দেশের সব ব্যাংকই এখন অ্যাপভিত্তিক লেনদেনকে গুরুত্ব দিচ্ছে। আর এর সুফলও ধীরে ধীরে স্পষ্ট হচ্ছে বলে জানিয়েছেন ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. ওমর ফারুক খাঁন।
তিনি বলেন, আগে যেখানে ছোটখাটো লেনদেনের জন্য গ্রাহককে শাখায় গিয়ে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়াতে হতো, এখন মোবাইল ফোনের মাধ্যমে ঘরে বসেই টাকা পাঠানো, স্কুল-কলেজের ফি ও ইউটিলিটি বিল পরিশোধ, টিকিট কেনা, হোটেল বুকিংসহ ব্যালান্স দেখা কিংবা অন্যান্য সেবা নেওয়া সম্ভব হচ্ছে। এতে সময় ও ভোগান্তি দুটিই কমেছে। নগদ টাকার ব্যবহার হ্রাস পেয়েছে এবং ব্যাংকিংব্যবস্থার প্রতি গ্রাহকের আস্থা বেড়েছে। পাশাপাশি গ্রামীণ এলাকায়ও স্মার্টফোন ব্যবহার করে সহজে ব্যাংকের সেবা পাওয়া যাচ্ছে, যা আর্থিক অন্তর্ভুক্তিকে আরও এগিয়ে নিচ্ছে। একই সঙ্গে ব্যাংকের পরিচালন ব্যয় কমছে এবং গ্রাহকের সময় ও খরচ সাশ্রয় হচ্ছে। তবে তিনি স্বীকার করেন, সাইবার নিরাপত্তা, প্রবীণ গ্রাহকদের প্রযুক্তি ব্যবহারে অস্বাচ্ছন্দ্য এবং নেটওয়ার্কের অপ্রতুলতা এখনো বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে রয়েছে। তবু সামগ্রিকভাবে অ্যাপভিত্তিক লেনদেন দেশের ব্যাংকিং খাতে ইতিবাচক পরিবর্তন এনেছে।
সেলফিন : পূর্ণাঙ্গ ডিজিটাল ব্যাংকিং সমাধান
ইসলামী ব্যাংকের ডিজিটাল ব্যাংকিং অ্যাপ সেলফিন গ্রাহকের মধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলতে সক্ষম হয়েছে। এমডি বলেন, ‘সেলফিন বাজারে জনপ্রিয়তা পেয়েছে মূলত গ্রাহকের প্রয়োজনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ সেবা দেওয়ার কারণে। এটি ব্যবহার সহজ, দ্রুত ও নিরাপদ হওয়ায় সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে ব্যবসায়ী শ্রেণি পর্যন্ত সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেছে।’
এ অ্যাপের মাধ্যমে গ্রাহক মুহূর্তের মধ্যে এক ব্যাংক থেকে অন্য ব্যাংকে টাকা পাঠাতে পারছেন। বিকাশ, নগদ ও এমক্যাশের মতো মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেও সরাসরি টাকা স্থানান্তর সম্ভব। ফলে নগদ টাকা বহনের ঝুঁকি কমছে এবং লেনদেন আরও সুবিধাজনক হচ্ছে।
সেলফিন শুধু টাকা পাঠানো বা বিল পরিশোধে সীমাবদ্ধ নয়। এর মাধ্যমে নতুন ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলা, বিনিয়োগের কিস্তি পরিশোধ, ব্যাংক স্টেটমেন্ট দেখা, বিভিন্ন শাখার একাধিক অ্যাকাউন্ট এক প্ল্যাটফর্মে যুক্ত করা সবই সম্ভব। এমনকি সেলফিন দিয়ে এটিএম থেকে কার্ড ছাড়াই টাকা উত্তোলন করা যায়, যা একে মাল্টিকার্ড হিসেবে কাজ করতে সক্ষম করেছে। এ ছাড়া অটো-পে সুবিধার মাধ্যমে গ্রাহক নির্দিষ্ট সময়ে বিল বা কিস্তি স্বয়ংক্রিয়ভাবে পরিশোধ করতে পারেন। সরকারি ফি ও চার্জ পরিশোধের জন্য রয়েছে ই-চালান সেবা।
বহুমাত্রিক সেবাসমৃদ্ধ প্ল্যাটফর্ম : সেলফিন অ্যাপের মাধ্যমে গ্রাহক ২৪/৭ বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানি ও ইন্টারনেট বিল পরিশোধ করতে পারেন। দেশের ৪০০ শাখা, ২৭১ উপশাখা এবং ৩ হাজার ৪০টি এটিএম ও সিআরএম বুথ থেকে সহজেই টাকা উত্তোলন সম্ভব। গোপন পিন ব্যবহার করে রেমিট্যান্স অ্যাকাউন্টে স্থানান্তর করা যায়। ঘরে বসেই বাস, লঞ্চ ও বিমানের টিকিট কেনা যায়, মোবাইল টপ-আপ করা যায়, এমনকি বিভিন্ন ধরনের হিসাবও খোলা যায় যেমন সঞ্চয়ী হিসাব, স্টুডেন্ট অ্যাকাউন্ট, স্যালারি অ্যাকাউন্ট, হজ ও মোহরানা অ্যাকাউন্ট এবং ৯টি মুদ্রায় অফশোর ব্যাংকিং অ্যাকাউন্ট।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা : এমডি জানান, মানুষ এখন সেলফ সার্ভিস ব্যাংকিংয়ে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছে, যা প্রমাণ করে ভবিষ্যতে ব্যাংকিংসেবার বড় অংশই অ্যাপভিত্তিক হবে। শাখায় না গিয়েই বিনিয়োগের আবেদন, ডিজিটাল পে-অর্ডার, ফিক্সড ডিপোজিট খোলা এমনকি আন্তর্জাতিক লেনদেনও সম্ভব হবে। নিরাপত্তা ও কার্যকারিতা বাড়াতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই), ব্লকচেইন এবং বায়োমেট্রিক সিকিউরিটি সংযুক্ত করার পরিকল্পনা রয়েছে। তবে তিনি সতর্ক করেন, অ্যাপভিত্তিক লেনদেন ঝুঁকিমুক্ত নয়। সাইবার নিরাপত্তা বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে রয়ে গেছে। হ্যাকাররা ভুয়া অ্যাপ, ফিশিং লিঙ্ক বা সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং কৌশলে গ্রাহকের তথ্য হাতিয়ে নিতে পারে। তাই ব্যাংকগুলোর শক্তিশালী সাইবার প্রতিরক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলা এবং গ্রাহকদের সচেতন হওয়া জরুরি।
সেলফিনের বর্তমান অবস্থা : বর্তমানে সেলফিনের গ্রাহকসংখ্যা ৫৫ লাখের বেশি। প্রতিদিন গড়ে প্রায় ২ লাখ লেনদেন সম্পন্ন হচ্ছে, যার আর্থিক মূল্য প্রায় ৬০০ কোটি টাকা।
এমডি বলেন, ‘অ্যাপভিত্তিক লেনদেন আরও সহজ ও আধুনিক করার লক্ষ্যেই আমরা ভবিষ্যতে সেলফিন অ্যাপে নতুন নতুন সেবা যুক্ত করব। গ্রাহক ঘরে বসেই চেকবইয়ের আবেদন, কার্ড বা অ্যাকাউন্ট ব্লক, নতুন কার্ড ইস্যু, ইনকাম ট্যাক্স সার্টিফিকেট সংগ্রহ, টার্ম ডিপোজিট বন্ধের আবেদন এবং পে-অর্ডার ইস্যু করতে পারবেন। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক লেনদেন সুবিধাও যুক্ত করা হবে।’ তাঁর মতে শাখানির্ভরতা কমিয়ে গ্রাহকের হাতে পূর্ণাঙ্গ ডিজিটাল ব্যাংকিংসুবিধা পৌঁছে দেওয়াই ইসলামী ব্যাংকের প্রধান লক্ষ্য।