ড্যাম কিংবা বাঁধ; মনুষ্যসৃষ্ট সবচেয়ে বড় কাঠামোগুলোর মধ্যে অন্যতম। যেখানে নদীর পানি সঞ্চয় থেকে জলবিদ্যুৎ উৎপাদন, নানা ধরনের কাজে ব্যবহৃত হয়। এ কারণে বিশ্বের অসংখ্য দেশ বিশালাকার বাঁধ নির্মাণ করে থাকে। বিশ্বের কয়েকটি বৃহত্তম বাঁধের মধ্যে চীন এবং রাশিয়ার প্রতিটিতে দুটি বাঁধ রয়েছে; যেখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ব্রাজিল এবং ভেনিজুয়েলায় রয়েছে একটি। আমেরিকার গ্র্যান্ড কোলি বাঁধ থেকে শুরু করে চীনের থ্রি জর্জেস ড্যাম; এবং কানাডার রবার্ট বুরাসা পর্যন্ত এখানে বিশ্বের ১০টি মেগা বাঁধের তালিকা দেখানো হলো।
মানবসৃষ্ট অবকাঠামোর প্রাচীনতম রূপগুলোর মধ্যে অন্যতম অবকাঠামো হলো- ড্যাম কিংবা বাঁধ। যা মানব ইতিহাসে অর্থনৈতিক উন্নয়নের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। সাধারণত বাঁধ হলো- পানির স্রোত ধরে রাখার জন্য নদীর মোহনাজুড়ে নির্মিত একটি অবকাঠামো। যা মানুষের ব্যবহারের জন্য, শুষ্ক এবং আধা-শুষ্ক জমিতে সেচের জন্য, এমনকি শিল্প প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহারের জন্য পানি সরবরাহ করার জন্য তৈরি করা হয়। এসব ড্যাম কিংবা বাঁধ; বন্যা নিয়ন্ত্রণ, ফসলের সেচ, পানি সরবরাহ, বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং নৌ-চলাচলকে সহজ করে তোলার জন্য নির্মিত হয়েছে। কালে কালে এসব বাঁধ নির্মাণে এসেছে নানা বিবর্তন। আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার কাঠামোগুলোকে করেছে আগের চেয়ে বেশি শক্তিশালী।
ড্যাম কিংবা বাঁধ বিশেষজ্ঞ এমনকি এসব প্রকল্পের সমর্থকরা প্রায়শই এ বাঁধগুলোকে কম কার্বন বিদ্যুতের অন্যতম উৎস হিসেবে ভূয়সী প্রশংসা করে থাকেন। যা সম্পূর্ণ সত্য। কারণ- বিশেষজ্ঞদের মতে, ‘পৃথিবী’ নামক এই গ্রহে কম কার্বন শক্তি উৎপাদনের উৎসগুলোর মধ্যে রয়েছে বায়ুশক্তি, সৌরশক্তি, পারমাণবিক শক্তি এবং বেশির ভাগ জলবিদ্যুৎ প্রকল্প। অর্থাৎ বাঁধগুলোর মাধ্যমে সহজে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা লাভজনক। অনলাইল পোর্টাল ন্যাচারের তথ্যমতে, ২০১৯ সালে বিশ্বের মোট বিদ্যুতের ১৬ শতাংশ এবং পুনর্নবীকরণযোগ্য বিদ্যুতের ৬০ শতাংশ উৎপাদনের অন্যতম প্রধান উৎস হলো জলবিদ্যুৎ প্রকল্প। বলা হয়, সমগ্র বিশ্বে বার্ষিক নির্গমন প্রায় ২.