বুধবার, ১৪ নভেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

তাইজুল কি বাংলার ‘ডেডলি’!

মেজবাহ্-উল-হক

তাইজুল কি বাংলার ‘ডেডলি’!

যেন পাখির মতো উড়ে বল তালুবন্দী করলেন তাইজুল ইসলাম! জিম্বাবুয়ের সেঞ্চুরিয়ন ব্যাটসম্যান ব্রেন্ডন টেলর ১১০ রানে আউট। তাইজুলের এই এক ক্যাচেই যেন পাল্টে যায় খেলার গতি। সেরা ব্যাটসম্যানকে হারিয়ে ৩০৪ রানেই আটকে যায় জিম্বাবুয়ের ইনিংস। ফলোঅনে পড়ে যায় সফরকারীরা। প্রথম ইনিংসে বাংলাদেশের লিড ২১৮ রান।

তাইজুলের ক্যাচটি ম্যাচের চেহেরা পাল্টে দিলেও বাংলাদেশের এই স্পিন জাদুকর ক্যারিশমা দেখিয়েছেন তার বোলিংয়ে। জিম্বাবুয়ের ব্যাটসম্যানদের দিশেহারা করে দিয়ে তুলে নিয়েছেন ৫ উইকেট। টানা তিন ইনিংসে ৫ উইকেট নিয়ে একটি অনন্য রেকর্ডও স্পর্শ করলেন তাইজুল। তিন ইনিংসে টানা ৫টি করে উইকেট নেওয়ার এমন বিরল কীর্তি আগে ছিল সাকিব আল হাসান ও এনামুল হক জুনিয়রের। জিম্বাবুয়ে সিরিজে কাগজে-কলমে বাংলাদেশের স্পিন আক্রমণ অনেকটাই দুর্বল ছিল সেরা স্পিনার সাকিব না থাকায়। কিন্তু তাইজুল তো সে অভাবটা বুঝতেই দিচ্ছেন না। সিলেট টেস্টে বাংলাদেশ হারলেও এই বাম হাতি স্পিনার একাই নিয়েছিলেন ১১ উইকেট।

যতই দিন যাচ্ছে তাইজুল যেন আরও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছেন। চলতি বছরে এখন পর্যন্ত ৫ টেস্ট (এক ইনিংস বাকি) খেলেছেন। উইকেট শিকার করেছেন ৩১টি।

দীর্ঘ সময় এক জায়গায় বোলিং করার অসাধারণ ক্ষমতা রয়েছে তাইজুলের। দীর্ঘ স্পেলে বোলিং করতেও তার কোনো আপত্তি নেই। জিম্বাবুয়ে প্রথম ইনিংসে খেলেছে মোট ১০৫.৩ ওভার। কিন্তু তাইজুল একাই ৪০.৩ ওভার বোলিং করেছেন।

শেরেবাংলার উইকেট গতকালও ছিল ব্যাটসম্যানদের জন্য স্বর্গ। ‘এই উইকেটে ব্যাট করা খুবই সহজ। আমরা ভেবেছিলাম তৃতীয় দিনে টার্ন করতে পারে। কিন্তু তেমন হয়নি। হয়তো চতুর্থ-পঞ্চম দিনে বল ঘুরতে পারে। আশ্চার্যজনক হলেও সত্যি, আজ (গতকাল) সহজেই বল ব্যাটে আসছিল।’ এমন দাবি জিম্বাবুয়ের হয়ে ৮৩ রানের ইনিংস খেলা ব্যাটসম্যান পিটার মুরের।

কিন্তু এমন ‘তক্তা মার্কা’ উইকেটেও স্পিন জাদু দেখিয়েছেন তাইজুল ইসলাম (মেহেদী মিরাজও ৩ উইকেট নিয়েছেন)। তিনি বল ঘুরিয়েছেন, জিম্বাবুয়ের ব্যাটসম্যানদের বোকা বানিয়েছেন, তাইজুল প্রমাণ করেছেন একাগ্র প্রচেষ্টার সঙ্গে প্রতীভার যোগ করতে পারলে মরা উইকেটেও দাপট দেখানো যায়।

