সারাহ ইসলাম (ঐশ্বর্য) এক আলোকিত নাম। ২০ বছরের মেধাবী এই তরুণী ১৮ জানুয়ারি পৃথিবীর মায়া ছেড়ে চলে গেছেন। অন্যের জীবনে আলো ছড়িয়ে মরেও অমর হয়ে থাকলেন সারাহ। মৃত্যুর আগে নিজেই স্বজনদের কাছে পুরো দেহ দান করার ইচ্ছা জানিয়েছেন মানবতার কল্যাণে ও গবেষণায়। তার চোখ দিয়ে এখন পৃথিবীর আলো দেখছেন দুজন। তার কিডনি দিয়ে সুস্থ আছেন আরও দুই ব্যক্তি। সদ্য কন্যা হারানোর অতল শোকের মাঝেও বাংলাদেশ প্রতিদিনের সঙ্গে গতকাল কথা বলেছেন প্রয়াত সারাহর মা শবনম সুলতানা। এ সময় বারবার গলা জড়িয়ে যাচ্ছিল তার। শবনম সুলতানা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘১০ মাস বয়সে সারাহর ‘টিউবেরাস স্কেলেরোসিস’ রোগ শনাক্ত হয়। তখন থেকে জ্বরের সঙ্গে তার খিঁচুনি হতো। মাঝে মাঝে সে জ্ঞান হারাত। তারপর ধরা পড়ল তার ব্রেনে ও অন্য অর্গানেও টিউমার, যেটি ক্যান্সার ছিল না। ছোটবেলায় তাকে পড়াশোনার জন্য চাপ দিতাম না। সে স্কুলে আসত যেত এটুকুই। তাকে কিশোর আলোতে দিলাম। এ ছাড়া বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন যেমন বেঙ্গল বই, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে নিজ থেকেই যেত সে। আস্তে আস্তে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হতে থাকে। যেখানেই যেত চর্চা করত। একাডেমিক পড়ার চেয়ে সারাহ বাইরের বিভিন্ন সাহিত্যিক ও লেখকের বই পড়তে পছন্দ করত। সে নারী আন্দোলন, সড়ক আন্দোলনে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করত। সে ওখানে নেতৃত্ব দিত।’
মেয়ের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে এই শিক্ষক ও নারী উদ্যোক্তা বলেন, ‘সারাহ ছিল অনেক দানশীল। তার খরচের টাকা বাঁচিয়ে সে পথশিশুদের, বয়স্ক মানুষদের খাবার কিনে দিত। দেখা যেত রিকশা চালকদের সে সবসময় বাড়তি ভাড়া দিত।’
মানব কল্যাণের চেয়ে বড় ধর্ম আর কিছু নেই
- প্রয়াত সারাহর মা শবনম সুলতানা
আক্ষেপের সুরে শবনম সুলতানা বলেন, ‘চিকিৎসাবিজ্ঞানে তার এই রোগের শেষ কোথায় তা জানতে পারিনি। এটা আমার সারা জীবনের আফসোস। এর চিকিৎসা কীভাবে, তাকে সারিয়ে তুলব কীভাবে এর সদুত্তর কেউ দিতে পারেনি। এর পরও ডাক্তারদের সহযোগিতায় সব ম্যানেজ করে যেতাম। আর কিছুই করতে পারিনি। এটাই আমার আফসোস- কেন এর চিকিৎসা আবিষ্কৃত হয়নি। চিকিৎসাশাস্ত্রে বিরল এই রোগের অগ্রসরতা এখনো হয়নি। এখন হয়তো সারার মাধ্যমে এই রোগের চিকিৎসা হবে। এখন অনেকেই এগিয়ে আসবেন বলে বিশ্বাস। এটি একটি আলোড়ন সৃষ্টিকারী মৃত্যু; যা নিয়ে অনেক বেশি গবেষণা হবে।’ সারাহ ইসলামের শেষ দিনগুলো সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘হাসপাতালের বেডে থাকাকালে তার সঙ্গে অনেক কথাই হতো। সে তার দানের কথা বলত, চলে যাওয়ার কথাও বলত আবার সুস্থ হয়ে এসে সে কী করবে, কোথায় যাবে, আরও কী করবে এসব বলত। বড় কার্টুনিস্ট হওয়ার স্বপ্ন ছিল তার। জাপানে পড়তে যাবে। সে ডিজিটাল আর্ট নিয়ে পড়তে চেয়েছে। সফল একজন কার্টুনিস্ট হতে চেয়েছিল। সে জাপানে যেতে চাইত কারণ সেখানেও ‘টিউবেরাস স্কেলেরোসিস’ রোগী আছে। ব্রেন ডেথের পর ক্যাডাভেরিক হিসেবে তার অঙ্গগুলো দান করা হয়েছিল। সে মুখে বলে গেছে, মৃত্যুর পর তার ব্রেন দান করার কথা। বন্ধুদের কাছে অন্যান্য অর্গান দানের কথাও বলত।’
শবনম সুলতানা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, মৃত্যুপথযাত্রী সন্তানকে বুকে নিয়ে বয়ে চলার চেয়ে কষ্টের আর কিছু হতে পারে না। তার মধ্যে ছোটবেলা থেকে দানশীলতা, অন্যের জন্য কল্যাণ, ভালোবাসা ছিল। এর বদৌলতে অঙ্গদানের বিষয়ে চিকিৎসকদের প্রস্তাবে রাজি হয়ে যাই। তার ব্রেন ডেথ হওয়ার পর গুরুত্বপূর্ণ এ সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে।
অন্যান্য মা-বাবার উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘বাচ্চাদের সঠিকভাবে বেড়ে ওঠার সুযোগ দিতে হবে। অভিভাবকত্ব মানে শাসন নয়। অভিভাবকত্ব মানে তাকে ধরে বেঁধে একখানে আটকে রাখা নয়। ছেড়ে দিতে হবে বাচ্চাদের। সন্তানকে তার মতো স্বাধীনভাবে চলতে দেওয়া উচিত। মুক্তভাবে বেড়ে উঠতে দিতে হবে তাদের। সেই সময়-সুযোগ দিতে হবে। সারাহর সঙ্গে আমার সব সময় ফোনে যোগাযোগ হতো। সে জানাত কখন বেঙ্গলে যাচ্ছে, শিল্পকলা একাডেমি কিংবা বিশ্ব সাহিত্যকেন্দ্রে যাচ্ছে। তাকে ছোটবেলা থেকেই এই পরিবেশ দিয়েছি। যেহেতু আমি নিজেও সংগঠন করেছি। মানুষের কল্যাণের কথা চিন্তা না করলে কোনো মা এমন সিদ্ধান্ত নিতে পারে কি না আমার জানা নেই। এটি তো তারই ধারাবাহিকতা।’
তিনি আরও বলেন, আমি একজন শিক্ষক ও নারী উদ্যোক্তা। সেটি ছাপিয়ে আমি সারার মা হতে পেরেছি। এটি আমার জন্য গর্বের।
সবশেষ সারাহ ইসলামের নামে একটি সড়কের নামকরণ করার দাবি জানান তিনি। কারণ নিরাপদ সড়ক আন্দোলনেও সে নেতৃত্ব দিয়েছিল।
অঙ্গদান প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘মরণোত্তর অঙ্গদান নিয়ে প্রচলিত ভুল ধারণা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। আমরা যত দিন বাঁচব, সাহসের সঙ্গে বাঁচব। তার আগে যেন মানব কল্যাণের জন্য কিছু করে যেতে পারি। সেই মৃত্যুই তো মহান, শহীদি মৃত্যু হয়, বীরের মৃত্যু হয়।’