৮ বিলিয়ন টন কার্বন ডাইঅক্সাইড কমানোর জন্য জলবিদ্যুৎকে সবার জন্য সাশ্রয়ী ও পরিচ্ছন্ন শক্তির লক্ষ্য অর্জনের জন্য মেরুদণ্ড হিসেবে দেখা হয়। এশিয়া, দক্ষিণ আমেরিকা এবং আফ্রিকার উন্নয়নশীল দেশগুলোয় অব্যবহৃত জলবিদ্যুতের সম্ভাবনা রয়েছে। বিশ্বব্যাপী ১ মেগাওয়াটের বেশি ক্ষমতা সম্পন্ন কমপক্ষে ৩,৭০০টি বড় জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র এবং ৮২,৮০০টি ছোট প্রকল্প (তন্মধ্যে অনেকগুলো এখনো নির্মাণাধীন বা পরিকল্পনা করা হচ্ছে) কাজ করছে। পৃথিবীর ভূপৃষ্ঠে মোট ৪৭ শতাংশ পানি অসংখ্য নদী বা জলাশয়ের মাধ্যমে কমপক্ষে দুটি দেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়। এর ওপর পৃথিবীর ৪০ শতাংশ মানুষ নির্ভর করে। ভূতত্ত্ব বিশেষজ্ঞদের ভাষ্যমতে, পৃথিবীর প্রায় ১৫৩ দেশের ৩১০ নদী এই পানি নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি (প্রবাহিত) করে নেয়। গ্লোবাল ড্যাম ট্র্যাকার (জিডিএটি) ক্রস-ভ্যালিডেটেড জিও-অর্ডিনেট, স্যাটেলাইট থেকে প্রাপ্ত এলাকা এবং বিস্তারিত বৈশিষ্ট্যের তথ্য অনুসারে সমগ্র বিশ্বে মোট ৩৫,০০০টি বাঁধ রয়েছে। অনলাইল পোর্টাল ন্যাচারের অনুসন্ধান বলছে, গেল তিন দশকে এই বাঁধগুলো নাটকীয়ভাবে বিশ্বব্যাপী ভূপৃষ্ঠের পানির পরিধি বৃদ্ধিতে অবদান রেখেছে। বিশেষ করে এশিয়া, আফ্রিকা এবং দক্ষিণ আমেরিকার উন্নয়নশীল দেশগুলোয়।
নদীগুলোয় বাঁধ প্রকল্প নির্মাণে অবশ্য খরচও অনেক। অন্যদিকে বাঁধ নির্মাণ, বিশেষত বড় বাঁধ এবং আন্তঃসীমান্ত নদী অববাহিকায় অবস্থিত বাঁধগুলোর ব্যাপক আর্থ-সামাজিক, ভূ-রাজনৈতিক এবং পরিবেশগত প্রভাব রয়েছে। আর দক্ষিণ এশিয়ার প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, প্রতিবেশী বৃহৎ রাষ্ট্র অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র রাষ্ট্রগুলোকে নানাভাবে বঞ্চিত করে, নিপীড়ন করে এবং তথাকথিত শক্তিশালী রাষ্ট্র অনেকটা তৃপ্তিলাভ করে। যেমন- পানির একতরফা নিয়ন্ত্রণের কারণে প্রতিবেশী বৃহৎ রাষ্ট্র ভারতের প্রতি বাংলাদেশের সাধারণ জনগণের স্বাভাবিকভাবে বিদ্বেষ রয়েছে। কেননা, ভারত শুকনো মৌসুমে শুকিয়ে আর বর্ষা মৌসুমে ভাসিয়ে মারে। এর অবশ্য অসংখ্য নজিরও রয়েছে। অন্যদিকে চীনের থ্রি গর্জেস ড্যামের মতো বড় বাঁধগুলো বিশ্বব্যাপী লাখ লাখ মানুষকে বাস্তুচ্যুত করেছে। এর প্রভাব অবশ্য এখানেই থেমে নেই। যেমন- অ্যামাজন, কঙ্গো এবং মেকংয়ের মতো জীববৈচিত্র্যপূর্ণ নদী অববাহিকায় বাঁধ নির্মাণের কারণে বিশ্বের এক- তৃতীয়াংশ স্বাদুপানির মাছের প্রজাতি ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। উপরন্তু কিছু বাঁধ গ্লোবাল ওয়ার্মিংকে প্রশমিত করার পরিবর্তে পৃথিবীকে অত্যধিক উত্তাপের দিকে নিয়ে যাচ্ছে।
থ্রি জর্জেস ড্যাম [চীন]
বিশ্বের সবচেয়ে বৃহৎ বাঁধ
