সুদূর অতীতে ইতালিতে শুরু হয় ব্যাংকিং ব্যবস্থা। তবে নোটের ব্যবহার শুরু হয় অনেক পরে। চীনের ইউয়ান সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা কুবলাই খান প্রথম কার্যকরভাবে কাগজের নোট চালু করেন। যার নাম ছিল জিয়াওজি। প্রকৃতপক্ষে কারেন্সি নোটের প্রথম প্রবর্তক হিসেবে কৃতিত্বের দাবি রাখে চীন। তারাই পৃথিবীর অন্যান্য অংশে মুদ্রা প্রচলনের পথকে সুগম করে। তবে ইতিহাস বলে ধাতব মুদ্রার আমলেও জালিয়াতি হয়েছে। উন্নত রাষ্ট্রের যাত্রা শুরু থেকেই নোটের প্রচলন হয় আর তার সঙ্গে চলে নোট জালিয়াতির মতো অপকর্মটি। আজকের পৃথিবীর উন্নত দেশ থেকে শুরু করে অনুন্নত দেশ পর্যন্ত জাল নোটের ছড়াছড়ি। জাল নোটের বিস্তার যে কোনো দেশের অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড ভেঙে দিতে সক্ষম। এ অবস্থা থেকে মুক্তি পাওয়ার একমাত্র উপায় সচেতনতা। সচেতনতা বাড়াতে বিশ্বখ্যাত কারেন্সি টেকনোলজিস্ট ড. জালাল উদ্দিনের পরামর্শে টাকা চেনার উপায় নিয়ে আজকের রকমারি।
জাল নোট শনাক্তের প্রেরণা
স্বাধীনতার কয়েক বছর পর উচ্চশিক্ষার উদ্দেশে ঢাকায় আসেন ড. মোহাম্মদ জালাল উদ্দিন। হঠাৎই চোখে পড়ে সদরঘাট লঞ্চঘাটে এক বৃদ্ধ অন্ধ ভিখারী ১ টাকার একটি নোট নিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েছেন। তিনি বৃদ্ধর কাছে গিয়ে কারণ জানতে চাইলেন। বৃদ্ধ ১ টাকার নোটটি দিয়ে বলেন, ‘একজন আমার খুচরা পয়সা নিয়ে এই জাল নোট ধরিয়ে দিয়ে গেছে। আমি এখন এই টাকা দিয়ে কী করব।’ কথাটি শুনে জালাল উদ্দিনের মনে গভীর রেখাপাত করে। বৃদ্ধের জন্য ভীষণ মায়া হয়। তখনই সিদ্ধান্ত নেন, এমন কিছু করতে হবে যাতে জাল নোট শনাক্ত সহজ হয়। এভাবে আর কাউকে যেন জাল নোটের ধোঁকায় পড়তে না হয়। সেই চিন্তার ফল তার লিখিত ‘টাকা চেনার সহজ উপায়’ বইটি। এটি বিশ্বে কারেন্সি টেকনোলজির ওপর লিখিত প্রথম বই। শুধু দেশেই নয় বিশ্বের বহু দেশে তিনি টাকা চেনার উপায় ও জাল নোট শনাক্ত সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দেন। আলহাজ ড. মোহাম্মদ জালাল উদ্দিনের জন্ম ১৯৫৯ সালের ৪ জানুয়ারি চাঁদপুর জেলার মতলব থানাধীন লুধুয়া গ্রামে। বাবা মরহুম আলহাজ মোহাম্মদ ছায়েদ আলী মা মরহুমা আলহাজ আমেনা বেগম। টাকা শনাক্তকরণ ও এর খুঁটিনাটি বিষয়ে জানার আগ্রহ থেকেই জালাল উদ্দিন মার্কেটিং বিষয়ে এমবিএ এবং কারেন্সি টেকনোলজির ওপর পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। মূলত সিকিউরিটি প্রিন্টিং ভিত্তিক ব্যবসার মাধ্যমে তিনি তার ক্যারিয়ার শুরু করেন। তীক্ষ মেধা ও কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে অল্প সময়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ঈর্ষণীয় সফলতা অর্জন করেন। ব্যাংক নোট প্রিন্টিং জগতে তিনি একজন