শুক্রবার, ৩ অক্টোবর, ২০১৪ ০০:০০ টা

জাতীয়তাবাদের সীমা

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

জাতীয়তাবাদের সীমা

'জাতীয়তাবাদের সীমা' শীর্ষক রচনাটি বাংলাদেশ প্রতিদিন ঈদ সংখ্যায় ছাপা হয়েছিল। পাঠকের অনুরোধে লেখাটি ধারাবাহিকভাবে শুক্রবার রকমারি পাতায় পুনঃমুদ্রিত হচ্ছে। আজ ছাপা হলো সপ্তম পর্ব-

আর এটাও তো দেখা যাচ্ছে উপন্যাসে যে, সন্তানরা যদিও বলতে চাচ্ছে যে ঘটনাটা হচ্ছে, তাদের ভাষায়, 'হিন্দু মোছলমানে মারামারি', কিন্তু ইংরেজের চোখে সন্তানরা অন্যকিছু নয়, rebel ভিন্ন। তৃতীয় খণ্ডের দ্বিতীয় পরিচ্ছেদে পুরুষের ছদ্মবেশধারিণী সন্ন্যাসিনী শান্তির সঙ্গে ইংরেজ ক্যাপ্টেনের কথোপকথন হয়েছে। বিবরণটি এই রকমের :

ক্যাপ্তেন সাহেব দেশি ভাষা বিলক্ষণ জানিতেন, বলিলেন,

'টুমি কে?'

সন্নাসী বলিল, 'আমি সন্ন্যাসী'।

কাপ্তেন বলিলেন, 'টুমি rebel।'

সন্ন্যাসী। সে কি?

কাপ্তেন। হামি টোমায় গুলি করিয়া মাড়িব।

এরপর সন্ন্যাসিনী সাহেবকে সশরীরে আক্রমণ করে এবং করতে গিয়ে নিজের ছদ্মবেশ খুলে ফেলে। ঔপন্যাসিক বঙ্কিমচন্দ্র ইতিহাসকে যে ছদ্মবেশ সজ্জিত করতে চাচ্ছিলেন, সেটা অবশ্য খুলে পড়েনি, ঘটনাপ্রবাহের অতটা শক্তি ছিল না, তবে ইতিহাসের গায়ে চাপানো ওই ছদ্মবেশটি অক্ষত রাখতে ঔপন্যাসিককে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছে। ছদ্মবেশের সঙ্গে খাপখাওয়াতে গিয়ে ঐতিহাসিক সত্যের ওপর হস্তক্ষেপ না করে উপায় থাকেনি।

ইতিহাস আর উপন্যাস যে এক বস্তু নয় সেটা খুবই সত্য। কিন্তু ঐতিহাসিক উপন্যাস লিখতে গিয়ে বঙ্কিমচন্দ্র এভাবে তার বিকৃতি ঘটানোর কষ্টটা করতে গেলেন কেন? আগেই উল্লেখ করেছি যে কারণ হলো শ্রেণীগত স্বার্থহানির ভয়। কৃষক বিদ্রোহকে কৃষক বিদ্রোহ হিসেবেই চিত্রিত করলে কৃষকরা বিপ্লবী তৎপরতায় অনুপ্রাণিত হতে পারে এমন শঙ্কা। স্মরণীয় যে, নাটক হিসেবে মীর মশাররফ হোসেনের জমিদার-দর্পণের প্রশংসা করা সত্ত্বেও নাট্যকারকে বঙ্কিম পরামর্শ দিয়েছিলেন বইটির প্রচার বন্ধ রাখতে। কারণ সে সময়ে কোথাও কোথাও কৃষক বিদ্রোহের লক্ষণ দেখা যাচ্ছিল। বিপজ্জনক জ্ঞান করে বঙ্কিম তার নিজের লেখা সাম্য পুস্তিকাটি প্রচার থামিয়ে দিয়েছিলেন। বইটি জনপ্রিয় হয়েছিল; সেই জনপ্রিয়তাই বইটির জন্য কাল হয়েছিল। ইতিহাসকে বিকৃত করার পেছনে অবশ্য একটা ব্যক্তিগত ভয়ও ছিল। সেটা খুবই বাস্তবিক। ভয় ছিল ইংরেজকে শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করলে কেবল শ্রেণীগত নয়, ব্যক্তিগত বিপদও ঘটবে। বিপদ যে ঘটেনি তাও নয়। ইংরেজ খুশি হয়নি। আনন্দমঠ নিষিদ্ধ হয়ে যাবে এমন আশঙ্কা দেখা দিয়েছিল। হতে পারে ওই বিপদও একটি কারণ যার জন্য ইতিহাসের সুস্পষ্ট নিষেধ সত্ত্বেও শত্রু হিসেবে মূল ইংরেজকে সামনে না এনে মুসলমানকে আনাটাকে আবশ্যক মনে করেছেন। অথচ মুসলমান তখন মৃত ঘোড়া বৈ নয়, সেই ঘোড়াকে প্রহার করায় ঘোড়ার মালিক বলে যাদের অভিমান তারা বিরূপ হয়েছে, 'বন্দে মাতরমে'র বিপরীতে তারা আওয়াজ তুলেছে আল্লাহ হো আকবরের। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করতে হয়, বঙ্কিম মনে হয় মুসলমানদের উত্থিত আল্লাহ হো আকবর আওয়াজটা ভালোভাবে শোনেননি; তাই শুনতে পেয়েছেন 'মুসলমানেরা বলিতে লাগিল' 'আল্লা আকবর'। তিনি এটাও দেখতে পেয়েছেন যে মুসলমানেরা বাংলাও ঠিক মতো বলতে পারে না, তাদের বাংলা বিকৃত, যেমন, তারা নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলছে : 'এত্না রোজের পর কোরানশরিফ বেবাক্ কি ঝুঁটো হলো; মোরা যে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ করি, তা এই তেলককাটা ফতে করতে নারলাম।' দেখা যাচ্ছে বাঙালি কৃষক বাঙালি হয়েও বাংলা জানে না, মিশ্র বাংলায় কথা বলে। এটাও ইতিহাসকে দুমড়ে দেওয়ার চেষ্টা। কেননা হিন্দু কৃষক আর মুসলমান কৃষকের ছিল অভিন্ন দশা, তারা মাতৃভাষা ভিন্ন অন্য ভাষা জানতো না।

[প্রকৃত ইতিহাস নিয়ে লিখলে অর্থাৎ সন্ন্যাসী বিদ্রোহকে ইংরেজের বিরুদ্ধে হিন্দু মুসলমানের মিলিত যুদ্ধ হিসেবে দেখালে ইংরেজ যে চটতো সে আশঙ্কা ঔপন্যাসিকের মনে যে কার্যকর ছিল তার প্রমাণ পাওয়া যায় বঙ্কিমের নিজের একটি উক্তিতে। সাধারণ বিরূপতার ভেতরেও সিপাহীদের অভ্যুত্থান তার জাতীয়তাবাদী চেতনায় দাগ কেটেছিল, বিশেষ করে ঝাঁসীর রানীর বীরত্বের তিনি প্রশংসা করেছেন, তাকে নিয়ে লিখবেন এমনও ভেবেছিলেন, কিন্তু সাহস করেননি, [ চলবে ]

 

 

 

সর্বশেষ খবর