বৃহস্পতিবার, ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

মহীয়সী নওয়াব ফয়জুন্নেছা

ফারুক আল শারাহ

মহীয়সী নওয়াব ফয়জুন্নেছা

নারী জাগরণ ও নারী শিক্ষার অন্যতম অগ্রদূত নওয়াব ফয়জুন্নেছা চৌধুরানী। যিনি নিজের ব্যক্তিত্ব তুলে ধরেছেন ব্রিটিশ রাজদরবারে। লড়েছেন দেশের জন্যও। নিজের চিন্তাশক্তিকে কাজে লাগিয়েছেন মানুষের জন্য, নারীর জন্য।  তাঁর জমিদারি কাজে লাগিয়েছেন জনহিতকর কাজে। তাঁর হাত ধরে আঠারো শতকে গড়ে উঠেছিল অসংখ্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও মসজিদ-মক্তব। চিকিৎসাসেবা এবং উন্নয়নেও তাঁর অবদান যুগে যুগে স্মরণীয়।  ঊনবিংশ শতকে পূর্ববাংলার মহীয়সী নওয়াব ফয়জুন্নেছাকে নিয়ে আজকের ফিচার...

 

অবদানে-অর্জনে অনন্য

নওয়াব ফয়জুন্নেছা চৌধুরানী নারী জাগরণের অগ্রদূত। অবদান আর অর্জনে মহীয়সী এ নারী ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠাসহ জনকল্যাণমূলক সব ক্ষেত্রেই তিনি অনবদ্য অবদান রেখে গেছেন। উপমহাদেশের একমাত্র নারী নওয়াব ফয়জুন্নেছা চৌধুরানী নারীজগতের উজ্জ্বল নক্ষত্র। ১৮৩৪ সালে তিনি কুমিল্লা জেলার লাকসামের পশ্চিমগাঁও গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বর্তমান সময়ে মহীয়সী নারী হিসেবে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় স্বীকৃত বেগম রোকেয়ার জন্মের সাত বছর আগে অন্ধকার যুগে নারীমুক্তি আন্দোলনের অগ্রদূত নওয়াব ফয়জুন্নেছা চৌধুরানী নারী জাগরণে অনবদ্য অবদান রেখেছেন।

নওয়াব ফয়জুন্নেছা ছিলেন জমিদার আহমদ আলী চৌধুরী ও আরফান্নেছা চৌধুরানীর প্রথম কন্যা। রক্ষণশীল সমাজে জমিদার বাড়ির কড়া পর্দা প্রথার মধ্যে বেড়ে ওঠা ফয়জুন্নেছা চৌধুরানীর কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকলেও তিনি বাংলা, আরবি, ফার্সি ও সংস্কৃত ভাষায় বেশ পারদর্শী ছিলেন। আনুমানিক ১৮৬০-১৮৬১ সালে কুমিল্লার ভাউকসারের জমিদার মোহাম্মদ গাজী চৌধুরীর সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হলেও দুই কন্যাসন্তান জন্মের পর ১৮৬৬ সালে তাঁদের সম্পর্ক বিচ্ছেদ হয়। এরপর ফয়জুন্নেছা পশ্চিমগাঁও পিত্রালয়েই থেকে যান। জীবনের শেষ ৩০ বছর তিনি এখানে থেকেই নারী শিক্ষার প্রসারে অনন্য ভূমিকা রাখেন। বাংলাদেশ তথা উপমহাদেশে তিনিই একমাত্র নারী যিনি সর্বপ্রথম চিন্তা করেছিলেন আধুনিক শিক্ষা না পেলে নারীরা সমাজে পিছিয়ে পড়বে।

তাই দুঃসাহসিক উদ্যোগ নিয়ে মহীয়সী নারী বেগম রোকেয়ার জন্মের সাত বছর আগে ১৮৭৩ সালে শিক্ষা বিস্তারের উদ্যোগ নেন। তাঁর মেধা, প্রজ্ঞায় প্রতিষ্ঠিত হয় অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। ওইসব প্রতিষ্ঠান থেকে লাখ লাখ শিক্ষার্থী শিক্ষা অর্জন করে দেশের উন্নয়নে ভূমিকা রেখে চলেছেন।