বিশ্বখ্যাত কারেন্সি টেকনোলজিস্ট হিসেবে পরিচিত। বিশ্বসেরা কোম্পানিগুলোর সঙ্গে কারেন্সি টেকনোলজির ওপর দীর্ঘদিন নিবিড়ভাবে কাজ করেছেন। জাল নোট প্রতিরোধে বিশ্বের বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে তিনি সক্রিয়ভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। এ বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে গোটা বিশ্বে যেসব কর্মসূচি নেওয়া হচ্ছে তার অগ্রদূত হিসেবে জালাল উদ্দিন সবার কাছে পরিচিত। জাল নোট বিষয়ে শিক্ষা, সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক ও বিআইবএম কর্তৃক আয়োজিত ঢাকা, খুলনা, রংপুর ও চট্টগ্রামে অনুষ্ঠিত সেমিনারগুলোতে তিনি প্রধান টেকনিক্যাল বিশেষজ্ঞ হিসেবে উচ্চপদস্থ ব্যাংকারদের প্রশিক্ষণ দেন। তিনি বিশ্বে প্রথম জাল নোট প্রতিরোধ বিষয়ক আন্তর্জাতিক সেমিনার সফলভাবে আয়োজন করেন। সেমিনারে ২৫টি দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিনিধিসহ দেশের ৫৪টি ব্যাংকের ১৮৬৫ জন ব্যাংক কর্মকর্তা অংশগ্রহণ করেন। বর্তমানে তিনি আইএসিএ, আইসিসিওএস এবং ডব্লিউসিএও নামক বিশ্বখ্যাত কারেন্সি বিষয়ক আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ পদে আছেন।
বাজারে যত প্রকার ব্যাংক নোট
ব্যাংক নোট বলতে এক ধরনের বিনিময় উপাদান বুঝায় যা কোনো ব্যাংক বা আর্থিক কর্তৃপক্ষ কর্তৃক এই মর্মে দেওয়া একটি প্রতিশ্রুতিপত্র যে, চাহিবামাত্র এর বাহককে সমমূল্য পরিশোধের প্রতিশ্রুতি প্রদান করা হবে। যখন আর্থিক ব্যাংক নোট চালু করা হয় তখন এর মূল্য স্বর্ণ বা রুপায় পরিশোধের প্রতিশ্রুতি ছিল। কিন্তু কালক্রমে তা ওই মুদ্রার বিকল্প এবং এক ধরনের মানিতে রূপ নেয়। অতীতে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো ব্যাংক নোট ইস্যু করতে পারত। বর্তমানে অধিকাংশ দেশ নোট প্রচলনের দায়িত্ব তাদের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওপর থাকে। অতীতে ব্যাংকগুলো গ্রাহকদের উপস্থাপিত নোটের চাহিদা অনুযায়ী তা সরবরাহ করতে ব্যস্ত থাকত। প্রচলিত রীতিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো নোটের বিনিময়ে সোনা বা রুপার ব্যাকআপ সংরক্ষণ করত। বর্তমানে বেশিরভাগ দেশ এই রীতি অনুসরণ করে না। বর্তমানে প্রচলিত ব্যাংক নোট তিন প্রকার। আসল নোট, নকল নোট, সুপার নোট। এবার জেনে নেওয়া যাক প্রচলিত এসব নোটের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে।
আসল নোট
আসল নোট কোনো দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক অথবা ক্ষমতাপ্রাপ্ত অন্য কোনো কর্তৃপক্ষ ইস্যু করে থাকে। এতে নির্ধারিত কিছু বৈশিষ্ট্য ও গুণের উপস্থিতি থাকে। এগুলো বিভিন্ন মূল্যমানের এবং বিভিন্ন আকৃতির হয়। সম্ভাব্য সব নিরাপত্তা বৈশিষ্ট্য এই নোটে থাকে।
নকল নোট