এশিয়ার দীর্ঘতম এবং পৃথিবীর তৃতীয় দীর্ঘতম নদীর নাম- ইয়াংৎজি। এই নদীর ওপরেই গড়ে উঠেছে থ্রি জর্জেস বাঁধ। চীনের ইলিং জেলার সান্ডৌপিং শহরে এই বাঁধ অবস্থিত। এটি বিশ্বব্যাপী বৃহত্তম বাঁধগুলোর অন্যতম। ১৯৯৪ সালে চীনের বৃহৎ থ্রি জর্জেস বাঁধটির নির্মাণকাজ শুরু হয়। এই প্রকল্পে খরচ হয়েছিল ২০০ বিলিয়ন ইউয়ান (২৮.৬ বিলিয়ন ডলার)। নির্মাণে সময় লেগেছিল ১৭ বছর। এটি একটি বিস্ময়কর স্থাপত্য। এর প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল- বন্যা নিয়ন্ত্রণ, জলবিদ্যুৎ উৎপাদন এবং ইয়াংৎজি বরাবর নৌচলাচলের উন্নতি। থ্রি জর্জেস বাঁধটি দৈর্ঘ্যে ২.৩ কিলোমিটার (১.৪ মাইল) বেশি প্রসারিত এবং ১৮৫ মিটার (৬০৭ ফুট) উচ্চতায় পৌঁছে যায়। এর জলাধারটি ৩৯.৩ কিউবিক কিলোমিটার (৯.৪৩ কিউবিক মাইল) পর্যন্ত পানি ধরে রাখতে পারে। অধিকন্তু বাঁধের জলবিদ্যুৎ ক্ষমতা অপরিসীম। এর জেনারেটিং ক্যাপাসিটি ২২,৫০০ মেগাওয়াট। আমেরিকার অন্যতম বৃহৎ গ্র্যান্ড কুলি ড্যামের তুলনায় এর সামর্থ্য তিন গুণ বেশি।
ইতাইপু বাঁধ [ব্রাজিল-প্যারাগুয়ে]
বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম বাঁধ
ইতাইপু বাঁধের নির্মাণকাজ সমাপ্ত হয় ১৯৮৪ সালে। এটি ব্রাজিল এবং প্যারাগুয়ের মধ্যে ভাগ করা পারানা নদীর ওপর স্বগৌরবে দাঁড়িয়ে আছে। নির্মাণের সময় লেগেছিল ১৬ বছর। আয়তনের দিক থেকে ইতাইপুর দৈর্ঘ্য ৭,৯১৯ মিটার এবং উচ্চতা ১৯৬ মিটার। এর জলাধারটি প্রায় ১,৩৫০ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে বিস্তৃত; যা ২৯.৩ ঘন কিলোমিটার পানি ধারণ করতে সক্ষম। বাঁধের প্রাথমিক উদ্দেশ্য- বৃহৎ অঞ্চলকে বিদ্যুৎ সুবিধা দেওয়া। এ কারণে এটি বিশ্বব্যাপী জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের নেতা হয়ে আছে। আর হবেই না কেন! এই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রটির তড়িৎ শক্তি তৈরির সক্ষমতা প্রায় ১৪ হাজার মেগাওয়াট। জলস্রোতকে কাজে লাগিয়ে প্রায় ২০টি জেনারেটরের সাহায্য বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয় এখানে। প্রতিটি জেনারেটর ৭০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ তৈরি করতে পারে। প্যারাগুয়েতে বিদ্যুৎশক্তি সরবরাহে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে এই কেন্দ্রটির। যদিও বিশাল এই বাঁধের কারণে পৃথিবীর মহাবন অ্যামাজনের অনেক অঞ্চল বৃক্ষহীন মরুভূমিতে পরিণত হচ্ছে।
জিলুওডু বাঁধ [চীন]
বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম বাঁধ
এটি চীনের জিনসা নদী উপত্যকায় অবস্থিত। যা পৃথিবীর তৃতীয় বৃহত্তম বাঁধ এবং বিদ্যুৎ কেন্দ্র। এর নির্মাণকাজ শেষ হয় ২০১৩ সালে। সময় লাগে ছয় বছর। আনুষ্ঠানিকভাবে ২০১৩ সালের ৩০ অক্টোবর জিলুওডু বাঁধটি উদ্বোধন করা হয়। যা চীনের লেইবো এবং ইয়োশান রাজ্যের মধ্যে অবস্থিত। জলবিদ্যুৎ বাঁধটি চীনের বৃহৎ ইউনান এবং সিচুয়ান প্রদেশের ইয়াংৎজি নদীর একটি উপনদী জিনসা নদী পর্যন্ত বিস্তৃত। জিলুওডু বাঁধ বিশ্বের সবচেয়ে লম্বা এবং দীর্ঘতম