মহাকাশ নিয়ে মানুষের জানার শেষ নেই। গবেষণা চলছেই। মহাকাশ ভ্রমণের দুঃসাহসিক অভিযানে অংশগ্রহণ করেন বিজ্ঞানীরা। মহাকাশ জয়ের এ অভিযানে অন্যদের পাশাপাশি অবদান রেখেছেন এখন পর্যন্ত ১১ মুসলিম নভোচারী। সুলতান বিন সালমান প্রথম মুসলিম নভোচারী যিনি মহাকাশ ভ্রমণের সৌভাগ্য অর্জন করেন। আর প্রথম মুসলিম নারী আনুশেহ আনসারি মহাকাশ ভ্রমণ করেন। মুসলিম মহাকাশ নভোচারীদের নিয়ে আজকের রকমারি-
বিশ্বের প্রথম নারী মহাকাশ পর্যটক আনুশেহ আনসারি
বিশ্বের অষ্টম ব্যক্তি হিসেবে মহাকাশ পর্যটকের খাতায় নাম লিখিয়েছিলেন আনুশেহ আনসারি। প্রথম মুসলিম নারী হিসেবেও ইরানি এই বংশোদ্ভূত আমেরিকান নাগরিক আনুশেহ আনসারি মহাকাশ ভ্রমণ করেন। ‘সুয়েজ টিএমএ-৯’ মহাকাশযানে ২০০৬ সালের সেপ্টেম্বরে মহাকাশ ভ্রমণ করেন তিনি। তাঁর মহাকাশ যাত্রা ছিল ১৭ দিনের। প্রথম ইরানি-আমেরিকান মুসলিম হিসেবে জর্জ ম্যাসন বিশ্ববিদ্যালয় উদ্যোক্তা অ্যাক্সিলেন্স অ্যাওয়ার্ড ও ইয়াং এন্টারপ্রেনিয়ার অব দ্য ইয়ার অ্যাওয়ার্ডসসহ বিভিন্ন সম্মাননায় ভূষিত হন। আনুশেহ আনসারি প্রোডিয়া সিস্টেমসের সহ-প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান। এর আগে তিনি টেলিকম টেকনোলজির সহ-প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ছিলেন। আনসারি পরিবার আনসারি এক্স প্রাইজের স্পন্সর। ২০০৬ সালে তাঁর ৪০তম জন্মদিনের কয়েক দিন পর তিনি প্রথম মহিলা এবং অষ্টম মহাকাশ পর্যটকে পরিণত হন। তিনিই প্রথম মুসলিম ইরানি মহিলা পর্যটক। মহাকাশে পর্যটক হিসেবে নিয়মিত নারীরা যাতায়াত করবেন সেদিন আর বেশি দূরে নয়। ১৫ বছর আগে বিশ্বের প্রথম নারী মহাকাশ পর্যটক হয়ে সারা বিশ্বে শীর্ষ শিরোনাম হয়েছিলেন আনুশেহ আনসারি। সম্পূর্ণ নিজের টাকায় ছিল তাঁর মহাকাশযাত্রা। প্রায় ২ কোটি ডলার খরচ করে মহাকাশযানের যাত্রী হয়েছিলেন তিনি। ‘মাই ড্রিমস অব স্টার্স’ ১২ থেকে ২৯ সেপ্টেম্বর এই ১৭ দিনের মহাকাশ যাত্রা নিয়ে একটি গ্রন্থও প্রকাশিত হয়েছে।
প্রথম মুসলিম নভোচারী সুলতান বিন সালমান
সুলতান বিন সালমান প্রথম মুসলিম নভোচারী যিনি মহাকাশ ভ্রমণের সৌভাগ্য অর্জন করেন। তিনি প্রথম মুসলিম ও আরব নাগরিক হিসেবে ১৯৮৫ সালের ১৭ জুন ‘এসটিএস-৫১ জি’ মহাকাশযানে এ ভ্রমণ করেন। ১৯৫৬ সালের ২৭ জুন জন্ম নেওয়া সুলতান বিন সালমান মাত্র ২৯ বছর বয়সে মহাকাশ ভ্রমণে সুযোগ পেয়েছিলেন। এর আগে ১৯৮২ সালে সৌদি আরবের তথ্য মন্ত্রণালয়ের আন্তর্জাতিক যোগাযোগ বিভাগে একজন গবেষক হিসেবে নিজের কর্মজীবনের সূচনা করেছিলেন সুলতান। কিন্তু এক জীবনে সুলতান বিন সালমান শুধু নভোচারী কিংবা সেক্রেটারি জেনারেল অথবা গবেষক হয়েই কাটিয়ে দিতে চাননি। বিভিন্ন অলাভজনক সংস্থায় কাজ করেছেন এবং সুনাম কুড়িয়েছেন। বিশেষ করে প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য নিজেকে উজাড় করে দিয়েছিলেন। সে জন্যই ১৯৯৭ সালে সৌদি সরকার তাঁকে জাতীয় প্রতিবন্ধী আইন পরিচালনা কমিটির সভাপতি হিসেবে নিযুক্ত করে। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পদবিতে আসীন ছিলেন তিনি। যার মধ্যে কিং সৌদ বিশ্ববিদ্যালয়ের সোসাইটি ফর আর্কিওলজিক্যাল স্টাডিজের প্রেসিডেন্ট, কিং সৌদ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপদেষ্টা কমিটির প্রতিষ্ঠাতা, পরিচালনা পর্ষদ ও নির্বাহী কমিটির সদস্য, রিয়াদ কিং খালেদ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান অন্যতম। ১৯৮৫ সালে তাঁকে রাজকীয় সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছিল।
দ্বিতীয় মুসলিম নভোচারী মোহাম্মদ ফারিস
সুলতান বিন সালমানের মহাকাশ ভ্রমণের তিন বছর পর আরও একজন মুসলিম মহাকাশ ভ্রমণ করেন। তিনি মোহাম্মদ ফারিস যিনি দ্বিতীয় মুসলিম মহাকাশ নভোচারী হিসেবে স্বীকৃতি পান। ১৯৮৭ সালের ২২ জুলাই ‘মীর ইপি-১’ মহাকাশযানে প্রথম সিরীয় নাগরিক ও দ্বিতীয় আরব হিসেবে এ ভ্রমণ করেন। মহাকাশ ভ্রমণের সময় গুরুত্বপূর্ণ নানা গবেষণায় অংশ নেন মোহাম্মদ ফারিস। তিনি ১৯৫১ সালের ২৬ মে জন্ম নেওয়া ৩৬ বছর বয়সে মহাকাশে পাড়ি জমান। পরে তিনি অর্ডার অব লেলিন, হিরো অব দ্য সোভিয়েত ইউনিয়ন, ফর মেরিট ইন স্পেস এক্সপ্লোরেশন পুরস্কারসহ বিভিন্ন সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তিনি তাঁর অভিজ্ঞতার কথা বলে ছাত্রদের মাঝে বিজ্ঞানের প্রতি উৎসাহ তৈরিতে অবদান রেখে চলেছেন। তিনি গিন্ড আখিলের সঙ্গে বৈবাহিক জীবন অতিবাহিত করছেন।
দুবার মহাকাশ ভ্রমণ করেন মুসা মানারভ
মোহাম্মদ ফারিসের পর ওই একই বছরে মহাকাশ ভ্রমণ করেন মুসা মানারভ। সেই সঙ্গে তৃতীয় মুসলিম মহাকাশ নভোচারী হিসেবে নাম লেখান মুসা মানারভ। তিনিই প্রথম মুসলমান নভোচারী যিনি দুইবার মহাকাশ ভ্রমণ করেছেন। একই সঙ্গে তিনি সবচেয়ে বেশি সময় ধরে মহাকাশ ভ্রমণে অবস্থান করেন। তিনি সর্বমোট ৫৪১ দিন মহাকাশে অবস্থান করেন। মোহাম্মদ মানারভ ১৯৮৭ সালে ‘মীর নিউ-৩’ মহাকাশযানে প্রথমবার এবং দ্বিতীয়বার ১৯৯০ সালে ‘সুয়েজ টিএম-১১’তে মহাকাশ ভ্রমণ করেন। তিনি ১৯৫১ সালের ২২ মার্চ জন্মগ্রহণ করেন। প্রথমবার মহাকাশ ভ্রমণের সময় তাঁর বয়স হয়েছিল ৩৬ বছর। মহাকাশচারী পারিসের মতে, তিনিও হিরো অব দ্য সোভিয়েত ইউনিয়ন ও অর্ডার অব লেনিনসহ বিভিন্ন পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। ব্যক্তিজীবনে তিনি একাকী থাকতেই পছন্দ করেন।
