্কুলে যেতে হয়েছে। পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণির বৃত্তির টাকা দিয়েই পড়ার খরচ চালাতে হয়েছে। এসএসসি পাস স্বামী তখন একটি বাল্ব কোম্পানিতে চাকরি করতেন। দশম শ্রেণিতে পড়ার সময় স্বামীর সেই চাকরিটাও চলে গেল। এসবের মধ্যেই ২০১১ সালে সরদহ সরকারি পাইলট উচ্চবিদ্যালয় থেকে এসএসসি পরীক্ষায় সব বিষয়ে শিউলি পেলেন জিপিএ-৫।

শিউলি আক্তার বলেন, রাজশাহী কলেজে ভর্তির সুযোগ পাওয়ার পরও যাতায়াত খরচের টাকার কথা ভেবে সেখানে তিনি ভর্তি হননি। শ্বশুরবাড়ির কাছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় স্কুল ও কলেজে ভর্তি হলেন। তখন তার স্বামী রাশেদুর রহমান বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষতে (বিএমডিএ) চাকরি করতেন। বেতন পেতেন মাসে দেড় হাজার টাকা। এ সময় শ্বশুরবাড়ির লোকজনের বাধার মুখে শিউলির পড়াশোনা বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়। তারা বাড়ির বউকে পড়াশোনা করতে দিতে চাচ্ছিলেন না। পড়াশোনা বন্ধ করতে সব ধরনের বন্দোবস্ত করে শ্বশুরবাড়ির লোকজন। এমনকি ছেলের বউয়ের ভাত বন্ধ করে দেওয়ার মতো নিষ্ঠুর আচরণও করা হয়। শিউলি জানান, ২০১৩ সালের এইচএসসি পরীক্ষায় তিনি অংশগ্রহণ করেন। সেবারও সব বিষয়ে এ-প্লাস পান। তখন তার কাছে ছোটবেলার স্বপ্ন পূরণের হাতছানি। স্বামীর স্বল্প বেতনের টাকায় কিনে দেওয়া মেডিকেল প্রস্তুতির বই পড়া শুরু করেন তিনি। পরিবার সামলিয়ে রাতদিন পড়াশোনা চালিয়ে গেলেন। ২০১৩ সালে মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন। কিন্তু সেবার উত্তীর্ণ হতে পারেননি। প্রথমবার ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে উত্তীর্ণ হতে না পারায় তিনি অনেক কষ্ট পেয়েছিলেন। কিন্তু সেবারও তার পাশে থাকেন স্বামী রাশেদুর। স্বামীর অনুপ্রেরণায় ভর্তি প্রস্তুতি চালিয়ে যান।

২০১৪ সালে দ্বিতীয়বার অল্প নম্বরের জন্য বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তির সুযোগ পান। এইচএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশের পর স্থানীয় একটি পত্রিকায় খবর হয়েছিল ‘অর্থের অভাবে কি শিউলি ফুটবে না?’। এ খবর শুনে অনেকেই ছুটে গেলেন। কিন্তু বিবাহিত মেয়ের কথা শুনে পরে কেউ সাড়া দেননি।

শিউলি আক্তার বলেন, এটা তার জীবনের সবচেয়ে হতাশার সময়। তীরে এসে তরী ডুবে যাওয়ার মতো দশা। নিজেরা কিছুই করতে পারছেন না। স্বামীর বেতনটা শুধু দেড় হাজার থেকে বেড়ে ৩ হাজার ৬০০ টাকা হয়েছে। এমন সময় এক দিন বারিন্দ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. শামসুদ্দিন শিউলির খবর নেওয়ার জন্য গাড়ি পাঠালেন। সব শুনে শামসুদ্দিনই তাকে বারিন্দ মেডিকেল কলেজে ভর্তির ব্যবস্থা করে দিলেন। শুধু ভর্তি নয়, শিউলির পড়াশোনার খরচের (প্রায় ৩০ লাখ টাকা) পুরো দায়িত্ব নিলেন তিনি। পড়াশোনার বাইরেও বাসার বাজার, টুকটাক দরকারি জিনিসপত্র নিয়মিত কিনে দিয়েছেন। মেডিকেল কলেজে ভর্তির পরই ২০১৫ সালের ৭ জুন ছেলেসন্তানের জন্ম দেন শিউলি। ১৫ দিন পর থেকেই পেটে বেল্ট বেঁধে ক্লাসে যাওয়া শুরু করেন শিউলি। একটাই লক্ষ্য, ডাক্তারি পড়া শেষ করতেই হবে।

২০১৬ সালে এমডি মো. শামসুদ্দিন তার স্বামীকে এই মেডিকেল কলেজে চাকরি দিলেন। কর্মচারীর স্ত্রী বলে ব্যাচের কেউ স্টাডি গ্রুপে নেয়নি। প্রথম বেঞ্চে বসলে সে বেঞ্চে আর কেউ বসতেন না। পেছনে গেলেও একাই বসতে হতো। ক্যান্টিনেও একই অবস্থা হতো। এমনও দিন গেছে সহপাঠীদের মানসিক নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে কাঁদতে কাঁদতে এমডির কাছে গেছেন। এমডি তাকে সান্ত্বনা দিয়েছেন, উৎসাহ দিয়েছেন।

গত ১ ফেব্রুয়ারি থেকে শিউলির ইন্টার্নশিপ শুরু হয়েছে। এরই মধ্যে শিউলির স্বামীও বিএ পরীক্ষা দিয়েছেন। শিউলির ইচ্ছা স্বামীর এমএ ডিগ্রি হওয়ার পর তাকে একটা ওষুধের দোকান করে দেবেন। আর পুরোপুরি ডাক্তার হওয়ার পর মানুষের সেবায় নিজেকে সঁপে দেবেন। নিজে যেমন কষ্ট পেয়ে বড় হয়েছেন, সেই রকম কষ্টে থাকা মানুষের জন্য কিছু করতে চান। ভেবেছেন, গরিব ও অসহায় মানুষের সেবা দেবেন বিনামূল্যে। যেভাবে তার পাশে দাঁড়িয়েছেন একজন মানুষ।  বারিন্দ মেডিকেল কলেজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. শামসুদ্দিন জানান, তার ছেলে (পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম) প্রথমে শিউলির খবরটি পায়। সে তাকে শিউলি সম্পর্কে খোঁজ নিতে বলে। এর পরই তিনি খোঁজ নিয়ে শিউলির পাশে দাঁড়িয়েছেন। টাকার অভাবে এমন একজন মেধাবীর পড়াশোনা বন্ধ যাতে না হয়, সে জন্য তিনি সবসময় লক্ষ্য রেখেছেন।

সর্বশেষ খবর