বাঁধগুলোর মধ্যে অন্যতম। বাঁধটি প্রায় ২৭৮ মিটার উঁচু, দৈর্ঘ্য প্রায় ৬৯৮ মিটার। জিলুওডু বাঁধটি বিদ্যুৎ উৎপাদনের পাশাপাশি একইসঙ্গে সেচ এবং বন্যা নিয়ন্ত্রণেও ভূমিকা রাখে। এর জলাধারটি প্রায় ৬০০ বর্গ কিলোমিটার (২৩২ বর্গ মাইল) এলাকাজুড়ে বিস্তৃত। যা বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য যথেষ্ট। ৯টি ইউনিট সমৃদ্ধ বাঁধটির ভূগর্ভস্থ শক্তিশালী জেনারেটর ১৩ হাজার ৮৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ তৈরি করতে পারে। যা চীনের ক্রমবর্ধমান বিদ্যুতের চাহিদা মেটাতে গুরুত্বপূর্ণ।
গুরি বাঁধ [ভেনেজুয়েলা]
১৯৬৯ সালে শুরু হয়ে গুরি বাঁধের নির্মাণকাজ শেষ হয় ১৯৮৬ সালে। এটি ভেনেজুয়েলার পূর্বাংশের বলিভার রাজ্যের ক্যারোনি নদীর ওপর অবস্থিত। গুড়ি বাঁধ ছাড়াও এই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রটি সিমন বলিভার হাইড্রোইলেকট্রিক প্লান্ট নামেও পরিচিত। এর আগে রাউল লিওনি হাইড্রোইলেকট্রিক প্ল্যান্ট নামে পরিচিত ছিল বাঁধটি। এর উচ্চতা প্রায় ১৬২ মিটার। আর দৈর্ঘ্য প্রায় ৭ হাজার ৪২৬ মিটার। তবে ২০০৯ সালে এই বাঁধের সক্ষমতা বাড়ানোর ফলে ১০ হাজার ২৩৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হয়। প্রকল্পটির লক্ষ্য ভেনেজুয়েলার জলবিদ্যুৎ সম্ভাবনাকে কাজে লাগানো; যা দেশের শক্তির প্রয়োজন মেটাতে অবদান রাখে। যদিও বিশেষজ্ঞদের দাবি, বাঁধটির কারণে গোটা লাতিন আমেরিকার ভূ-প্রাকৃতিক পরিবেশের ওপর অনেক চাপ পড়ছে।
টুকুরুই বাঁধ [ব্রাজিল]
ব্রাজিলের পারাতে অঞ্চলের টোক্যানটিন নদীর মাঝে অবস্থিত টুকুরুই বাঁধ। অ্যামাজন রেইনফরেস্টের মাঝে এ ধরনের বিদ্যুৎ কেন্দ্র এটাই ছিল প্রথম। বাঁধটি তার পরিবেশগত বৈচিত্র্য এবং শক্তি উদ্ভাবনের জন্য বিখ্যাত। এর দৈর্ঘ্য ৩,৭৫৮ মিটার এবং ৮৯ মিটার। এর জলাধারটি ৬,২৯৭ বর্গ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে বিস্তৃত। যা এটিকে বিশ্বব্যাপী বৃহত্তম জলাধারগুলোর একটি করে তুলেছে। অভিযোগ রয়েছে- এটি বানানোর সময় অনেক মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়। এমনকি এর কারণে বন উজাড় এবং নদীপ্রবাহে ব্যাপক ক্ষতিসাধন হয়। তবে বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি বর্তমানে প্রায় ১ কোটি ৩০ লাখ মানুষের বিদ্যুতের চাহিদা পূরণ করছে। এর মোট সক্ষমতা ৮ হাজার ৩৭০ মেগাওয়াট। যা ব্রাজিলের মোট বিদ্যুৎ গ্রিড এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখে।
গ্র্যান্ড কোলি বাঁধ [যুক্তরাষ্ট্র]
