মঙ্গলবার, ১৫ মার্চ, ২০১৬ ০০:০০ টা

ঘটি-বাঙাল দ্বন্দ্ব

সুখরঞ্জন দাশগুপ্ত

ঘটি-বাঙাল দ্বন্দ্ব

প্রজাতন্ত্র দিবস খায় না মাথায় দেয় সেটা বোঝার মতো বয়স তখনো হয়নি, কিন্তু ওপার বাংলা থেকে এপারে আসার পর প্রথম যে দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের সঙ্গে পরিচয় হয় সেটা হলো ঘটি-বাঙালের দ্বন্দ্ব। সেই প্রজাতন্ত্রের ৬৭তম বর্ষপূর্তি হয়ে গেল ২৬ জানুয়ারি। প্রজাতন্ত্রে পূর্ব বাংলা থেকে আসা আমরা ছিলাম বাঙাল। আর কলকাতার আদি বাসিন্দারা ছিলেন ঘটি। স্কুল, কলেজ, রাস্তাঘাট, বাজার সর্বত্র আমাদের শুনতে হতো বাঙাল। আর তা বেশ তাচ্ছিল্যের সুরেই। আমাদের কখনো রিফিউজি, কখনো উদ্বাস্তু, আবার কখনো শরণার্থী বলে ডাকা হতো। কথাবার্তাও ছিল আলাদা আলাদা। পশ্চিমবঙ্গবাসী বলতেন খেয়েচি, গিয়েচি... , আর আমরা বলতাম খাইসি, যাইসি। গোড়ায় গোড়ায় পূর্ব বাংলা থেকে আসা বাঙালরা বাড়ি ভাড়াও পেতেন না। ঘটি বাড়িওয়ালারা বলতেন, বাঙালদের বাড়ি ভাড়া দেব না।

দেশভাগের আগে অবিভক্ত বাংলায় দুটি বিশ্ববিদ্যালয় ছিল। কলকাতা আর ঢাকায়। নেপাল, শ্রীলঙ্কা, বার্মা ছিল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে। তবুও পশ্চিমবঙ্গে জনভিত্তিক পড়াশোনার মান খুব ভালো ছিল না। গ্রামে গ্রামে স্কুল-কলেজ ছিল না। অষ্টম শ্রেণির বেশি পড়াশোনা খুব একটা হতো না। অনেকেই তারপর রেল বা মার্চেন্ট নেভির চাকরিতে যোগ দিতেন। ঘটিদের খাওয়া-দাওয়া বলতে ছিল তেলেভাজা, মিষ্টি কুমড়ার ছক্কা আর রুটি। এই পশ্চিমবঙ্গেই জন্মেছিলেন রাজা রামমোহন, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, বিবেকানন্দ, শরত্চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের মতো গুণীজনেরা। স্বক্ষেত্রে এরা দিকপাল হলেও পশ্চিমবঙ্গের গ্রামাঞ্চলে খুব একটা প্রভাব পড়েনি। একমাত্র রাজা রামমোহনের সতীদাহ প্রথা বিলোপ বা বিদ্যাসাগরের বিধবা বিবাহ প্রবর্তন ভালো সাড়া ফেলেছিল। এর বাইরে এই গুণীজনদের প্রতিভার আলো গ্রামান্তর পর্যন্ত ছড়াতে পারেনি।

পশ্চিমবঙ্গের জমিদাররা তাদের জমিদারিতে ১০ ক্লাস পর্যন্ত স্কুল কিছু করেছিলেন। তবে উচ্চশিক্ষায় খুব একটা নজর তাদের ছিল না কখনোই।