শুধু শিক্ষা বিস্তারে নয়। দাতব্য চিকিৎসা কেন্দ্র, পুল, ব্রিজ, কালভার্ট ও মসজিদ নির্মাণ করে একজন দক্ষ নারীনেত্রীর ভূমিকা রাখেন। বাংলার নারী ইতিহাসে নওয়াব ফয়জুন্নেছার দৃষ্টান্ত অতি বিরল।

তাঁর মূল লক্ষ্য ছিল পিছিয়ে পড়া মুসলিম নারীদের শেকল ছিন্ন করা যা তিনি পর্দার আড়ালে থেকেই করতেন। তিনি নারীর ক্ষমতায়নের পাশাপাশি নিজ ধর্মও যথাযথভাবে পালন করতেন। নওয়াব ফয়জুন্নেছা একজন বিচক্ষণ ও বুদ্ধিদীপ্ত মহিলা ছিলেন। তৎকালীন সময়ে তিনি একজন নারী হয়েও তাঁর জমিদারি পরিচালনা করেছেন অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে। তিনি মোড়ায় বসে এবং চটিজুতা পায়ে দিয়ে তাঁর জমিদারি পরিচালনা করেছেন।

নওয়াব ফয়জুন্নেছা ছিলেন একজন সাহিত্যানুরাগী। তিনি ছিলেন ব্রিটিশ ভারতের প্রথম কবি। তাঁর রচিত রুপজালাল কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়। এ কাব্যগ্রন্থ ছাড়াও ফয়জুন্নেছার ‘সঙ্গীতসার’ ও ‘সঙ্গীত লহরী’ নামে দুটি কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছে। তিনি ছিলেন কলকাতা থেকে প্রকাশিত সুধাকর ও মুসলমান বন্ধু পত্রিকার প্রধান পৃষ্ঠপোষক।

অসাধারণ উদ্যমী ফয়জুন্নেছাকে ব্রিটেনের রানী ভিক্টোরিয়া ‘বেগম’ উপাধি দিলে তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। ‘বেগম’ স্ত্রীলিঙ্গ বলেই তিনি তা গ্রহণ করেননি। পরে রানী ভিক্টোরিয়া ১৮৮৯ সালে ফয়জুন্নেছাকে ‘নওয়াব’ উপাধি দিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন ভারতবর্ষে খেতাব পাওয়া প্রথম মুসলিম মহিলা জমিদার।  ১৯০৩ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর ফয়জুন্নেছা চৌধুরানী মৃত্যুবরণ করেন। তাঁকে তাঁর প্রতিষ্ঠিত ১০ গম্বুজ মসজিদের পাশে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়।

 

প্রাথমিক থেকে উচ্চ শিক্ষা বিস্তারে অবদান

নওয়াব ফয়জুন্নেছা চৌধুরানীর জীবনের সবচেয়ে বড় সাফল্য শিক্ষা ক্ষেত্রে তিনি অনন্য নজির স্থাপন করেছেন। তিনি যে সময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপনের উদ্যোগ নেন তখন সমাজ ব্যবস্থা ছিল শিক্ষায় পিছিয়ে। শিক্ষা অর্জনের ভালো প্রতিষ্ঠান না থাকায় কুসংস্কারে মানুষ ছিল নিমজ্জিত। শিক্ষায় পিছিয়ে পড়া সমাজকে বদলে দেওয়ার প্রত্যয়ে তিনি গড়েছেন একের পর এক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চ শিক্ষার দ্বার উন্মোচন করে একজন শিক্ষানুরাগী হিসেবে নিজের অবস্থান জানান দিয়েছেন। তাঁর প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানগুলো আজ দেশসেরা প্রতিষ্ঠানে রূপ নিয়েছে।