গ্র্যান্ড কোলি বাঁধটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন রাজ্যের কলম্বিয়া নদীর ওপরে অবস্থিত। যার দৈর্ঘ্য প্রায় ১.৬ কিলোমিটার এবং উচ্চতা প্রায় ১৬৮ মিটার। এর মূল উদ্দেশ্য- জলবিদ্যুৎ উৎপাদন ও সেচের পানি সরবরাহ। ১৯৩৩ সালে বাঁধের নির্মাণকাজ শুরু হয়, শেষ হয় ১৯৪২ সালে। এটি বৃহত্তম বাঁধগুলোর মধ্যে অন্যতম প্রাচীন। ৮৮ মিটার উচ্চতাসম্পন্ন বাঁধটি মূলত বিদ্যুৎ উৎপাদনের কাজেই ব্যবহৃত। যা ৩৩ টি জলবিদ্যুৎ জেনারেটর সমন্বিত চারটি ভিন্ন বিদ্যুৎ কেন্দ্র ধারণ করে। মূল কেন্দ্রে ১৮টি প্রধান জেনারেটর রয়েছে। গ্র্যান্ড কোলি বাঁধ বার্ষিক ২১টি-ডব্লিউ-ঘণ্টা বিদ্যুৎ উৎপাদন করে। এর অর্থ- বাঁধটি প্রায় ৬,৮০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করে। বাঁধের প্রভাবে আদিবাসীরা মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কলম্বিয়া নদীতে মাছ কমতে শুরু করে।
লংটান বাঁধ [চীন]
এই বাঁধের নির্মাণকাজ শুরু হয় ২০০১ সালে। সময় লেগেছিল আট বছর। চীনের লংটান বাঁধটি আধুনিক প্রকৌশল দক্ষতার অন্যতম উদাহরণ। এর উচ্চতা ২১৬.৫ মিটার এবং দৈর্ঘ্য ৮৪৯ মিটার। বাঁধটি চীনের গুয়াংসি ঝুয়াং স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের হংশুই নদীর তীরে অবস্থিত। এর জলাধারটির ধারণক্ষমতা প্রায় ২৭.৩ বিলিয়ন কিউবিক মিটার। বাঁধটি বন্যা নিয়ন্ত্রণ, জলবিদ্যুৎ উৎপাদন এবং সেচের জন্য পানি সরবরাহসহ একাধিক উদ্দেশ্যে কাজ করে। এর পাওয়ার স্টেশনের ৬,৪২৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষমতা রয়েছে। পাশাপাশি এই অঞ্চলে পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। জানা গেছে, বাঁধটি নির্মাণের সময় ৭৫ হাজার মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়। এমনকি উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ভূমি পানিতে প্লাবিত করা হয়।
সায়ানো-শুশেনস্কায়া বাঁধ [রাশিয়া]
বিশ্বের অষ্টম বৃহত্তম বাঁধ
এটি রাশিয়ায় অবস্থিত। যা সাইবেরিয়ার ইয়েনিসে নদী এলাকাজুড়ে বিস্তৃত। সায়ানো-শুশেনস্কায়া বিশ্বব্যাপী বৃহত্তম বাঁধগুলোর মধ্যে অন্যতম। এর উচ্চতা ২৪২ মিটার, যা একে পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু বাঁধগুলোর মধ্যে একটি করে তুলেছে। বাঁধটির নির্মাণকাজ সমাপ্ত হয় ১৯৭৮ সালে। বিশাল জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রটির পরিচালনায় রয়েছে RusHydro। প্রায় ৩১.৩ কিউবিক মাইল ধারণক্ষমতার জলাধারটি বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য পর্যাপ্ত পানি সঞ্চয় করে। বাঁধটি প্রায় ৬,৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করে। অভিযোগ আছে, এটি নির্মাণে অনেক মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়। বন উজাড় এবং নদী প্রবাহে ক্ষতি হয়। যাই হোক ২০০৯ সালে টারবাইনের ত্রুটির কারণে সায়ানো-শুশেনস্কায়া বাঁধটি এক বিপর্যয়কর দুর্ঘটনার সম্মুখীন হয়েছিল। ফলে বাঁধের টারবাইন হল প্লাবিত হয়। একাধিক হতাহতের ঘটনা ঘটে এবং জলবিদ্যুৎ প্রকল্পটির ব্যাপক ক্ষতি হয়। সেই মর্মান্তিক দুর্ঘটনা সত্ত্বেও জলবিদ্যুৎ বাঁধটি এই অঞ্চলের জন্য বিদ্যুতের অত্যাবশ্যক উৎস হয়ে আছে।
