সোমবার, ১০ এপ্রিল, ২০২৩ ০০:০০ টা

অধিনায়ক থেকে চ্যাম্পিয়ন কোচ

অধিনায়ক থেকে চ্যাম্পিয়ন কোচ

আবদুস সাদেক

ঘরোয়া ফুটবলে বর্তমানে বিদেশি কোচই ভরপুর। খুব কম ক্লাবই আছে স্থানীয়রা কোচের দায়িত্ব পালন করছেন। অথচ সত্তরের বা আশির দশকে ছিল স্থানীয় কোচদেরই দাপট। দেখা গেছে অবসর নেওয়ার পর কোচিং ক্যারিয়ার শুরু করেছেন। ঘরোয়া ফুটবলে এমন কোচ আছেন যাঁরা সুনামের সঙ্গে অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করার পর কোচ হিসেবে দলকে চ্যাম্পিয়ন করিয়েছেন। এমন কয়েক জনের সাফল্য নিয়ে প্রতিবেদন তৈরি করেছেন মনোয়ার হক

আবাহনীর ডাবল শিরোপা

আবদুস সাদেক বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনে সুপরিচিত মুখ। ফুটবল ও হকিতে সমান দক্ষতার স্বাক্ষর রেখেছেন। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে ঢাকা প্রথম বিভাগ ফুটবল লিগে ঢাকা আবাহনী ক্রীড়া চক্রের অভিষেক হয়। আবদুস সাদেকই ছিলেন নতুন আবাহনীর প্রথম অধিনায়ক। রক্ষণভাগে দাপটের স্বাক্ষর রাখেন। তাঁর মতো ফিট ফুটবলার কমই দেখা গেছে। ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত তিনি আবাহনীর জার্সি পরে মাঠে নামেন। সে মৌসুমে আবাহনীতে যোগ্য কোচ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। আগের দুই মৌসুম মোহামেডান চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। এমন একজন যোগ্য কোচ দরকার লিগে যিনি সাফল্য এনে দিতে পারবেন। ম্যানেজমেন্ট সিদ্ধান্ত নিল খেলোয়াড়ের পাশাপাশি আবদুস সাদেকই হেড কোচের দায়িত্ব পালন করবেন। যা ঘরোয়া ফুটবলে কখনো ঘটেনি।

কারও কারও সংশয় ছিল দুই দায়িত্ব নিয়ে আবদুস সাদেক কোচ হিসেবে কতটা সফল হবেন। শেষ পর্যন্ত তাঁর প্রশিক্ষণে আবাহনী বাংলাদেশের ঘরোয়া ফুটবলে প্রথম অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হলো। ফাইনালে রহমতগঞ্জকে ৩-১ গোলে হারিয়ে আবাহনী দ্বিতীয়বারের মতো লিগ জিতল। শুধু তাই নয়, সে বছর আবদুস সাদেকের প্রশিক্ষণে আবাহনী ডাবল ট্রফি জেতে। লিবারেশন কাপেও চ্যাম্পিয়ন হয়।

 