পূর্ব পাকিস্তান থেকে শরণার্থীরা আসার পর থেকেই এপার বাংলায় উচ্চশিক্ষার প্রসার ঘটতে শুরু করে। যেসব শিক্ষক পূর্ব পাকিস্তান থেকে এসেছিলেন তারা কলকাতায় কেন্দ্রীভূত না হয়ে জেলায় জেলায় ছড়িয়ে পড়ে স্কুল গড়ে তুলেছিলেন। আজ সারা পশ্চিমবঙ্গে স্কুল-কলেজের রমরমার সেই শুরু। ১৯৫০ সালে পূর্ব পাকিস্তানের ঝালকাঠি থানার অধীন নারায়ণপুর স্কুলের প্রধান শিক্ষক নকুলেশ্বর গুপ্ত স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগ দিয়ে ৯ বছর জেল খাটেন। জেলে যে টাকা পেয়েছিলেন তা দিয়ে নারায়ণপুরে একটি স্কুল তৈরি করেন। এপার বাংলায় এসে কলকাতা থেকে ৩০ মাইল দূরে চম্পাহাটিতে একটি স্কুলে যোগ দেন। সেখানেও তিনি বাঙাল-ঘটির দ্বন্দ্ব উপলব্ধি করেন। বছরখানেক পরেই এই দ্বন্দ্বে তাকে স্কুল ছাড়তে হয়। এরপর হুগলী জেলার আরেকটি স্কুলে যোগ দেন। এরপর তিনি ঠিক করেন নিজেই একটা স্কুল তৈরি করবেন। বাঁশবেড়িয়াতে একটি স্কুল তৈরি করেন তিনি। রাস্তায় রাস্তায় চাঁদা তুলে, বন্ধুদের থেকে ধার নিয়ে স্কুলটি তৈরি করেন তিনি। সেই স্কুলটির সদ্য ৫০ বছর পূর্তি হয়েছে। পরে পাশে একটি মেয়েদের স্কুলও তৈরি করেন তিনি। শরণার্থীরা পশ্চিমবঙ্গের যেখানেই গেছেন, প্রথমে একটা স্কুল তৈরি করেছেন। যেখানে জনসংখ্যা বেশি সেখানে কলেজও করেছেন। শুনেছি বিধানচন্দ্র রায় যে ১৪ বছর এবং প্রফুল্লচন্দ্র সেন যে ৫ বছর মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন তারা বাঙালদের এই উদ্যোগকে সমর্থন করতেন। বাঙালদের মধ্যে একটা তেজী মনোভাব প্রথম থেকেই ছিল। আমরা এপারে এসে ফুটবলের ওপর জোর দিতে দেখেছি। একদিন খবরের কাগজে দেখলাম জয়ী দলের সমর্থকরা ইলিশ মাছ নিয়ে যাচ্ছে। আরেক দল জিতলে চিংড়ি মাছ নিয়ে যেত। মোহনবাগান আর ইস্টবেঙ্গলের প্রতিদ্বন্দ্বিতাই তখন ছিল বেশি।  ইস্টবেঙ্গলের সমর্থক ছিল বাঙালরা। মোহনবাগানের সমর্থক ছিল ঘটিরা। একটা মজার ঘটনা বলি। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর লিবারেশন সরকারের অন্যতম মন্ত্রী আবু হেনা কামারুজ্জামান ছিলেন মোহনবাগান সমর্থক। ঢাকায় বসেই তিনি রেডিওতে মোহনবাগানের খেলার ধারাবিবরণী শুনতেন। তিনি বঙ্গবন্ধু মন্ত্রিসভার সদস্য হিসেবে কলকাতায় একটি হোটেলে ওঠেন। সেখানে দেখি মোহনবাগানের কর্মকর্তারা তাকে সংবর্ধনা দিচ্ছেন। জিজ্ঞেস করাতে বললেন, মোহনবাগান ইস্টবেঙ্গলের খেলা হলেই তিনি এপারে চলে আসতেন খেলা দেখতে। তখন থেকেই তিনি মোহনবাগানের সদস্য। বাঙাল-ঘটির দ্বন্দ্ব থেকে গেছে অনেক দিন। এখন অবশ্য কে বাঙাল কে ঘটি বোঝা মুশকিল। বাঙালরা এখন ঘটিদের ভাষাতেই কথা বলেন। বাড়ির মা-ঠাকুরমারাই এখনো বাঙাল ভাষায় কথা বলেন। এবার একটু পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির দিকে তাকানো যাক। স্বাধীনতার পর থেকে পশ্চিমবঙ্গে কারা শাসন করেছে এবং কীভাবে শাসন করেছে। ১৯৪৭ থেকে ৬৭ পর্যন্ত টানা রাজত্ব করেছে কংগ্রেস। ১৬ বছর প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন জওহরলাল নেহরুর কাজ ছিল ভারী শিল্প, বিদেশি পুঁজি আনা, বিদেশনীতি তৈরি করাসহ নানা উন্নয়নের কাজ। দেশজুড়ে ভারী শিল্প তার আমলেই হয়েছে। এই শিল্প গড়ে তুলতে তিনি নীতিগতভাবে আমেরিকার কাছ থেকে সাহায্য নেন সোভিয়েত ইউনিয়ন, ব্রিটেন, জার্মানির মতো দেশগুলোর। আমেরিকানরা চাপ দিলেও নেহরু স্পষ্ট বলেছিলেন, আমি জোট নিরপেক্ষ দেশের প্রধানমন্ত্রী। আমি মার্কিনজোটে যোগ দেব না। তিনি গড়ে তুলেছিলেন পঞ্চশীল। মিসরের নাসের, যুগোস্লাভিয়ার মার্শাল টিটো, ইন্দোনেশিয়ার সুকর্ণর মতো নেতাদের নিয়ে তিনি জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন গড়ে তোলেন, তা মার্কিনরা ভালো চোখে দেখেনি।