ক্রাসনোয়ারস্ক বাঁধ [রাশিয়া]
বিশ্বের নবম বৃহত্তম বাঁধ
ক্রাসনোয়ারস্ক বাঁধটি রাশিয়ার ইয়েনিসে নদীর ওপর অবস্থিত। ১৯৫৬ সালে এর নির্মাণ শুরু হয় এবং ১৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে চলে। কয়েক হাজার শ্রমিক এবং প্রকৌশলীর দক্ষতা ও পরিশ্রমের ফসল এই ক্রাসনোয়ারস্ক বাঁধ। যা দৈর্ঘ্যে ১,০৬৫ মিটার, উচ্চতায় ১২৪ মিটার। এটি বিশ্বের বৃহত্তম বাঁধগুলোর একটি, যার বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ৬,০০০ মেগাওয়াট। এই বাঁধটি মূলত এই অঞ্চলের জন্য একটি পাওয়ার হাউস হিসেবে কাজ করে এবং বিদ্যুৎ সরবরাহ করে। বাঁধের কৌশলগত তাৎপর্য শুধুমাত্র শক্তি উৎপাদনেই নয়, বরং নদী প্রবাহ, নিয়ন্ত্রণ এবং ইয়েনিসে নৌ-চলাচলের ক্ষেত্রেও এর ভূমিকা অনেক। এর জলাধারটি দৈর্ঘ্যে ৪০০ কিলোমিটারের বেশি প্রসারিত। ফলে কৃষি জমির সেচ, শিল্প ব্যবহার এবং নদীর বাস্তুতন্ত্র বজায় রাখার জন্য ক্রাসনোয়ারস্ক বাঁধটি পর্যাপ্ত পানি সরবরাহ করে। বাঁধের অবস্থান সাইবেরিয়ান মরুভূমিতে হওয়ার কারণে নির্মাণের সময় কর্মীরা চরম আবহাওয়াসহ নানা প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয়।
রবার্ট-বোরোসা বাঁধ [কানাডা]
বিশ্বের দশম বৃহত্তম বাঁধ
কানাডার ‘রবার্ট বোরোসা’ বাঁধ বিশ্বব্যাপী অন্যতম বৃহত্তম বাঁধ। ১৯৮১ সালে এর নির্মাণকাজ সমাপ্ত হয়। বাঁধটি উত্তর কানাডার কুইবেকের লা গ্র্যান্ডে নদীর ওপর অবস্থিত। বিশাল রবার্ট বোরাসা জলাধারাটি- লা গ্র্যান্ডে-২-এ জলাধার নামেও পরিচিত। প্রথমে বাঁধটির নাম ছিল লা গ্র্যান্ডে-২, কিন্তু ১৯৯৫ সালে কুইবেকের প্রাক্তন প্রিমিয়ার রবার্ট বোরাসাকে সম্মান জানানোর উদ্দেশ্যে এর নাম পরিবর্তন করা হয়। আয়তনের দিক থেকে বাঁধটির দৈর্ঘ্য ২,৮৩৫ মিটার এবং উচ্চতা ১৬২ মিটার। এর সর্বোচ্চ জলাধারের ক্ষমতা প্রায় ৬১.৫ বিলিয়ন কিউবিক মিটার। যা ২,৮০০ বর্গ কিলোমিটারের বেশি এলাকাজুড়ে বিস্তৃত। স্থানীয়ভাবে এটি জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের উদ্দেশ্যে কাজ করে। বলতে গেলে- এই অঞ্চলের জন্য প্রকল্পটি বিদ্যুতের একটি হাব। ‘রবার্ট বোরোসা’ বাঁধের ১৬টি ইউনিটের প্রায় ৫,৬১৬ মেগাওয়াট জলবিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা রয়েছে। অর্থাৎ এই ক্ষমতা বছরে ১০ লাখেরও বেশি বাড়িতে বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য যথেষ্ট।