দেশের প্রচলিত বৈধ নোট বা মুদ্রার আদলে অবিকল নোট বা মুদ্রা তৈরি করে সংশ্লিষ্ট দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক বা মনিটরি কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ছাড়া বাজারে চালু করে মূল্যলাভ করাকে নোট জালকরণ বলে। জালকরণ করে নোট বা মুদ্রার সমমূল্য অথবা অধিক মূল্য প্রাপ্তিও ঘটতে পারে। উল্লেখ্য, নিম্নমানের নোটকে ব্লিচিং অথবা অন্য কোনো কেমিক্যাল দিয়ে ঘষে তাতে উচ্চমূল্যমান সংযোজন করে তা বাজারে চালু করে অধিক মূল্যলাভের ঘটনাও ঘটে। জানা যায়, ধাতব মুদ্রা আমলেও মুদ্রা জাল হতো। মুদ্রা জালকরণ একটি গুরুতর অপরাধ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানি, যুক্তরাজ্য এবং যুক্তরাষ্ট্রের কারেন্সি নকল করে ওই দেশের বাজারে ছড়িয়ে তাদের অর্থনীতিতে ধস নামিয়ে দেওয়া হয়েছিল।
সুপার নোট
আমরা আসল ও নকল নোটের সঙ্গে পরিচিত। কিন্তু সুপার নোটের সঙ্গে হয়তো অনেকেই পরিচিত নয়। জাল নোট ও আসল নোটের অবয়ব আপাতদৃষ্টিতে হুবহু এক। এর চরিত্র, আকার, আকৃতি, নিরাপত্তা, বৈশিষ্ট্য ইত্যাদি আসল নোটের সঙ্গে শতকরা ৯৯.৯৯ শতাংশ পর্যন্ত মিলিয়ে ফেলা সম্ভব। এখানে যেসব নোট সব বিষয়ে শতকরা ১০০ ভাগ আসল নোটের মতো, ছাপানোও আসল মুদ্রণ প্রক্রিয়ায় কিন্তু উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া বাজারে এসেছে। সেই ধরনের নোটকেই সুপার নোট বলা হয়ে থাকে। বিশ্বের কিছু দেশে জাল নোটের চেয়ে সুপার নোট বেশি ভয়ঙ্কর। তাই যে কোনো দেশের কর্তৃপক্ষকে জাল নোটের পাশাপাশি সুপার নোটের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। কারণ জাল নোট সহজেই শনাক্ত করা যায় কিন্তু সুপার নোট শনাক্ত করা প্রায় অসম্ভব। এমনকি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নোট শনাক্তকারী নোট শর্টিং মেশিনের মাধ্যমেও এটি শনাক্ত করা সম্ভব হয় না।
আসল বনাম নকল নোট
নকল নোট সব সময়ই বিশ্বজুড়ে আসল নোটের জন্য অস্বস্তিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করে। মাঝে মাঝে এ দুটির মাঝে পার্থক্য নির্ধারণ করা কষ্টকর হয়। কিন্তু তারপরেও আসল নোট সবসময় আসলই থাকে। নকল নোট কখনো আসল হয় না। কারণ উভয়ের মাঝে বেশকিছু পার্থক্য থাকবেই। কালার ফটোকপিয়ার বা স্ক্যানারের মাধ্যমে আসল নোটের সদৃশ নোট বানানো যাবে। কিন্তু যখনই নকল নোট বিশ্লেষণ করা হবে বা তার ওপর আলোকসম্পাত করা হবে তখনই সেগুলো যে নকল তা বোঝা যায়। কারণ সূক্ষ্ম বৈশিষ্ট্যগুলো ফুটে ওঠে।
নোট জালকরণে প্রতিরোধ ব্যবস্থা