এবার পশ্চিমবঙ্গের দিকে তাকানো যাক। উদ্বাস্তু নামটা ঘোচানোর জন্যই বাঙালরা যেমন পড়াশোনায় মন দিলেন, তেমনই বামপন্থি দলে যোগ দিয়ে নানা আন্দোলনেও অংশ নিতে শুরু করে। শরণার্থীদের সামনে রেখেই কমিউনিস্টরা এগুতে শুরু করে। ছয়ের দশকে কমিউনিস্ট পার্টি ভেঙে যাওয়ার পর হঠাৎই মাথাচাড়া দেয় উগ্রপন্থি নকশালরা। বিধানচন্দ্র রায়ের আমলে আমি পড়াশোনা সবে শেষ করেছি। তার আমলে যে উন্নয়নের ধারা তিনি শুরু করেছিলেন তা অনেকটাই অসমাপ্ত থেকে গেছে। তার উত্তরসূরি প্রফুল্ল সেন কাজ করতে গিয়ে বারবার ধাক্কা পেয়েছেন। ৬২ সালের ১ জুলাই বিধান রায় মারা যান। সে দিনই মুখ্যমন্ত্রী হন প্রফুল্ল সেন। তার আমলে ৬২ সালে চীন-ভারত যুদ্ধ এবং ৬৫টি সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ ঘটে। স্বাধীনতা-উত্তর পশ্চিমবঙ্গে মোট ৮ জন মুখ্যমন্ত্রী হন। এদের মধ্যে ৬ জনই বাঙাল। ’৪৭ সালের ১৫ আগস্ট রাজ্যের দায়িত্বভার নেন কুমিল্লার বিখ্যাত অধ্যাপক ড. প্রফুল্ল ঘোষ। প্রফুল্ল ঘোষকে বলা হতো প্রিমিয়ার। ৬ মাসের মধ্যে তাকে ইস্তফা দিতে হয়। নেহরু বেছে নেন সাতক্ষীরার আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন চিকিৎসক বিধান রায়কে। পরের মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্ল সেনও খুলনার সেনহাটি গ্রামের মানুষ। এছাড়াও বাঙাল মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায়, ঢাকার জ্যোতিবসু, ফরিদপুরের বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। ’৬৭ সালে সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে কংগ্রেসের বিপদ নেমে আসে। সে সময় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। তিনি একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাননি। বামপন্থিরা তাকে সমর্থন করেছিল। কংগ্রেস ভেঙে যাওয়ারও একটা বিরাট ইতিহাস আছে। সিদ্ধার্থ রায় ৭২ থেকে ৭৭ পর্যন্ত মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। এরপর আসেন জ্যোতি বসু। ২৪ বছর টানা মুখ্যমন্ত্রী থেকে নতুন রেকর্ড করেন তিনি। এরপর ফরিদপুরের বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য প্রায় ৮ বছর মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। বাঙাল মুখ্যমন্ত্রীদের আমলে পশ্চিমবঙ্গের উন্নয়ন হয়েছে তাতে কোনো দ্বিমত নেই। বিধান রায়ের আমলে উদ্বাস্তু স্রোত সামলাতে হয়েছে। সে সময় তিনি কলকাতায় সরকারি বাস চালু করেন, আর নির্দেশ দেন ওই বাসে বাঙাল ছেলেদেরই চাকরি দেওয়া হবে। বাঙাল ছেলেদের কাজের জন্য বেশ কয়েকটি পরিকল্পনা নেন তিনি। গড়ে তোলেন কল্যাণী, বিধাননগর, হলদিয়া দুর্গাপুরসহ বেশ কয়েকটি টাউনশিপ। লোকসংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে, বাড়ছে খাদ্যের অভাব। পর পর দুটি যুদ্ধে পশ্চিমবঙ্গ নাজেহাল হয়ে যায়। প্রফুল্ল সেন চালু করেন  রেশনিং প্রথা। সেখানেও কয়েক হাজার লোকের চাকরি হয়। বামপন্থিরা খাদ্য আন্দোলন শুরু করেন। প্রফুল্ল সেনবিরোধী ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তোলে তারা। প্রফুল্ল সেন বলতেন ধানের জমি পূর্ব বাংলায় চলে গেছে। আর ওখানকার লোক এখানে চলে এসেছেন। তিনি তখন ৭ দিনের জন্য জাপান গেলেন জাপানি প্রথায় চাষবাস দেখতে। ফিরে এসে পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেতগুলোতে জাপানি প্রথায় ধান চাষ শুরু করে দেন।