প্রথম আফগান মহাকাশচারী আবদুল আহাদ মোহামান্দ
আবদুল আহাদ মোহামান্দ চতুর্থ মুসলিম যিনি মহাকাশ ভ্রমণ করেছেন। সেই সঙ্গে তিনি প্রথম প্রথম মহাকাশচারী আফগান হিসেবেও খ্যাতি অর্জন করেছেন। ১৯৮৮ সালের ২৯ আগস্ট ‘মীর ইপি-৩’ মহাকাশযানে করে তিনি তাঁর ভ্রমণ সম্পন্ন করেন। ছোটবেলা থেকেই আবদুল আহাদ মোহামান্দ স্বপ্ন দেখতেন এক দিন মহাকাশে পাড়ি জমাবেন। মানুষ তাঁর স্বপ্নের সমান বড়। তিনি তাঁর স্বপ্ন বাস্তবায়ন করেছেন।
১৯৫৯ সালের ১ জানুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন আবদুল আহাদ মোহামান্দ। মহাকাশ ভ্রমণের সময় তাঁর বয়স হয়েছিল মাত্র ২৯ বছর। তিনি মহাকাশে নয় দিন অতিবাহিত করেন। মুসলমান এই মহাকাশ বিজ্ঞানী বরাবরই ধর্মকর্মে গভীর মনোযোগী ছিলেন। তিনিই প্রথম মহাকাশ নভোচারী যিনি মহাকাশে পবিত্র কোরআনুল কারিম নিয়ে ভ্রমণ করেন। পরে তিনি বহু পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন।
কাজাখস্তানের প্রথম মহাকাশচারী তোক্তার আউবাকিরভ
কাজাখস্তানের প্রথম মহাকাশচারী তোক্তার আউবাকিরভ। সেই সঙ্গে তিনি পঞ্চম মুসলিম মহাকাশচারী হিসেবেও খ্যাতি অর্জন করেন। একটু বেশি বয়সে তোক্তার আউবাকিরভ মহাকাশ নভোচারী হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করেন। ভ্রমণের সময় তাঁর বয়স হয়েছিল ৪৫ বছর। তিনি ১৯৯১ সালের ২ অক্টোবর ‘সুয়েজ এম-১৩’ মহাকাশযানে এই ভ্রমণ করেন। ১৯৪৬ সালের ২৭ জুলাই জন্ম নেন তোক্তার আউবাকিরভ। তাঁকে হিরো অব দ্য কাজাখস্তান ও হিরো অব দ্য সোভিয়েত ইউনিয়ন পুরস্কারসহ আরও বেশ কিছু সংস্থা কর্তৃক মহাকাশবিষয়ক নানা সম্মাননায় ভূষিত করা হয়।
৩৪১ দিন মহাকাশে ছিলেন তালগাত মুসাবায়েভ
তালগাত মুসাবায়েভ মহাকাশে অবস্থান করেন ৩৪১ দিন। তিনি কাজাখস্তানের দ্বিতীয় নভোচারী ও ৬ষ্ঠ মুসলিম হিসেবে মহাকাশ ভ্রমণ করেন। তালগাত মুসাবায়েভ দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সময় মহাকাশে অবস্থান করেন। তিনি প্রথম মুসলিম মহাকাশচারী যিনি মোট তিনবার মহাকাশ ভ্রমণ করার সৌভাগ্য অর্জন করেন। তিনি সর্বমোট ৩৪১ দিন ৯ ঘণ্টা ৪৮ মিনিট অবস্থান করেন। মুসাবায়েভ প্রথমবার ১৯৯৪ সালের ৪ নভেম্বর, দ্বিতীয়বার ১৯৯৮ সালের ২৫ আগস্ট এবং তৃতীয়বার ২০০১ সালের ৬ মে মহাকাশ ভ্রমণ করেন। ১৯৫১ সালের ৭ জানুয়ারি জন্ম নেওয়া এই নভোচারী ৪৩ বছর বয়সে প্রথম মহাকাশ ভ্রমণ করেন।
২০১ দিন মহাকাশে ছিলেন সালিজান শারিপভ