নোটের জালকরণ একটি সুষ্ঠু বৈশ্বিক অর্থব্যবস্থার জন্য বিরাট হুমকি স্বরূপ। যখন প্রথম নোটের প্রচলন শুরু হয় তখন থেকেই জাল নোটের প্রচলন হয়। এগুলো অর্থনীতির জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। দেশের জনগণ তাদের ক্রয় বিক্রয় কাজে সাধারণত নোট ব্যবহার করে থাকে। কিন্তু অসাধু লোকেরা ব্যবসা বাণিজ্যের সময় আসল নোটের সঙ্গে নকল নোট মিশিয়ে অবৈধভাবে অর্থ উপার্জনের ধান্দা করে। জাল নোটের হ্রাসকরণ বা এর মূলোত্পাটনের জন্য এ ধরনের নোটের বিরুদ্ধে জনসচেতনতা গড়ে তোলা আবশ্যক। তার আগে জাল নোটের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে জানা আবশ্যক।
— আসল নোটের বুনিয়াদি কোনো গুণ নকল নোটে থাকে না। দুর্বল মুদ্রণ ও নিচুমানের কাগজ নকল নোটে ব্যবহৃত হয়।
— নকল নোট সরকার কিংবা সরকার কর্তৃক ক্ষমতাপ্রাপ্ত কোনো প্রতিষ্ঠান অনুমোদিত নয়।
— জাল নোট তৈরি ও ব্যবহার দণ্ডনীয় অপরাধ।
— অসেলাক, এজেন্সি অথবা আন্তর্জাতিক চক্র নোট জালকরণের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকে।
একটি দেশের অর্থনীতিতে জাল নোটের প্রভাব অত্যন্ত ক্ষতিকর। নিজের অবস্থান থেকে সচেতনতার ভূমিকা পাল করতে আগেই জেনে নেওয়া যাক জাল নোট আমাদের অর্থনীতিতে কী ধরনের কুপ্রভাব ফেলে।
— অতিরিক্ত জাল নোটের সরবরাহ বাজারে মুদ্রাস্ফীতি সৃষ্টি করে।
— কাগুজে নোটের গ্রহণযোগ্যতা হ্রাস করে।
— অবৈধ ও অনৈতিক কার্যকলাপ বৃদ্ধি পায়
— জালিয়াতির কবল থেকে সুরক্ষার জন্য দৃশ্যমান নিরাপত্তা বৈশিষ্ট্যের দারুণ আবশ্যকতা দেখা দেয়।
— সামাজিক অস্থিরতা অপরাধ, দুর্নীতি মাদকাসক্তি বৃদ্ধি পায়।
— ব্যক্তি তার আসল অর্থ হারিয়ে ফেলে। কারণ তাদের কাছ থেকে প্রাপ্ত জাল নোট বাজেয়াপ্ত হয় কিন্তু ক্ষতিপূরণ পায় না।
— কোম্পানি বাজেয়াপ্ত অর্থের ক্ষতিপূরণ না পেলে পণ্যের দাম বাড়াতে বাধ্য হয়।
— যে কোনো সময় একটি দেশ জাল নোটকে যুদ্ধের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে পারে। এর উদ্দেশ্য হলো জাল নোট ছড়িয়ে শত্রুকে আর্থিক দুর্বল করে দেওয়া।
দেশের প্রতিটি নাগরিকের উচিত জাল নোট প্রতিরোধে সোচ্চার হওয়া। কারণ জাল নোট শুধু দেশের অর্থনীতিকে দুর্বল করে দিচ্ছে না, ব্যক্তিগতভাবে আপনিও যে কোনো মুহূর্তে ক্ষতির শিকার হতে পারেন। তাই একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে প্রতিরোধের উপায় সম্পর্কে জেনে নিতে পারেন।
— কঠোর নিরাপত্তাসংবলিত সংরক্ষিত পরিবেশে নোট মুদ্রণের ব্যবস্থা গ্রহণ।
— পরীক্ষিত বিশ্বমানের নিরাপত্তা বৈশিষ্ট্য নোটে সংযোজন করা।
— ব্যাংক নোট মুদ্রণের উপকরণসমূহ সংগ্রহের উৎস বিশ্বস্ত, গোপনীয়, সীমিত এবং ক্ষেত্রবিশেষে একক হওয়া বাঞ্ছনীয়।
— জনসচেতনতা বৃদ্ধি ও কারেন্সি টেকনোলজি বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রি প্রবর্তন।
— বাণিজ্যিক গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় জাল নোট শনাক্তকরণ কেন্দ্র স্থাপন।
— কেন্দ্রীয় ও বাণিজ্যিক ব্যাংকের আঞ্চলিক কেন্দ্রসমূহে গ্লোবাল কারেন্সি ডায়াগনসিস সেন্টার স্থাপন।