নওয়াব ফয়জুন্নেছা চৌধুরানী দুঃসাহসিক উদ্যোগ নিয়ে মহীয়সী নারী বেগম রোকেয়ার জন্মের সাত বছর আগে ১৮৭৩ সালে কুমিল্লা শহরের বাঁদুড়তলায় প্রতিষ্ঠা করেন ‘ফয়জুন্নেছা উচ্চ ইংরেজী বালিকা বিদ্যালয়’। যা বর্তমানে ফয়জুন্নেছা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় নামে পরিচিত। ১৯০১ সালে তিনি একটি অবৈতনিক মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন। সেই সঙ্গে মাদরাসা ছাত্রদের জন্য থাকার সুবিধার জন্য একটি ছাত্রাবাসও নির্মাণ করেন। মাদরাসার ভালো ফলাফলে উৎসাহিত হয়ে পরবর্তীকালে ফয়জুন্নেছার বংশধররা ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে এটিকে উচ্চ মাধ্যমিক ইসলামিক কলেজে রূপান্তরিত করেন। ১৯৬৫ সালে কলেজটি ডিগ্রি কলেজে রূপান্তরিত হয়ে নওয়াব ফয়জুন্নেছা ডিগ্রি কলেজ নামে আখ্যায়িত হয়। ১৯৮২ খ্রিস্টাব্দে কলেজটির সরকারিকরণ হয় এবং নাম হয় ‘নওয়াব ফয়জুন্নেছা সরকারি কলেজ’। কুমিল্লার দক্ষিণাঞ্চলে এটিই একমাত্র সরকারি কলেজ যেখানে উচ্চশিক্ষা অর্জনের জন্য দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে শিক্ষার্থীরা আসে। বর্তমানে এ কলেজে কয়েকটি বিষয়ে অনার্স কোর্স চালু রয়েছে। সময়ের বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে কলেজটিকে পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরের দাবি উঠেছে। বর্তমান সরকারের স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম এমপির আন্তরিকতায় কলেজটির আধুনিকায়নে শত কোটি টাকার উন্নয়ন কর্মকান্ড চলমান। কলেজটিতে মাস্টার্স কোর্স চালুর চিন্তাভাবনা চলছে বলেও জানা গেছে।

১৯০১ সালে মহীয়সী এ নারী ‘নওয়াব ফয়জুন্নেছা ও বদরুন্নেছা উচ্চ বিদ্যালয়’ প্রতিষ্ঠা করেন। শিশুদের শিক্ষা বিস্তারে তিনি নওয়াব ফয়জুন্নেছা প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন, যা বর্তমানে ‘পশ্চিমগাঁও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়’ হিসেবে চালু রয়েছে। এ ছাড়াও প্রাথমিক শিক্ষার বিকাশে তিনি বিভিন্ন স্থানে ১৪টি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। ১৮৯৯ সালে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের নির্মাণ কাজে তৎকালীন সময়ে ১০ হাজার টাকা অনুদান দেন। ছাত্রীদের থাকার জন্যও পশ্চিমগাঁওয়ে মহিলা হোস্টেলের ব্যবস্থাসহ সব খরচ বহন করেছিলেন। এমনকি তিনি ছাত্রীদের মাসিক বৃত্তির ব্যবস্থাও করতেন। নওয়াব ফয়জুন্নেছা দেশের বাইরেও শিক্ষা বিস্তারে ভূমিকা রাখেন।  তিনি পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগরেও একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

 