আর দুজন যে ঘটি মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন তাদের একজন ছিলেন মেদিনীপুরের অজয় মুখার্জি আর বীরভূমের মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বাঙাল মুখ্যমন্ত্রীরা সব সময় চিন্তা করতেন উন্নয়ন নিয়ে। তারা দলের কথা ভাবতেন না। কিন্তু ৬৭ সালে কংগ্রেস থেকে বেরিয়ে গিয়ে বাংলা কংগ্রেস নামে একটি দল তৈরি করেন, যার প্রথম সদস্য ছিলেন বর্তমান রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়। অজয় বাবু আজীবন কংগ্রেসী। এমনকি ব্রিটিশ আমলে মেদিনীপুরে একটি স্বাধীন সরকারও তৈরি করেছিলেন। দুই কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে জোট করে সরকার গঠন করেন। তার প্রধান পরামর্শক ছিলেন কমিউনিস্ট নেতা বিশ্বনাথ মুখার্জি। জ্যোতিবসু ছিলেন উপমুখ্যমন্ত্রী এবং অর্থমন্ত্রী। ১৩ মাস পরে এই সরকার ভেঙে যায়। জারি হয় রাষ্ট্রপতি শাসন। সে সময় রাজ্যে চরম অব্যবস্থা। পরিস্থিতি তখন এমন যে সন্ত্রাস, খুন-জখম নিত্য ঘটনা হয়ে উঠেছিল। ৬ মাস পর ফের নির্বাচন হয়। সে নির্বাচনেই কমিউনিস্টদের সঙ্গে নিয়ে আবার মুখ্যমন্ত্রী হন। সে সরকারও ৯ মাসও টিকেনি। ওই সময় উত্তরবঙ্গের জমি দখলকে কেন্দ্র করে তৈরি হয় নকশাল আন্দোলন। যার নেতৃত্বে ছিলেন চারু মজুমদার। সে সময় মানুষ সন্ধ্যার পর রাস্তায় বের হতো না। তখন সাংবাদিকতা করাও ছিলেন বিপজ্জনক। একাধিক সাংবাদিক নকশালদের হাতে খুনও হয়েছিলেন। এই আন্দোলনের পরপরই আবার রাষ্ট্রপতি শাসন। এবার ৭০ সালে নির্বাচন। সেবার অজয় বাবু বামপন্থিদের ছেড়ে কংগ্রেসের সঙ্গে হাত মেলালেন। তিনি মুখ্যমন্ত্রী হলেন, আর উপমুখ্যমন্ত্রী হলেন কংগ্রেসের বিজয় সিং নাহার। তখন বলা হতো অজয় বিজয় মন্ত্রিসভা। তাদের সামনে ৭১ সালে এলো এক গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ। ৭১ সালে অজয় বাবুর কাছে বাংলাদেশের কয়েকজন যুবক গিয়ে বলে অস্ত্র দিন। যুদ্ধ করব। তখন রটে গেছে গ্রামেগঞ্জে মুক্তিবাহিনী ঢুকে পড়েছে। যেসব শরণার্থী এপারে আসছে তাদের সামলাতে অজয় বাবুর মন্ত্রিসভা ব্যর্থ হচ্ছিল। সে সময় আবার রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করা হয়। তার একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল মুক্তিযুদ্ধকে সাহায্য করা। ত্রাণশিবিরের ত্রাণ নিয়ে অনেক মন্ত্রী নয়ছয় করেন। সে কথা জেনেই ইন্দিরা গান্ধী কেন্দ্রের এক মন্ত্রীকে কলকাতায় পাঠান। বাংলাদেশ স্বাধীন হলো।