— ক্লিন নোট পলিসি প্রবর্তন করা।
— স্টক ম্যানেজমেন্ট প্রবর্তন ও জাল নোট প্রতিরোধ সপ্তাহ পালন করতে হবে।
কীভাবে চেনা যাবে নোটটি জাল নয়
একটি নোটের সুরক্ষার জন্য জাল-জালিয়াতি প্রতিরোধে সক্ষম বহুবিধ প্রযুক্তিগত প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়। এতে নোটটি সহজে জাল করা যায় না। বাংলাদেশে প্রচলিত নোটে রয়েছে তেমন কিছু বৈশিষ্ট্য। যেমন— জলছাপ, সিকিউরিটি থ্রেড, অপটিক্যালি ভ্যারিয়েবল ইমেজ, স্পার্ক, মাইক্রো টেক্সট, ইন্টাগ্লিও লাইন, ইন্টাগ্লিও প্রিন্ট, শ্যাডো ইমেজ, ব্লাইন্ড এমবসিং, ফ্লুওরেসেন্ট, নন-ভিজিবলম ফাইবার, ইরিডিসেন্ট স্ট্রাইপ, বিশেষ ডিজাইন, বিশেষ ধরনের সাবস্ট্রেট। এবার জেনে নেওয়া যাক প্রত্যেকটি বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে।
জলছাপ
নোটে কোনো বরেণ্য ব্যক্তি, প্রাণী, বা বস্তুর প্রতিকৃতি হিসেবে যা নোটে সংযোজন করা হয়। আমাদের দেশের নোটে সর্বশেষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতি রয়েছে।
নিরাপত্তা সুতা
সিকিউরিটি থ্রেড বা নিরাপত্তা সুতাটি থাকে নোটের ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত উল্লম্বভাবে। এটি গোটা বিশ্বে একটি প্রকাশ্য বৈশিষ্ট্য হিসেবে পরিচিত।
রং পরিবর্তনশীল প্রতিকৃতি
অপটিক্যালি ভ্যারিয়েবল ইমেজ বা রং পরিবর্তনশীল প্রতিকৃতি একটি অত্যন্ত নিরাপত্তা বৈশিষ্ট্য যা বর্তমান বিশ্বে ১২৪টির বেশি দেশে ব্যবহার করছে। নোটের ওপর থাকা এই প্রতিকৃতি দেখে কয়েক মুহূর্তেই আসল টাকা চেনা যায়। আমাদের দেশে ১০০০, ৫০০ এবং টাকার নোটের কোণায় উপরের দিকে এই সংখ্যাগুলো রং পরিবর্তনশীল প্রতিকৃতির মাধ্যমে লেখা।
স্পার্ক
স্পার্ক হলো অত্যন্ত বিস্ময়কর এবং নব আবিষ্কৃত দৃষ্টিনন্দন নিরাপত্তা বৈশিষ্ট্য। এর নকল করা প্রায় অসম্ভব। এই বৈশিষ্ট্যের মাধ্যমে যে কেউ নোটের সঠিকতা যাচাই করতে পারে। এই বিবেচনায় বিশ্বের অনেক দেশের ব্যাংক নোটেই উভয় বৈশিষ্ট্য সংযোজন করা হয়েছে।
মাইক্রো টেক্সট
মাইক্রো টেক্সট সাধারণত মেশিনের সাহায্যে পঠনযোগ্য অদৃশ্য বৈশিষ্ট্য। খালি চোখে এটি দেখা যায় না। আমাদের ব্যাংকনোটগুলোর কর্নারে লেখা সংখ্যার মাঝে ছোট করে বাংলাদেশ অথবা কিছু ক্ষেত্রে সংখ্যায় মাইক্রো টেক্সট থাকে।
ইন্টাগ্লিও লাইন
নোটের ডানদিকে তীর্যকভাবে ৭টি সমান্তরাল লাইন থাকে যেগুলো ইন্টাগ্লিও কালি দিয়ে মুদ্রিত। একে ইন্টাগ্লিও লাইন বলে। এটি অনুভূতি প্রবণ পাবলিক সিকিউরিটি ফিচার। হাতের স্পর্শে এই লাইন উঁচুনিচু বা খসখসে লাগে। অন্ধকারেও এটি সমান কার্যকরী। তাই এটি অন্ধদের জন্য অত্যন্ত উপকারী।
ইন্টাগ্লিও প্রিন্ট
এতে নোটের ওপর শক্ত ও অমসৃণ স্পর্শানুভূতি সৃষ্টি করে। আমাদের দেশে প্রচলিত ৫০০ টাকার নোটে পাঁচ শত টাকা, বাংলা ও ইংরেজিতে বাংলাদেশ ব্যাংক, সংখ্যায় ৫০০ এবং পেছন পাশের দৃশ্যের প্রিন্ট ইন্টাগ্লিও পদ্ধতিতে। এটি স্পর্শ করলে উঁচু টের পাওয়া যায়।