স্থাপত্যশৈলীর নওয়াববাড়ি মসজিদ

নওয়াব ফয়জুন্নেছা চৌধুরানী তাঁর জমিদারবাড়ির পাশে ১০ গম্বুজবিশিষ্ট অনিন্দ্য স্থাপত্যশৈলীর একটি মসজিদ নির্মাণ করেন। এ মসজিদটি দেখতে খুবই নান্দনিক। তৎকালীন সময়ে ফয়জুন্নেছা এই মসজিদটিতে পুরুষদের সঙ্গে সঙ্গে নারীদেরও নামাজ পড়ার ব্যবস্থা রাখেন। এই মসজিদের সামনেই শায়িত আছেন নবাব ফয়জুন্নেছা চৌধুরানী ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা। মসজিদের দক্ষিণে পারিবারিক কবরস্থান ফয়জুন্নেছা পরিবারের। নওয়াব ফয়জুন্নেছা চৌধুরানীর ছোটকন্যা বদরুন্নেছা চৌধুরানীকে নিজ গ্রাম পশ্চিমগাঁওয়ে বিয়ে দেওয়ায় তাঁর কবর মায়ের পাশেই হয়েছে। অপর মেয়ে সৈয়দা আসাদুন্নেসা চৌধুরানীকে বৃহত্তর সিলেটের হবিগঞ্জ জেলার জমিদারবাড়িতে বিয়ে দিয়েছিলেন বলে এখানে তাঁর কবর নেই। সৈয়দ শাহ আজহারুল হক, আলহাজ খান বাহাদুর সৈয়দ মুহাম্মদ গাজিউল হক, মোতাওয়াল্লি আলহাজ মৌলভী সৈয়দ সিরাজুল হক, সৈয়দ মুহাম্মদ ফয়জুল হক, সৈয়দা খাইরুন্নেসা বেগমসহ আরও কয়েকজনের কবর রয়েছে এখানে। প্রত্যেক কবর ফলকে নাম আর জন্ম-মৃত্যু সাল লেখা আছে। মসজিদের ভিতরের দেয়াল, মিম্বর আর মুয়াজ্জিনের আজান দেওয়ার জায়গায় আছে দুই ধরনের টাইলসের কারুকাজ। তৎকালীন সময়ের টাইলসগুলো ছিল খুব দৃষ্টিনন্দন। দেয়ালের ওপরের অংশের টাইলসগুলোতে রয়েছে গোলাপি, সাদা আর নীল রঙের কারুকাজ। আর নিচের দিকের টাইলসে হালকা শ্যাওলা সবুজ রঙের ডিজাইন। মসজিদের ছাদে রয়েছে দশটি গম্বুজ। মাঝখান বরাবর রয়েছে বড় একটা গম্বুজ। এই গম্বুজের চার ধারে মাইকগুলো লাগানো। বড় গম্বুজের চারপাশে আছে মোট নয়টি গম্বুজ।  ফয়জুন্নেছা মুসল্লিদের সুবিধার্থে একটি পুকুর খনন করেছিলেন। পাশেই রয়েছে অজু করার জন্য খননকৃত পুকুরটি।

 

স্বাস্থ্যসহ অন্যান্য ক্ষেত্রেও অগ্রগামী

নওয়াব ফয়জুন্নেছা চৌধুরানী ছিলেন কোমল হৃদয়ের অধিকারী। মানবিকতায় তিনি ছিলেন নিবেদিত। তৎকালীন সমস্যাগ্রস্ত সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রেই তিনি পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখেছিলেন। স্বাস্থ্যক্ষেত্রে তাঁর অবদানের কথা আজও স্মরণীয়। তিনি নারীদের স্বাস্থ্য রক্ষা ও সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করেন। তিনি ১৮৯৩ সালে নওয়াব ফয়জুন্নেছা মহিলা ওয়ার্ড প্রতিষ্ঠা করেন, যা বর্তমানে কুমিল্লা জেনারেল হাসপাতালের সঙ্গে সম্পৃক্ত। ১৮৯৩ সালে নওয়াববাড়ির কাছেই তিনি নারীদের জন্য একটি স্বতন্ত্র হাসপাতাল নির্মাণ করেছিলেন। এ ছাড়াও অনেক দাতব্য প্রতিষ্ঠান, এতিমখানা এবং সড়ক নির্মাণ করেছিলেন নওয়াব ফয়জুন্নেছা চৌধুরানী। তিনি পুল, ব্রিজ, কালভার্ট, দাতব্য প্রতিষ্ঠান, এতিমখানা এবং সড়ক নির্মাণ করে মানবতাবাদী ও সমাজ সংস্কারের অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন।  ১৮৯৪ সালে পবিত্র হজ পালন করার সময় তিনি মক্কায় হাজীদের জন্য একটি মুসাফিরখানাও প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি পবিত্র মক্কা শরিফে মাদরাসা-ই সওলাতিয়া ও ফোরকানিয়াসহ বিভিন্ন শিক্ষামূলক প্রতিষ্ঠানে প্রচুর পরিমাণে সহায়তা করেন। এ ছাড়াও সে সময়ের আব্বাসিয়া খলিফা হারুন-অর-রশিদের স্ত্রী জুবাইদার নামে নামকরণকৃত ‘নাহর-ই-জুবাইদা’ পুনঃখনন করেন যাতে করে হজ পালন করতে যাওয়া হাজীদের সুপেয় পানির অভাব না হয়। নওয়াব ফয়জুন্নেছা চৌধুরানী লাকসাম পশ্চিমগাঁও একটি পুকুর খনন করেন। পুকুরটিতে দৃষ্টিনন্দিত চারটি ঘাটলা নির্মাণ করায় এটি ‘চারঘাটলা পুকুর’ হিসেবে পরিচিত। কালের বিবর্তনে সুবিধাবাদীরা ঘাটলাগুলোকে ভেঙে পুকুরটি দখলের চেষ্টা চালান। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা ব্যর্থ হয়। পুকুরটির ঐতিহ্য ফিরে আনতে ইতিমধ্যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। পুকুরের পাশ ঘেঁষে ফয়জুন্নেছা চৌধুরানী গণ-কবরস্থানের জন্য বিশাল জায়গা দান করেন। বাউন্ডারি ওয়াল  না থাকায় কবরস্থানটি বর্তমানে অরক্ষিত অবস্থায় রয়েছে।