সপ্তম মুসলিম নভোচারী হিসেবে রাশিয়ার সালিজান শারিপভ মহাকাশ ভ্রমণ করেন ১৯৯৮ সালের ২০ জানুয়ারি। তিনি ‘এসটিএস-৮৯’ মহাকাশযানে প্রথমবার মহাকাশ ভ্রমণ করেন। এরপর তিনি দ্বিতীয়বারের মতো মহাকাশ ভ্রমণ করে বেশিদিন সেখানে অবস্থানের রেকর্ড অর্জন করেন। তিনি তৃতীয় সর্বোচ্চ ২০১ দিন মহাকাশে অবস্থান করেন। দ্বিতীয়বার ২০০৪ সালের ১৪ অক্টোবরে তিনি মহাকাশ ভ্রমণ করেন। ১৯৬৪ সালের ২৪ আগস্ট জন্ম নেন সালিজান শারিপভ। এ নভোচারী সর্বপ্রথম ৩৪ বছর বয়সে মহাকাশ ভ্রমণ করেছিলেন। স্কুলজীবন থেকেই তিনি মহাকাশচারী হওয়ার ইচ্ছা পোষণ করেছিলেন। হিরো অব দ্য রাশিয়ান ফাউন্ডেশন পুরস্কারসহ বহু পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন তিনি। কিরঘিজ প্রজাতন্ত্রের উজবেক জাতীয়তাবাদী প্রথম মহাকাশ নভোচারীর তালিকায়ও তিনি নাম লেখান।
১০ দিনের বেশি সময় ছিলেন শেখ মুসজাফার
মানিপাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র মহাকাশ নভোচারী মালয়েশিয়ান নাগরিক শেখ মুসজাফার শুকুর। তিনি নবম মুসলিম ব্যক্তি যিনি ২০০৭ সালের ১০ অক্টোবর ‘সুয়েজ টিএমএ-১১’ মহাকাশযানে এ ভ্রমণ করেন। ছোটবেলা থেকেই নিজ ধর্মের প্রতি অনুরাগী ছিলেন নভোচারী মুসজাফার শুকুর। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ নিয়মিত আদায় করেন সব সময়। যেখানেই যান সঙ্গে রাখেন পবিত্র কোরআন। তিনি মহাকাশে সর্বপ্রথম নামাজ আদায় করে বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। মহাকাশে নামাজের দৃশ্য ভিডিও করে তা প্রচার করে আলোচনায় এসেছিলেন গোটা বিশ্বে। ১৯৭২ সালে জন্ম নেওয়া এ মালয়েশিয়ান মহাকাশে ১০ দিন ২০ ঘণ্টা ১৪ মিনিট অবস্থান করেন। তখন তাঁর বয়স ছিল ৩৫ বছর। বিশ্বের নানা দেশ থেকে তাঁকে সম্মাননা ও বহু পুরস্কারে ভূষিত করা হয়।
পবিত্র কোরআন সঙ্গে নিয়েছিলেন হাজ্জা আল-মানসুরি
মুসলিম বিশ্বের সর্বশেষ নভোচারী সংযুক্ত আরব আমিরাতের নাগরিক হাজ্জা আল-মানসুরি। তিনি ‘সুয়েজ এমএস-১৫’ নামক মিশনে ২০১৯ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর মহাকাশ ভ্রমণ করেন। মহাকাশ ভ্রমণে তিনি পবিত্র কোরআন সঙ্গে নিয়ে যান। প্রথম আমিরাতি এবং আরবীয় হিসেবে তিনি মহাকাশ সফর করেন। তিনি আইএসএসে আট দিন অবস্থান করেন। অন্যান্য আন্তর্জাতিক মহাকাশচারীর সঙ্গে তিনি একাধিক বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন। আমিরাতের সেনাবাহিনীর সাবেক পাইলট মানসুরি মহাকাশের উদ্দেশে রওনা হওয়ার আগে তাঁকে একটি ১০ কেজি ওজনের ব্যাগ দেয় মোহাম্মদ বিন রশিদ স্পেস সেন্টার। এ ব্যাগে একটি ১০০ শতাংশ সিল্কের ইউএইর পতাকা, আলগাফ গাছের ৩০টি বীজ, দেশটির প্রতিষ্ঠাতা শেখ জায়েদ আল-নাহিয়ানের একটি ছবি নিয়ে তিনি ভ্রমণ সম্পন্ন করেন।