শ্যাডো ইমেজ
নিরাপত্তা বৈশিষ্ট্যের আরেকটি ধাপ শ্যাডো ইমেজ। এটি একই সঙ্গে দৃশ্য ও অদৃশ্যমান নিরাপত্তা ইমেজ। টাকার প্রান্তগুলোতে ফুলের ছবি বা নকশা হিসেবে থাকে।
ইনফ্রাইয়েড ফিচার
ইনফ্রাইয়েড ফিচার হলো একটি অদৃশ্য নিরাপত্তা বৈশিষ্ট্য। অতি বেগুনি রশ্মি যদি এই ফিচার সংবলিত নোটের ওপর ফেলা হয় তাহলে সুপ্ত ফিচারগুলো জ্বল জ্বল করে। পৃথিবীর অনেক দেশে এই ফিচারগুলো ব্যবহার হয়। এটি যেহেতু মেশিনে পঠনযোগ্য তাই এটি ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত।
অদৃশ্য ফাইবার
অদৃশ্য ফাইবার বা রঙিন ফাইবার কাগজের অভ্যন্তরে খচিত থাকে। তবে ওই ফাইবার অদৃশ্য থাকে। উল্লেখ্য, গঠন প্রক্রিয়ায় ওইসব ফাইবারের কিছু সংখ্যক থাকে কাগজের গভীরে আর কিছু থাকে কাগজের উপরিতলে। সহজ অনুকরণের দ্বারা বর্ণিত এই আবহটি সৃষ্টি করা সম্ভব নয়। পুরো নোটজুড়ে ছোট ছোট কিছু আঁঁকিবুঁকি যা অতি বেগুনি রশ্মি ছাড়া দেখা যায় না।
ইরিডিসেন্ট স্ট্রাইপ
নোটের পেছনে রয়েছে ইরিডিসেন্ট স্ট্রাইপ। এটি একধাতু অথবা দ্বিধাতু সংবলিত একটি স্ট্রাইপ। খালি চোখে দেখলে দেখা যাবে এখানে কয়েকটি স্ট্রাইপের ঢেউ খেলানো প্রিন্ট। এটি উঁচুনিচু করলে রং পরিবর্তন ঘটে। এটি সাধারণ নোটের বিশেষ একাংশে সংযোজিত হয়। নোটের সঠিকতা নির্ধারণে সাধারণ মানুষকে সহায়তা করে।
বিশেষ ডিজাইন
দেশে প্রচলিত নোটে একটি দেশের আচার ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট, উত্তরাধিকার, রীতিনীতি, ইত্যাদি থাকতে পারে। আমাদের দেশের ব্যাংক নোটেও মসজিদ, লাঙ্গল চাষ, মাছ ধরতে যাওয়ার দৃশ্য, সোনালি আঁশ পাট ধোয়ার দৃশ্য, সংসদ ভবন সেতু ইত্যাদি আছে।
কমন নিরাপত্তা বৈশিষ্ট্য
বিশ্বের প্রতিটি দেশেই নোটের জাল ঠেকাতে এবং নোটটি বৈশিষ্ট্যপূর্ণ করতে কিছু বিষয় থাকে। তা ছাড়া এই নিরাপত্তা বৈশিষ্ট্যগুলো স্বকীয়তা ও নির্ভরযোগ্যতা গুণে পৃথিবীর সব দেশের নোটেই ব্যবহৃত হচ্ছে। সেগুলো হলো— জলছাপ, নিরাপত্তা সুতা, ইনটাগ্লিও প্রিন্ট, মাইক্রো টেক্সট, সি থ্রু ফিচার, ব্লাইন্ড ফিচার ইউভি, ওভিআই।
অন্ধদের টাকা চেনার উপায়
অন্ধদের টাকা চেনার উপায় হিসেবে ব্লাইন্ড এমবসিং নির্দিষ্ট করা হয়েছে। ব্যাংক নোটের একপাশে ব্লাইন্ড ডট সংযোজিত থাকে যা স্পর্শ করলে বোঝা যায়। আমাদের দেশে ১০০০ টাকার নোটে ৫টি, ৫০০ টাকার নোটে ৪টি, ১০০ টাকার নোটে তিনটি, ৫০ টাকার নোটে ২টি এবং ২০ টাকার নোটে ১টি ডট সংযোজিত আছে। এ ছাড়াও নোটের ডানদিকে তীর্যকভাবে ৭টি সমান্তরাল লাইন থাকে যেগুলো ইন্টাগ্লিও কালি দিয়ে মুদ্রিত। একে ইন্টাগ্লিও লাইন বলে। এটি অনুভূতি প্রবণ পাবলিক সিকিউরিটি ফিচার। হাতের স্পর্শে এই লাইন উঁচুনিচু বা খসখসে লাগে। অন্ধকারেও