 

সৌন্দর্যমন্ডিত নওয়াববাড়ি

ব্রিটিশ শাসনামলে কারুকার্য দিয়ে নির্মিত ভারতীয় উপমহাদেশের একমাত্র মহিলা নওয়াব ও নারী আন্দোলনের প্রথম অগ্রদূত ফয়জুন্নেছার স্মৃতিবিজড়িত লাকসামের ঐতিহাসিক নওয়াববাড়ি চমৎকার একটি স্থাপত্য যাকে মনে করা হয় দক্ষিণ এশিয়ার সৌন্দর্যমন্ডিত বাড়িগুলোর একটি। কুমিল্লার লাকসাম শহর থেকে আধা কিলোমিটার দূরে পশ্চিমগাঁওয়ে ডাকাতিয়া নদীর তীরঘেঁষে অপূর্ব সৌন্দর্যের লীলাভূমি ঐতিহাসিক নওয়াব ফয়জুন্নেছার বাড়ির (নবাববাড়ি) অবস্থান। ঐতিহ্যের ধারক বাড়িটির নির্মাণ সাল নিয়ে মতান্তর রয়েছে।

নওয়াব ফয়জুন্নেছা চৌধুরানী ১৮৩৪ সালে জন্মগ্রহণ করেন। কথিত আছে, বিয়ের ১৭ বছর পর তিনি জানতে পারেন তাঁর স্বামী হাসান আলী জমিদারের আরেক স্ত্রী ছিলেন। তখন নওয়াব ফয়জুন্নেছা তাঁর স্বামী থেকে পৃথক থাকার জন্য বিয়ের কাবিনের ১ লাখ ১ টাকা দিয়ে সাড়ে তিন একর জমির ওপর বাড়িটি নির্মাণ করেন। বাড়িটি নির্মাণে সময় লাগে তিন বছর। রড-সিমেন্ট ছাড়াও ব্রিটিশ আমলের চুন ও সুরকি দিয়ে বাড়িটি তৈরি করা হয়। নওয়াব ফয়জুন্নেছা অত্যন্ত ধার্মিক ছিলেন। পর্দার আড়াল থেকে তিনি বাড়িতে বসে বিচারকার্য সম্পাদন, রাস্তাঘাট, পুল-ব্রিজ, স্কুল-মাদরাসাসহ জনকল্যাণমূলক কাজ করতেন। বর্তমানে বাড়িটি ঐতিহাসিক বাড়ি হিসেবে দেশ-বিদেশে ব্যাপক পরিচিত। নওয়াব ফয়জুন্নেছা মৃত্যুর আগে বাড়িটি সরকারের কাছে ওয়াক্ফ করে যান।