গোলাম সারোয়ার টিপু

মোহামেডানের ট্রেবল ট্রফি

বাংলাদেশের কিংবদন্তি ফুটবলার। ১৯৭৯ সালে অবসর নিলেও গোলাম সরোয়ার টিপুর নৈপুণ্য এখনো চোখে ভাসে। এক সময় টিপু ও প্রতাপ হাজরার জুটি ছিল খুবই জনপ্রিয়। টিপুর কর্নারকে পেনাল্টির সঙ্গে তুলনা করা হতো। নিজে গোল করেছেন, সতীর্থদের করিয়েছেন। বিশেষ করে ১৯৬৮ সালে আগাখান গোল্ডকাপে ফাইনালে তার জোড়া গোল ভোলবার নয়। ১৯৭২-এ তিনি যোগ দেন নবাগত আবাহনীতে। ১৯৭৪ সালে টিপুরই নেতৃত্বে আবাহনী প্রথম লিগে চ্যাম্পিয়ন হয়। পরের মৌসুমেই ফিরে আসেন তাঁর প্রিয় ক্লাব মোহামেডানে। ১৯৮০ সালে মোহামেডানের প্রশিক্ষণের দায়িত্ব পান টিপু। অধিকাংশ তরুণ খেলোয়াড় হওয়ায় টিপু কিছুটা হলেও চ্যালেঞ্জে পড়েন। তারপরও তার ক্যারিশমায় মোহামেডান লিগ ও ফেডারেশন কাপে চ্যাম্পিয়ন হয়। ১৯৮১ ফেডারেশন কাপ চ্যাম্পিয়ন। ১৯৮২ সালটা টিপুর কোচিং ক্যারিয়ারে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। সেবার তারই প্রশিক্ষণে মোহামেডান ট্রেবল শিরোপা জেতে। প্রথমটি ছিল ভারতে অনুষ্ঠিত আশীষ-জব্বার স্মৃতি, ফেডারেশন কাপ ও লিগ চ্যাম্পিয়ন হয়। অর্থাৎ টিপুই প্রথম কোচ যিনি কোনো দলকে ট্রেবল ট্রফি জেতান। ১৯৮৩ সালে ফেডারেশন কাপ চ্যাম্পিয়নই ছিল মোহামেডানে টিপুর শেষ ট্রফি।

 

কাজী সালাউদ্দিন

ম্যাজিক চ্যাম্পিয়ন আবাহনী

বাংলাদেশের ফুটবলে উজ্জ্বল নক্ষত্র কাজী সালাউদ্দিন। জনপ্রিয়তার দিক দিয়ে শুধু ফুটবল বললে ভুল হবে। ক্রীড়াঙ্গনে তাঁর নাম স্মরণীয় হয়ে থাকবে। এ কিংবদন্তি ফুটবলার মোহামেডানে খেলেছেন। কিন্তু তারকার চূড়ায় উঠেছেন আবাহনী থেকে। আজকের আবাহনীর আকাশছোঁয়া জনপ্রিয়তার পেছনে সালাউদ্দিনের ক্যারিশমার কথা অস্বীকার করা যাবে না। ১৯৭২ থেকে ১৯৮৪। টানা এক যুগ খেলে গেছেন তাঁর প্রিয় দলে। সর্বোচ্চ গোলদাতা ছাড়াও রেকর্ড যেন তাঁর পেছনে ছুটেছে। ১৯৭৫ সালে আবাহনীর অধিনায়ক হন তিনি। দলকে এনে দিতে পারেননি শিরোপা। তবু তার নৈপুণ্য ছিল চোখে পড়ার মতো। ১৯৮৪ সালে সালাউদ্দিন খেলোয়াড়ী ক্যারিয়ারের ইতি টানেন। সেবার লিগ চ্যাম্পিয়ন আবাহনী। খেলা ছেড়েই ১৯৮৫ সালে আবাহনীর কোচ হয়ে যান সালাউদ্দিন। ফুটবলার হিসেবে যেমন ম্যাজিক প্রদর্শন করেন। তেমনি কোচিংও। ম্যাচে ড্র করলে ব্রাদার্স চ্যাম্পিয়ন। সেই ম্যাচেই সালাউদ্দিনের ম্যাজিক কোচিংয়ে ম্যাচ জিতে চ্যাম্পিয়নের পথে এগিয়ে যায় আবাহনী। সেবার ফেডারেশনের কাপও চ্যাম্পিয়ন হয়। সালাউদ্দিন ভাগ্যবান, তিনি কোচ থাকা অবস্থায় লিগে আবাহনী হ্যাটট্রিক চ্যাম্পিয়ন হয়। পরের বছরে তার প্রশিক্ষণে ফেডারেশন কাপ চ্যাম্পিয়ন।

 