এটি সমান কার্যকরী। তাই এটি অন্ধদের জন্য অত্যন্ত উপকারী। তারা হাতের স্পর্শে এসব বৈশিষ্ট্য খুব সহজে টের পান। এর পাশাপাশি আছে ইন্টাগ্লিও প্রিন্ট। এতে নোটের ওপর শক্ত ও অমসৃণ স্পর্শানুভূতি সৃষ্টি করে। আমাদের দেশে প্রচলিত ৫০০ টাকার নোটে পাঁচ শত টাকা, বাংলা ও ইংরেজিতে বাংলাদেশ ব্যাংক, সংখ্যায় ৫০০ এবং পেছন পাশের দৃশ্যের প্রিন্ট ইন্টাগ্লিও পদ্ধতিতে। এটি স্পর্শ করলে উঁচু টের পাওয়া যায়।
আন্তর্জাতিক কিছু ব্যাংক নোট
দেশের বাইরে চলাচল ও লেনদেনে আপনাকে পরিচিত হতে হয় আন্তর্জাতিক ব্যাংক নোটের সঙ্গে। শুধু দেশেই নয় আন্তর্জাতিক এসব নোটেও চলে জালিয়াতি। আর তাই জেনে নিতে পারেন এসব নোটের সঠিকতা বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে।
মার্কিন ডলার
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কারেন্সিকে ডলার বলা হয়। এটি দাপ্তরিকভাবে স্বীকৃত ফিয়াট মানি। কাগজের পরিবর্তে এটি তৈরি হয় বিশেষ ধরনের ফাইবার সংবলিত সাবস্ট্রেট দিয়ে। ১৭৮৫ সালে ডলারকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একক মুদ্রা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। বর্তমান বিশ্বের সিংহভাগ পণ্য ক্রয়-বিক্রয়ে ডলার দিয়েই হয়ে থাকে। বিশ্বের অধিকাংশ দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডলারকে রিজার্ভ মানি হিসেবে সংরক্ষণ করে। ডলারের জাল নোট ঠেকাতে এতে ব্যবহার হয় জলছাপ, রং পরিবর্তনশীল প্রতিকৃতি, সিকিউরিটি থ্রেড, থ্রিডি সিকিউরিটি, সিরিয়াল নম্বর ইত্যাদি।
ইউরো
২৮টি দেশের সমন্বয়ে গঠিত ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং এই জোনে ব্যবহৃত নোটকে ইউরো বলা হয়। রিজার্ভ কারেন্সি ও মুদ্রা বিনিময়ের দিক দিয়ে মার্কিন ডলারের পরেই ইউরোর অবস্থান। ১৯৯৫ সালের ১৬ ডিসেম্বর ইউরোকে দাফতরিক স্বীকৃতি দেওয়া হয়। ১৯৯৯ সালের ১ জানুয়ারি এটি আন্তর্জাতিক মুদ্রাবাজারে প্রচলিত হয়। ইউরোর সুরক্ষার জন্য ব্যবহৃত নিরাপত্তা বৈশিষ্ট্যসমূহ হলো জলছাপ, অপটিক্যাল ভ্যারিয়েবল ইমেজ, মাইক্রো প্রিন্ট, ফ্লুরোসেন্ট, ম্যাগনেটিক ইনক, সিকিউরিটি থ্রেড, ম্যাটেড সারফেস, ইন্টাগ্লিও প্রিন্ট।
সৌদি রিয়াল
সৌদি আরবের মুদ্রাকে রিয়াল বলা হয়। শুরুতে সৌদি আরবে কেবল ধাতব মুদ্রার প্রচলন ছিল। ১৯৫৩ সালে প্রথম সৌদি অ্যারাবিয়ান মনিট্যারি এজেন্সি হজযাত্রীদের জন্য ১০ রিয়াল মূল্যের কাগজী রসিদের প্রচলন করে। পরবর্তীতে হজযাত্রীদের মুদ্রা বিনিময়ের কথা চিন্তা করে ১৯৬১ সালে ১, ৫, ১০, ৫০ ও ১০০ রিয়াল মূল্যমানের কাগজী নোটের প্রচলন করে। এতেও নিরাপত্তা বৈশিষ্ট্য সংযোজিত আছে। যেমন জলছাপ, সিকিউরিটি থ্রেড, ফয়েল স্ট্রাইপ, মাইক্রো টেক্সট, ফ্লুওরোসেন্ট, ট্যাক্টাইল ফিচার, ব্লাইন্ড ফিচার, কালার শিফটিং ইনক ইত্যাদি।