সৌন্দর্যমন্ডিত এ বাড়িটিকে ঘিরে অর্থনৈতিক উন্নয়নের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। কালের সাক্ষী বাড়িটি সংস্কার করা হলে পর্যটক হৃদয়সিক্ত করবে। হয়ে উঠবে দেশি-বিদেশি পর্যটকের অন্যতম দর্শনীয় স্থান।  সম্ভাবনাময় এ পর্যটক খাত থেকে প্রতি বছর লাখ লাখ টাকা আয় করতে পারবে সরকার।

 

 

যে উদারতায় নবাব উপাধি লাভ

তৎকালীন ত্রিপুরার ম্যাজিস্ট্রেট মি. ডগলাস একবার জনকল্যাণমুখী কাজে অর্থ জোগানের জন্য দেশের সব জমিদারের কাছে অর্থ চেয়ে চিঠি পাঠান।

বিশাল পরিমাণ অর্থ জোগানের কথা ভেবে ওই জনকল্যাণমুখী কাজে অন্য জমিদাররা অর্থ প্রদানে অপারগতা প্রকাশ করলে তৎকালীন হোমনাবাদ ১৪ পরগনার জমিদার ফয়জুন্নেছা চৌধুরানী প্রায় ১ লাখ টাকা দিয়ে মি. ডগলাসকে সহায়তা করেন। পরবর্তীতে মি. ডগলাস ফয়জুন্নেছাকে ওই টাকা ফিরিয়ে দিতে এলে তিনি বলেন, ফয়জুন্নেছা চৌধুরানী কাউকে কিছু দিলে সেটা ধার হিসেবে দেন না, একেবারে দান করে দেন। ফয়জুন্নেছা চৌধুরানীর এ কথা শুনে মি. ডগলাস খুবই অভিভূত হন এবং এ ঘটনা তৎকালীন ব্রিটিশ মহারানী ভিক্টোরিয়ার কাছে বর্ণনা করেন।

সব শুনে রানী ভিক্টোরিয়া ফয়জন্নেছা চৌধুরানীকে ‘বেগম’ উপাধিতে ভূষিত করার সিদ্ধান্ত নেন। মি. ডগলাস এ প্রস্তাব নিয়ে ফয়জুন্নেছার কাছে গেলে তিনি তা সম্মানের সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করেন।

কারণ, জমিদার বংশের মেয়ে এবং জমিদারপত্নী হওয়ায় তাঁর নামের সঙ্গে আগে থেকেই বেগম উপাধি ছিল বলে জানান। পরবর্তীতে মি. ডগলাস রানী ভিক্টোরিয়ার কাছে পুনরায় আবার সব বর্ণনা করলে রানী ভিক্টোরিয়া তাঁর উপদেষ্টাদের সঙ্গে বৈঠক করে ফয়জুন্নেছা চৌধুরানীর জন্য ‘নওয়াব’ উপাধি-ই উপযুক্ত হবে বলে সিদ্ধান্ত নেন।

১৮৮৯ সালে নওয়াববাড়িতে প্রায় ৩৫ হাজার টাকা খরচ করে ফয়জুন্নেছা চৌধুরানীকে ‘নওয়াব’ উপাধিতে ভূষিত করার অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়। শুভেচ্ছার প্রতীক হিসেবে তাঁকে দেওয়া হয় তারকাকৃতি হীরক খচিত একটি পদক।  সে পদকটিতে লেখা ছিল, ‘Title of Nawab Saheba presented by Her Majesty to Nawab Faizunnesa Chowdhurani 1889’.