ভালো স্পিনারের কাছে উইকেট যে কোনো ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়ায় না তা ৬০-৭০ এর দশকে বুঝিয়ে দিয়ে গেছেন ইংল্যান্ড ও ভারতের দুই কিংবদন্তি  বামহাতি স্পিনার ডেরেক আন্ডারউড ও বিশান বেদী। উইকেট সবুজ ঘাসের হোক, কিংবা ব্যাটিং স্বর্গ ‘তক্তা মার্কা’ উইকেট হোক অথবা বৃষ্টি বিঘ্নিত ম্যাচের স্যাঁতসেঁতে উইকেট হলেও সমস্যা নেই সবখানেই ডেরেক আন্ডারউড ছিলেন সেরা। ষাট ও সত্তরের দশকে এই ইংলিশ বামহাতি স্পিনারের বিরুদ্ধে ব্যাট করতে নেমে ভয় পেতেন না এমন কোনো ব্যাটসম্যান খুঁজে পাওয়া দায়! ব্যাটসম্যানরা তার বল বুঝতে পারতেন না। ওভারের প্রতিটি বলেই থাকত বৈচিত্র্য। বল এতই ঘুরতো যে ‘তক্তা মার্কা’ উইকেটের যেখানে বল পড়তো সেখানে ধুলা উড়তো। আর সবুজ উইকেট হলে নির্দিষ্ট জায়গার ঘাস উঠে যেত। যথারীতি দিশেহারা হয়ে যেতেন ব্যাটসম্যান। ১৯৬৮ সালে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে ইংল্যান্ডের ম্যাচটি বৃষ্টির কারণে ৪ ঘণ্টা বন্ধ ছিল। তারপর স্যাঁতসেঁতে উইকেটে যখন খেলা শুরু হয় মাত্র ২৭ বলে ৪ উইকেট নিয়ে যেন এক হারা ম্যাচে ইংল্যান্ডকে জয় এনে দিয়েছিলেন আন্ডারউড। পেস বোলিংয়ের যুগে তার এই বীরত্বের কারণে ইংলিশরা তাকে ‘ডেডলি’ নামে ডাকতেন, বাংলায় যার অর্থ ‘প্রাণঘাতী’। এই ইংলিশ কিংবদন্তি ৮৬ টেস্টে নিয়েছিলেন ২৯৭ উইকেট। রেকর্ডের কথা কখনো তোয়াক্কা করেননি, তা না হলে উইন্ডিজ কিংবদন্তি পেসার (বর্তমানে বাংলাদেশ দলের বোলিং উপদেষ্টা) কোর্টনি ওয়ালশের আগে তিনিই হতে পারতেন ৩০০ উইকেটের মালিক। আন্ডারউডের সমসাময়িক সময়ে ভারতেরও ছিল আরেক ‘ডেডলি’ স্পিনার- তার নাম বিশান সিং বেদী। এই বামহাতি স্পিনার ছিলেন ব্যাটসম্যানদের জন্য রীতিমতো ‘যম দূত’! তিনি যেন ব্যাটসম্যানের মৃত্যু পরোয়ানা (পড়ুন উইকেট পতন) নিয়ে বোলিং মার্কে হাজির হতেন। অত্যন্ত ব্যাটিং সহায়ক উইকেটেও ঘূর্ণি জাদু দেখিয়ে একের পর এক উইকেট তুলে নিতেন। ভারতের হয়ে এই স্পিনার ৬৭ ম্যাচে নিয়েছেন ২৬৬ উইকেট। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে তার উইকেট সংখ্যা ১৫৬০।

বাংলাদেশের তাইজুল ইসলামের মধ্যেও যেন বিশ্বসেরা দুই বামহাতি স্পিনারের ছায়া দেখা যাচ্ছে। যদিও পরিসংখ্যানের দিক দিয়ে তাইজুল তাদের ধারেকাছেও নেই। ২১ ম্যাচে (এক ইনিংস বাকি) তাইজুলের উইকেট সংখ্যা এখন ৮৫। গড় ৩২.৩১। যদিও আন্ডারউড ও বেদীর গড় আরও অনেক ভালো। আন্ডারউড ২৫.৮৩ এবং বেদী ২৮.৭১। তাকে কি? বাংলাদেশের ২৬ বছর বয়সী এই বামহাতি স্পিনারের ক্যারিয়ার তো সবে শুরু। তাইজুল যেভাবে ধারাবাহিকভাবে উইকেট শিকার করছেন, এভাবে চলতে থাকলে ডেরেক আন্ডারউড ও বিশান বেদীর মতো তিনিও হতে পারেন বাংলাদেশের  তথা বাংলার ‘ডেডলি’!

সংক্ষিপ্ত স্কোর

বাংলাদেশ : ১ম ইনিংস ৫২২/৭ (১৬০ওভার) ডিক্লে., মুশফিক ২১৯, মুমিনুল ১৬১।

জিম্বাবুয়ে : ১ম ইনিংস ৩০৪/১০ (১০৫.৩ ওভার) টেলর ১১০, মুর ৮৩, তাইজুল ৫/১০৭, মিরাজ ৩/৫১

সর্বশেষ খবর