'সান্টা ফি'র কান্না অবশেষে থেমে গেল 'ভিনা দেল মারে'তে। চার বছর আগের 'খলনায়ক' কার্লোস তেভেজ এখন 'মহানায়ক'।
আর্জেন্টিনার ছোট্ট শহর 'সান্টা ফি'তে ২০১১ সালে মঞ্চস্থ হয়েছিল এক বিষাদময় নাটক। যার কেন্দ্রীয় চরিত্রে ছিলেন তেভেজ। পরিষ্কার করে বললে ভিলেনের চরিত্রে!
কোপা আমেরিকার ওই আসরের কোয়ার্টার ফাইনালে টাইব্রেকারে তেভেজের গোল মিসের কারণেই উরুগুয়ের কাছে ৫-৪ গোলে হেরেছিল আর্জেন্টিনা। ঘরের মাঠে টপ ফেবারিট দলের বিদায়ে সান্টা ফি-তে কান্নার রোল পড়ে যায়। সাধারণ মানুষ রাস্তায় নেমে তেভেজের বিরুদ্ধে মিছিল করেছিলেন। চার বছর পর সেই সান্টা ফি-র রাস্তায় আবার মিছিল, এবারও তেভেজকে নিয়ে। তবে এবার ভিলেন নয়, হিরো! সেই তেভেজের গোলেই রক্ষা পেল আর্জেন্টিনা। কলম্বিয়াকে হারিয়ে সেমিফাইনালের টিকিট নিশ্চিত করল আলবেসিলেস্তরা।
সত্যি, ফুটবল খেলাতেও কখনো কখনো এমন সব নাটকীয় ঘটনা ঘটে, বাস্তবে যার অর্থ খুঁজে পাওয়া কঠিন। চার বছর আগে আর্জেন্টিনায় যে তেভেজের জনপ্রিয়তায় মুহূর্তের ব্যবধানে শূন্যের কোটায় নেমেছিল, চার বছর পরে আবারও মুহূর্তের ব্যবধানে তেভেজ মহানায়ক! কাকতালীয়ভাবে আর্জেন্টিনার জয়টাও এসেছে একইভাবে- সেই কোয়ার্টার ফাইনাল, সেই টাইব্রেকার, গোলের ব্যবধানও একই, ৫-৪। শুধু উরুগুয়ের জায়গায় এবার প্রতিপক্ষ কলম্বিয়া, সান্টা ফি'র পরিবর্তে ভেন্যু ভিনা দেল মারে!
আর্জেন্টিনার জয়টা এসেছে মহানাটকীয়ভাবে। নির্ধারিত সময়ে খেলা গোলশূন্য ড্র হওয়ায় ম্যাচ গড়ায় টাইব্রেকারে। দুই দলের প্রথম তিন শটই প্রতিপক্ষের জালে জড়িয়ে যায়। রিয়াল মাদ্রিদ সুপারস্টার জেমস রদ্রিগেজের কাছে পরাস্ত হন আর্জেন্টাইন গোলরক্ষক সার্জিও রোমেরা। পরের শটেই লিওনেল মেসি গোল করে সমতা ফেরান। কলাম্বিয়ান তারকা রাদামেল ফ্যালকাও এবং হুয়ান কিউদ্রাদোও লক্ষ্য ভেদ করে। গ্যারে ও বানেগার গোলে আবারও সমতা। কিন্তু চতুর্থ শটটি নিতে গিয়ে লক্ষ্যভ্রষ্ট মিউরিয়েল। তবে ভুল করেননি আর্জেন্টাইন তারকা লেভেজ্জি। ৪-৩ গোলে এগিয়ে যায় আর্জেন্টিনা। পঞ্চম শটে কলম্বিয়ার কর্দোনা গোল করে ব্যবধান ৪-৪ করেন। তখনো একটি শট বাকি আর্জেন্টিনার। লুকাস বিগলিয়ার শট লক্ষ্যভেদ করতে পারলেই আনন্দে মেতে উঠবে আর্জেন্টিনার সমর্থকরা। কিন্তু না, মিস করলেন বিগলিয়া! তখন হয়তো আলবেসিলেস্তো ভক্তদের স্মৃতিপটে ভাসছিল চার বছর আগের সেই বিষাদময় ছবি!
সাডেন ডেথ-এ ক্যামিলো জুনিগার শট অসাধারণ দক্ষতায় আটকে দিলেন রোমেরো। স্নায়ুচাপে ভুগতে থাকা আর্জেন্টাইনরা কিছু যেন হালকা হলেন। কিন্তু একি করলেন মার্কাস রোহো। বল জালে জড়াতে পারলেই সেমিফাইনাল। কিন্তু রোহো মারলেন গোলবারের উপর দিয়ে। আবারও হতাশ আর্জেন্টিনা। টিভি পর্দায় একবার অধিনায়ক মেসিকে দেখাল। বার্সেলোনার জার্সিতে অনেক পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হয়েছিল তাকে। কিন্তু কখনো এতো মলিন দেখায়নি মেসিকে।
এরপর সপ্তম শটটা মিস করলেন কলম্বিয়ার স্টপারব্যাক মিউরিলো। তবে এবার আর শট লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়নি আর্জেন্টিনার। কলম্বিয়ান গোলরক্ষক ওসপিনাকে বোকা বানিয়ে কার্লোস তেভেজ বল জড়িয়ে দেন জালে।
নাটকীয়তায় সমাপ্তি ঘটা ম্যাচের নির্ধারিত ৯০ মিনিটে খুব একটা ছন্দময় ফুটবল দেখা যায়নি। দুই দলের খেলোয়াড়রাই দ্রুত মেজাজ হারিয়ে ফেলেছেন। যে কারণে মেক্সিকাের রেফারি রোবার্তো গার্সিয়া ওরস্কোকে আটবার পকেট থেকে হলুদ কার্ড বের করতে হয়েছিল। ঠাণ্ডা মাথার মেসিও কাল কার্ড দেখেছেন। বাদ যাননি আগুয়েরো এবং মাসকেরানোও। ফ্যালকাও, রদ্রিগেজসহ ৫জন কলম্বিয়ান খেলোয়াড়ও হলুদ কার্ড দেখেছেন।
তবে রেফারি ঠাণ্ডা মাথায় খেলা পরিচালনা করেছেন বলেই হয়তো উভয় দল ১১ জন করে খেলোয়াড় নিয়ে ৯০ মিনিট শেষ করেছেন। নয়তো কার্ডের ছড়াছড়ি হয়ে যেত। ফুটবল খেলতে নয় যেন দুই দল রেসলিং করতে মাঠে নেমেছিলেন। তবে এতো প্রতিকূলতার মধ্যেও ঝলক দেখিয়েছেন লিওনেল মেসি। কলম্বিয়ার রক্ষণদুর্গ বার বার তছনছ করে দিয়েছেন বার্সা তারকা। কিন্তু গোলরক্ষক ওসপিনা পরাস্ত করতে পারেননি। পুরো ম্যাচে অন্তত হাফ ডজন গোলের সুযোগ নষ্ট করেছে আলবেসিলেস্তোরা।
কলম্বিয়া যেন টাইব্রেকারের উদ্দেশ্য নিয়েই মাঠে নেমেছিল। শুরুতে দুই একটা আক্রমণ করল দ্বিতীয়ার্ধে তারা ১১ জন মিলেই পাহারা দিয়েছেন গোলপোস্ট। কাউন্টার অ্যাটাক করতেও দেখা যায়নি। পরিস্থিতি এমন ছিল যে, দ্বিতীয়ার্ধের ৪৫ মিনিট গোলপোস্টের নিচেই ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিতে পারতেন সার্জিও রোমেরো। তবে এই ম্যাচে কলম্বিয়ানরা আরেকটি কাজ করেছেন, নিয়মিত লিওনেল মেসিকে উত্ত্যক্ত করেছেন। 'কুৎসিত' -এমন পরিকল্পনার জন্যই কিনা ম্যাচ চলাকালীন কলাম্বিয়ার কোচ হোসে পেকারম্যানের ওপর চড়াও হয়েছিলেন আর্জেন্টাইন কোচ জেরার্ডো মার্টিনো! তবে নির্ধারিত ৯০ মিনিটে পেকারম্যানের শিষ্যরা গুরুর পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করলেও শেষরক্ষা হয়নি টাইব্রেকারে।