অমলেশ সেন

ব্যতিক্রমী এক কোচ

বাংলাদেশের ফুটবলে যে কয়জন পরিচিত মুখ আছেন তাদের মধ্যে অমলেশ সেনের নাম উল্লেখযোগ্য। ফায়ার সার্ভিস ও মোহামেডান খেললেও ক্যারিয়ারে অধিকাংশ সময়টা কেটেছে ঢাকা আবাহনীতেই। ১৯৭২ সালে মোহামেডান থেকে আবাহনীতে যোগ দেওয়ার পর তিনি আর ক্লাব ছাড়েননি। মধ্য মাঠে অমলেশ ও খোরশেদ বাবুলের জুটি ছিল বিখ্যাত। ম্যাচ নিশ্চিত ড্রয়ের পথে অথচ অমলেশের গোলে ম্যাচ জিতেছে- এ সংখ্যা একেবারে কম নয়। এত বড় ফুটবলার অথচ নীরব থাকতেই পছন্দ করতেন।

১৯৭৬ সালে দেশপ্রিয় আবাহনীর অধিনায়কের দায়িত্ব পান অমলেশ। দুর্ভাগ্য তার, সেবার ফাইনালে উঠলেও মোহামেডানের কাছে ০-২ গোলে হেরে যায়। ১৯৮০ সাল পর্যন্ত নিয়মিত দলে সুযোগ পেলেও নতুনদের সুযোগ করে দিতে সরে দাঁড়ান। তবে দলকে সহযোগিতা করতে ভুল করেননি। তাঁকে বলা হয় আবাহনীর বিপদের বন্ধু। দেখা গেছে বিদেশি কোচ এসেও মাঝ পথে চলে গেছেন। তখন কোচের দায়িত্ব নিতে হতো আমলেশকে এবং দলকে চ্যাম্পিয়নও করাতেন। তবে আমলেশের একক প্রশিক্ষণে আবাহনীর লিগ জয়ের রেকর্ডও রয়েছে।

 

শফিকুল ইসলাম

যে রেকর্ড শুধু তাঁর

ফুটবলার শফিকুল ইসলামের কথা বলতে গেলে চোখে ভেসে আসে ১৯৮৫ সালের কথা। সেবার তিনি ব্রাদার্সের অধিনায়ক ছিলেন। তাঁর নেতৃত্বে গোপীবাগের দলটি যে দাপটের সঙ্গে খেলছিল তাতে মনে হচ্ছিল ব্রাদার্স প্রথমবারের মতো লিগ জিততে যাচ্ছে। শেষ পর্যন্ত কি না তীরে এসে তরী ডুবল ব্রাদার্সের। সেই আফসোস কখনো মানিকের ভোলবার নয়। ১৯৮৬ সালে তিনি ঢাকা মোহামেডানে যোগ দেন। এরপর আর ক্লাব বদল করেননি। মানিক এক সময়ে মোহামেডানের সহযোগী কোচের দায়িত্ব পালন করতেন।

মুক্তিযোদ্ধায় এসেই হেড কোচের দায়িত্ব পান। আর এতেই গড়েন ইতিহাস। লিগ চ্যাম্পিয়ন তখন মোহামেডান-আবাহনীর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকত। সেই রেকর্ড ভাঙল মানিকের প্রশিক্ষণেই। ১৯৯৭-৯৮ মৌসুমে যে খেলায় ড্র করলেই চ্যাম্পিয়ন মোহামেডান। সেখানে মানিকের প্রশিক্ষণ দেওয়া মুক্তিযোদ্ধা ২-০ গোলে জিতে প্রথমবারের মতো চ্যাম্পিয়ন। ১৮ বছরের দুই প্রধানের সাফল্যে ভাঙণ ধরালেন মানিকই। আরও একবার মুক্তিযোদ্ধাকে লিগ চ্যাম্পিয়ন করান। এনে দিয়েছেন দুবার ফেডারেশন কাপের শিরোপও। নিটল টাটা ট্রফি। তার প্রশিক্ষণে ভারতের ম্যাগডোনাল্ড কাপে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে মুক্তিযোদ্ধা। মোহামেডানকে জিতিয়েছেন নিটল টাটা শিরোপা।

 

 

সর্বশেষ খবর