 

নারী লেখিকাদের পথপ্রদর্শক

শুধু শিক্ষা বিস্তারেই নয়। নওয়াব ফয়জুন্নেছা ছিলেন একজন সাহিত্যনুরাগী। তিনি ছিলেন ব্রিটিশ ভারতের প্রথম কবি। তাঁর রচিত রুপজালাল কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয় ১৮৭৬ সালে। এ কাব্যগ্রন্থ ছাড়াও ফয়জুন্নেছার ‘সঙ্গীতসার’ ও ‘সঙ্গীত লহরী’ নামে দুটি কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছে। নারী লেখিকাদের পথপ্রদর্শকও ছিলেন নওয়াব ফয়জুন্নেছা।

রবীন্দ্রযুগে যে কজন বাংলাসাহিত্য সাধনা করে যশ ও খ্যাতি অর্জন করেন তাঁদের মধ্যে নওয়াব ফয়জুন্নেছা অন্যতম। আধুনিক বাংলা সাহিত্যের প্রথম মুসলিম সাহিত্যিক হিসেবে নওয়াব ফয়জুন্নেছার নাম চিরস্মরণীয়। নওয়াব ফয়জুন্নেছা ছিলেন প্রথম মুসলিম গদ্য-পদ্য লেখিকা। ১৮৭৬ সালে ঢাকার গিরিশচন্দ্র মুদ্রণযন্ত্র থেকে নওয়াব ফয়জুন্নেছা চৌধুরানী রচিত সাহিত্য গ্রন্থ ‘রুপজালাল’ প্রকাশিত হয়। ‘রুপজালাল’ নওয়াব ফয়জুন্নেছার অনবদ্য সৃষ্টি। ‘রুপজালাল’ গ্রন্থটি বাংলা ভাষায় কোনো নারী লেখিকার প্রথম প্রকাশিত বই। এই গ্রন্থটি তাঁর আত্মজীবনীমূলক গদ্যে পদ্যে মিশ্রিত একটি গ্রন্থ। গ্রন্থটি তিনি তাঁর স্বামী গাজী চৌধুরীকে উৎসর্গ করেন। নওয়াব ফয়জুন্নেছার ‘রুপজালাল’ গ্রন্থের কপি লন্ডনের ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরির বাংলা বিভাগে সংরক্ষিত আছে। বাংলা

একাডেমি গ্রন্থটি ১৯৮৩ সালে পুনর্মুদ্রণ করেছিল। ‘রুপজালাল’ ব্যতীত নওয়াব ফয়জুন্নেছা চৌধুরানীর ‘সঙ্গীত লহরী’ এবং ‘সঙ্গীত সার’ নামক আরও দুটি গ্রন্থ রচনা করে। তিনি ছিলেন কলকাতা থেকে প্রকাশিত সুধাকর ও মুসলমান বন্ধু পত্রিকার প্রধান পৃষ্ঠপোষক। নওয়াব ফয়জুন্নেছার  পথ ধরেই বেগম রোকেয়ার সাহিত্যে আগমন ঘটেছে। বাংলার নারীদের সাহিত্য অবদানে নওয়াব ফয়জুন্নেছার অবদান সর্বাগ্রে।

 

তবু মেলেনি রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি

নওয়াব ফয়জুন্নেছা প্রজ্ঞা, বিচক্ষণতা, জ্ঞানস্পৃহা আর সাহসের কারণে নারী জাগরণে অনুসরণীয় এবং অনুকরণীয় আদর্শ হয়ে আছে। নানা ক্ষেত্রে অবদানের জন্য তিনি নওয়াব উপাধি পেলেও মহীয়সী এই নারী আজও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পাননি। ২০০৪ সালে একরকম অবহেলা ও অসম্মান করেই ফয়জুন্নেছাকে যৌথভাবে একুশে পদক দেওয়া হয়। ২০০৮ সালে জাতীয় জাদুঘরে বেগম রোকেয়া ও বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের পাশে স্থাপন করা হয় ফয়জুন্নেছা কর্নার। স্বাধীনতা-পরবর্তী বিভিন্ন নির্বাচিত সরকার আমলেও নওয়াব ফয়জুন্নেছা চৌধুরানী তাঁর কর্মের স্বীকৃতি পাননি। আন্তর্জাতিক নারী দিবসেও অবহেলিত থেকে যাচ্ছেন ফয়জুন্নেছা চৌধুরানী।  তাঁর স্মৃতি রক্ষার্থে রাষ্ট্রীয়ভাবে মৃত্যুদিবস পালনের পাশাপাশি ফয়জুন্নেছা পদক চালুর দাবি বিশিষ্টজনদের।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর