অনেকে মনে করেন পূর্ণিমা চাঁদ পর্যবেক্ষণের জন্য আদর্শ সময় নয়, কারণ তখন চাঁদের উজ্জ্বল আলো ছায়া ঢেকে দেয়। কিন্তু সঠিক কৌশল জানলে এই সময়ও অনেক আকর্ষণীয় জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক দৃশ্য উপভোগ করা যায়।
পূর্ণিমা কি পর্যবেক্ষণ করা উচিত?
পূর্ণিমার সময় সূর্যের আলো চাঁদের পৃষ্ঠে সরাসরি পড়ে, ফলে ছায়া প্রায় থাকে না। এতে পর্বত, খাদ বা টেক্সচারগুলো কিছুটা মøান দেখায়। তাই অনেক জ্যোতির্বিজ্ঞানী ক্রিসেন্ট বা গিব্বাস দশায় চাঁদ দেখতে বলেন। এই সময়ই ছায়া তৈরি হয় এবং টার্মিনেটর (Terminator-আলোকিত ও অন্ধকার অংশের মধ্যবর্তী সীমানা) ভূসংস্থানিক বৈশিষ্ট্যগুলোকে বিশেষভাবে ফুটিয়ে তোলে। তবে পূর্ণিমার সৌন্দর্য একেবারে অন্যরকম, বিশেষ করে চাঁদের উদয়, রশ্মি (Rays), হ্যালো বা চন্দ্রগ্রহণের মতো ঘটনাগুলো তখনই উপভোগ করা যায়। এই নির্দেশিকায় কীভাবে পূর্ণিমা চাঁদ উদ্যাপন করা যায়, কীভাবে একে সর্বোত্তমভাবে পর্যবেক্ষণ এবং কী কী দেখা যেতে পারে, তা প্রকাশ করবে।
পূর্ণিমা পর্যবেক্ষণের কৌশল ও দেখার বিষয়
‘পূর্ণিমার চাঁদ’ আমরা সহজেই এড়িয়ে যাই- অনেক সময় একে একটি স্বতন্ত্র মহাজাগতিক ঘটনা হিসেবে গণ্য না করে কেবল ঘটনাক্রমে উঁকি দিলে দেখতে পাই। যদি আপনি পরিষ্কার সন্ধ্যায় দিগন্তসহ একটি পর্যবেক্ষণ স্থানে যেতে পারেন, তবে চাঁদ ওপরে ওঠার সময় অনেক আকর্ষণীয় ঘটনা চোখে পড়বে।
♦ চন্দ্রমায়া : একটি ঘটনা যা বেশির ভাগ মানুষকে থমকে দেয়-দিগন্তের কাছে চাঁদের ডিস্কটিকে আকাশের ওপরে ওঠার পরের আকারের চেয়ে অনেক বড় দেখায়। এটি বিখ্যাত ‘চন্দ্রমায়া’ নামে পরিচিত।
♦ বায়ুমন্ডলীয় প্রতিসরণ : বায়ুমন্ডলীয় প্রতিসরণের কারণে চাঁদের ডিস্কের কিনারগুলো ‘ঢেউ খেলানো’ এবং চাঁদের ডিস্কটিকে সামান্য ‘চ্যাপ্টা’ দেখায়। ছোট টেলিস্কোপ বা ভালো দুরবিন দিয়ে এটি বিশেষভাবে চোখে পড়ে।
♦ বেল্ট অব ভেনাস : আকাশ যদি সত্যিই পরিষ্কার থাকে, তবে গোধূলির সময় অস্তগামী সূর্যের প্রতিফলিত গোলাপি আলোর নিচে লালচে পূর্ণিমা চাঁদ উঠতে দেখা এক দারুণ পর্যবেক্ষণ স্মৃতি তৈরি করতে পারে।
চাঁদের রশ্মি দেখুন
এক ধরনের চান্দ্র বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যা পূর্ণিমা রাতে সত্যিই ঝলমলে দেখায়। এগুলো রে ইজেক্টা সিস্টেম (Ray Ejecta Systems) নামে পরিচিত এবং এটি ফটোগ্রাফির জন্য চমৎকার লক্ষ্যবস্তু। এগুলো নির্দিষ্ট খাদগুলো থেকে উজ্জ্বল ফিতের মতো ছড়িয়ে পড়তে দেখা যায় এবং এগুলো হলো সেই সব বস্তু যা তীব্র সংঘর্ষের ফলে তৈরি হওয়া এই পৃষ্ঠের ক্ষতগুলো থেকে ছিটকে বেরিয়ে এসেছিল।
Tycho বা Copernicus খাদের মতো বিস্তৃত রে সিস্টেমগুলো ৩০০-৪০০ মিমি ফোকাল লেন্থের লেন্স বা ছোট টেলিস্কোপের সঙ্গে সংযুক্ত একটি DSLR ক্যামেরা দিয়ে সহজেই তোলা যায়। ওয়েবক্যাম বা উচ্চ ফ্রেম রেট CCD ক্যামেরাসহ একটি সাধারণ টেলিস্কোপ ব্যবহার করে কোপারনিকাস (Copernicus) এবং প্রোক্লাস (Proclus)-এর মতো খাদগুলোর আশপাশে রে-ইজেক্টার জটিলতা এবং অস্বাভাবিক আকার ক্যাপচার করা যায়।
চাঁদের লুকানো অংশ দেখুন
চাঁদ পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করার সময় সর্বদা ঠিক একই মুখ দেখায় না। কক্ষপথে ঘোরার সময় এটি যেন সামান্য টলমল করে। এর ফলে চাঁদের প্রান্তের যে অংশগুলো সাধারণত আমাদের কাছ থেকে অদৃশ্য থাকে, সেগুলো মাঝে মাঝে আমাদের দিকে ঘুরে আসে। এই ঘটনাটি লুনার লিব্রেশন (lunar libration) নামে পরিচিত এবং এটি এমন খাদ ও অন্যান্য পৃষ্ঠের বৈশিষ্ট্যগুলোকে দৃষ্টির আওতায় আনতে পারে, যা সর্বদা দৃশ্যমান নয়। সুতরাং, পূর্ণিমার আশপাশের রাতে যখন চাঁদ উজ্জ্বলভাবে জ্বলছে, তখন আপনার টেলিস্কোপ বের করে দেখতে ভুল করবেন না। যদিও মনে হতে পারে টার্মিনেটরের শুধু একটি সংকীর্ণ ফালি দেখার আছে, তবে লিব্রেশনের কারণে কোনো বিশেষ বৈশিষ্ট্য অধ্যয়নের জন্য ভালো অবস্থানে আসতে পারে। Pzthagoras, Grimaldi Ges Mare Humboldtianum-এর মতো বৈশিষ্ট্যগুলো লিব্রেশন থেকে উপকৃত হয়।
চাঁদের চারপাশের প্রভা দেখুন
উঁচু, পাতলা বরফমেঘের কারণে চাঁদের আলো প্রতিসরিত হয়ে চারপাশে আলোর বলয় তৈরি করে, যা ২২° হ্যালো নামে পরিচিত।
♦ এটি একটি বরফের হ্যালো, যা কখনো ম্লান, কখনো উজ্জ্বল হয়।
♦ হাতের মাপ ব্যবহার করে হ্যালোর পরিধি যাচাই করা যায়-চাঁদ ঢেকে রাখলে যদি আপনার বুড়ো আঙুল হ্যালোর কিনার ছোঁয়, তবে সেটিই ২২ক্ক হ্যালো।
♦ এ ছাড়া লুনার করোনা দেখা যায়, যা জলীয় কণার কারণে তৈরি বর্ণিল বলয়।
মুনডগস ও মুনবো
পূর্ণিমার বিরল কিন্তু মনোমুগ্ধকর দৃশ্য হলো মুনডগস বা প্যারাসেলিনি, যা বরফের স্ফটিকের মাধ্যমে আলোর প্রতিসরণে তৈরি উজ্জ্বল বিন্দু। এগুলো দিনের বেলায় দেখা ‘সানডগস’র মতোই, তবে এগুলো প্রায়ই যথেষ্ট মøান হওয়ার কারণে সহজে চোখে পড়ে না। এগুলো সাধারণত ২২ক্ক হ্যালোর দুই পাশে দেখা যায়। বৃষ্টির পর মাঝে মাঝে দেখা যায় মুনবো-চাঁদের আলোয় তৈরি রংধনু, যা ফটোগ্রাফারদের জন্য এক অনন্য দৃশ্য।
পূর্ণিমায় চন্দ্রগ্রহণ দেখা
পূর্ণিমার রাতে চন্দ্রগ্রহণ হলে তা দেখার মতো মহাজাগতিক অভিজ্ঞতা। পৃথিবীর ছায়া যখন ধীরে ধীরে চাঁদের ওপর পড়ে, তখন এটি রুপালি থেকে তামাটে-লাল রঙে রূপান্তরিত হয়। পূর্ণগ্রাসের সময় আকাশ অন্ধকার হয়ে ক্ষীণ তারাগুলো দৃশ্যমান হয়, যা জ্যোতির্বিজ্ঞানপ্রেমীদের জন্য এক অবিস্মরণীয় মুহূর্ত হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে।
তথ্যসূত্র : স্কাইনাইট ম্যাগাজিন