পশ্চিমবঙ্গে সে সময় সংবাদ মাধ্যমেও বাঙালদেরই আধিপত্য ছিল। আমরা দেখেছি কলকাতা থেকে ৬টি সংবাদপত্র বের হতো। এগুলোর পরিচালনায় ছিল বাঙালরাই অমৃতবাজার, যুগান্তর, হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডার্ড, আনন্দবাজার, বসুমতী এই কাগজগুলোর মধ্যেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা হতো। আমরা শুনেছি পাঁচের দশকে বাংলাদেশ থেকে আসা শরণার্থীদের সমর্থন করত যুগান্তর। এই কাগজগুলোতে যারা সাংবাদিকতা করেছেন তাদের অধিকাংশই বাঙাল। শুনেছি এমনও হেডিং হতো— ভালো খেলিয়াও মোহনবাগানের পরাজয়। অর্থাৎ ইস্টবেঙ্গল যে জিতেছে সেটা সরাসরি হেডিংয়ে লেখা হতো না। এই পর্যায়ে ছিল বাঙাল-ঘটির দ্বন্দ্ব। পাঁচের দশকের মাঝামাঝি ফরিদপুরের এক সাংবাদিক সন্তোষ কুমার ঘোষকে দিল্লি থেকে কলকাতায় নিয়ে আসেন। তিনি এসেই আনন্দবাজারে মধ্যবিত্ত, উদ্বাস্তুদের খবর প্রথম পাতায় নিয়ে আসেন। পশ্চিমবঙ্গের আধুনিক সাংবাদিকতার জনক তাকেই বলা যায়। সাধু ভাষা থেকে চলতি ভাষায় সাংবাদিকতা তিনিই শুরু করেন পশ্চিমবঙ্গে। বাংলা সাংবাদিকতায় রীতিমতো বিপ্লব নিয়ে আসেন তিনি। তার দেখাদেখি সব কাগজ চলতি ভাষায় লিখতে শুরু করে দেয়। বিধান রায়ের পুলিশ কয়েকজন সাংবাদিককে বেদম মারধর করেছিল। তখন আনন্দবাজারের সম্পাদক ছিলেন ময়মনসিংহের সত্যেন্দ্রনাথ মজুমদার। যুগান্তরের সম্পাদক ছিলেন ফরিদপুরের বিবেকানন্দ মুখোপাধ্যায়। সত্যেন্দ্রনাথ বাবু লিখেছিলেন— পুলিশ ব্রিটিশদের জারজ সন্তান। আর বিবেকানন্দ বাবু লিখেছিলেন পুলিশ জননীর গর্ভের লজ্জা। এই দুটি সম্পাদকীয় নিয়ে হৈচৈ পড়ে গিয়েছিল।দুই ঘটি মুখ্যমন্ত্রীর আমলেই পশ্চিমবঙ্গ সন্ত্রাসের রাজ্য ছিল। অজয় বাবুর সময় তো বটেই, বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আমলে তো পশ্চিমবঙ্গে সন্ত্রাসের স্বর্গরাজ্য হয়ে উঠেছে। কিন্তু আমার অভিজ্ঞতায় বলে এপার বাংলার বাঙাল-ঘটির যে দ্বন্দ্ব সেটাও বরাবরের জন্য শেষ করে দিয়ে গেছেন বঙ্গবন্ধু মুজিবুর রহমান। মুক্তিযুদ্ধের সময় দুই বাংলার মানুষ যেভাবে মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছিল তারপরই ধীরে ধীরে কমতে শুরু করে ঘটি-বাঙালের লড়াই।

 

লেখক : প্রবীণ ভারতীয় সাংবাদিক।

সর্বশেষ খবর