চলছে হজের মৌসুম। বিশ্বের আনাচ-কানাচ থেকে মুসলমানরা ছুটে যাচ্ছেন পবিত্র কাবায়। খোদাপ্রেমের নজরানা দিতে হাজির হচ্ছেন কাবার দহলিজে। কোরআনের ভাষায় কাবাই পৃথিবীর প্রথম ঘর।
আল্লাহর ঘর। প্রেমের ঘর। বান্দার প্রতিটি ইবাদতের গভীরে থাকে আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা। হজ আল্লাহপ্রেমের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
তাই হজের সময় হলেই আল্লাহ প্রেমিকরা ব্যাকুল হয়ে ছুটে যান আল্লাহর ঘর কাবায় এবং প্রিয়নবী (সা.)-এর রওজায়। ব্যাকুল প্রার্থনায় কবুল করিয়ে নেন বারবার শাহি দরবারে হাজিরের সুযোগ। আল্লাহর দরবারে বারবার হাজির হওয়া এমনি একজন মহান ব্যক্তিত্ব আল্লামা আব্দুল হামিদ, যিনি মধুপুরের পীর হিসেবে খ্যাত।
ঢাকার অদূরে বিক্রমপুরে জন্ম। ৫০ বছরের বেশি সময় ধরে দ্বিনি শিক্ষা ও আত্মশুদ্ধির পথে কাজ করছেন। হজের মৌসুম শুরু হলেই তাঁর মনে এক আশ্চর্য শিহরণ জাগে। কাবাপ্রেম যেন তাঁকে আকুল করে তোলে। তাই তো খোদাপ্রেমের নজরানা দিতে জীবনে বহুবার গেছেন পবিত্র কাবার আঙ্গিনায়।
এখন তাঁর বয়স আশির ঊর্ধ্বে। শরীরে এসেছে স্বাভাবিক দুর্বলতা। তবে মনের জোর আগের মতোই অটুট।
কাবার প্রতি মনের এই টান ছাত্রজীবন থেকেই। পড়াশোনা করেছেন বৃহত্তর নোয়াখালীর ঐতিহ্যবাহী বিদ্যাপীঠ দারুল উলুম আল হুসাইনিয়া ওলামা বাজার মাদরাসায়। ১৯৬৮ সালে তাকমিল (মাস্টার্স) পড়ার সময় একদিন মক্কা-মদিনা জিয়ারতের সুযোগ চেয়ে পড়েছিলেন সালাতুল হাজাত। অশ্রুভেজা চোখে দোয়া করেছিলেন মহান রবের দুয়ারে। কাবা দেখার তামান্না নিয়ে ঘুমিয়েছিলেন ওলামা বাজার মাদরাসা মসজিদে। রাতে স্বপ্নে দেখেন, তিনি শুয়ে আছেন ঢাকার ঐতিহ্যবাহী মাদরাসা জামিয়া কোরআনিয়া লালবাগে। আল্লামা হাফেজ্জি হুজুর (রহ.)-এর কক্ষ বরাবর ঠিক নিচতলায়। রাতে ঘুম ভাঙলে পেরেশান হয়ে যান। চিন্তা করতে থাকেন, কী চাইলাম আর কী দেখলাম?
এ ঘটনার অনেক বছর পরের কথা। এরই মধ্যে মক্কা-মদিনায় জিয়ারতের সুযোগও পেয়েছেন কয়েকবার। এবারও হাজির হবেন মহান রবের দরবারে। এবার তাঁর ২৯তম হজ। মাদরাসার প্রয়োজনে প্রথমে এ বছর তিনি হজে যাবেন না ভেবেছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আল্লাহর এক বান্দার বিশেষ অনুরোধে যেতে হয় তাঁকে।
মাদরাসা থেকে বিদায় নেওয়ার আগে শিক্ষক ও ছাত্রদের উদ্দেশ করে বলেন, ‘ছাত্রজীবনে দেখা সেই স্বপ্নের ব্যাখ্যা আমার এখন বুঝে এসেছে। হাফেজ্জি হুজুর (রহ.) হজ শুরু করার পর আমৃত্যু তিনি প্রতিবছর হজ করার সুযোগ পেয়েছিলেন। আমাকেও হয়তো আল্লাহ প্রতিবছর হজ করার সুযোগ দেবেন।’
বাস্তবেও হয়েছে তাই। এরপর প্রায় প্রতিবছরই আল্লাহ তাঁকে হজ করার সুযোগ দিয়েছেন। সর্বজন শ্রদ্ধেয় বুজুর্গ আলেম মোহাম্মদুল্লাহ হাফেজ্জি হুজুর (রহ.) যে বছর শেষবারের মতো হজে যান, সে বছর ঢাকায় সাংবাদিকরা তাঁকে জিজ্ঞাসা করেন, ‘হুজুর! জীবনে আপনি কতবার হজ করেছেন?’
উত্তরে হুজুর বলেন, কতবার হজ করেছি তা তো মনে নেই, তবে চল্লিশের বেশিই হবে।’ হাফেজ্জি হুজুরের রুহানি সন্তান আল্লামা আব্দুল হামিদ এ পর্যন্ত হজ করেছেন ৪৩ বার। ওমরাহ করেছেন অসংখ্যবার। কোনো কোনো বছর তিনি দুই থেকে তিনবারও ওমরাহ করে থাকেন। রমজানে পবিত্র মক্কা ও মদিনায় ইতিকাফ করা ছিল তাঁর দীর্ঘদিনের ধারাবাহিক আমল। তবে বয়সের ভারে এখন প্রতিবছর রমজানে তিনি মক্কা ও মদিনায় ওমরাহ করতে যেতে পারেন না।
আল্লামা আব্দুল হামিদের কাছে হজের বিশেষ স্মৃতি জানতে চাইলে তিনি বলেন, ১৯৭৮ সালে আল্লাহ আমাকে প্রথমবার মক্কা-মদিনায় যাওয়ার সুযোগ দেন। ১৯৮৯ সালে আমার শায়খ ও মুর্শিদ শাহ আব্দুল হালিম (ওলামা বাজারের পীর) মারা যান। সে বছর আমি ইমামতির ভিসা নিয়ে দুই বছরের জন্য আমেরিকা যাই। কয়েক মাস পর দেশে ফেরার জন্য মনটা কেমন ছটফট করতে লাগে। এদিকে হজের সময়ও ঘনিয়ে এলো। এ বছর আমি হজে যেতে পারব না ভেবে একেবারে অস্থির হয়ে পড়ি। যোগাযোগ করি আমেরিকায় অবস্থিত পাকিস্তানি এক হজ এজেন্সির সঙ্গে। তারা ভিসার জন্য আমার কাছে এক হাজার ৪০০ ডলার দাবি করে। আমি রাজি হয়ে যাই।
কিন্তু কয়েক দিন পর তারা জানায়, এখান থেকে বাংলাদেশিদের ভিসা হবে না। তাদের ভিসা করতে হলে বাংলাদেশ থেকে আবেদন করতে হবে। আমি নাছোড় বান্দা, আমি হজে যাবই। তারা আমাকে বিভিন্নভাবে বোঝাতে চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। আমি আল্লাহর কাছে কান্নাকাটি করছি। দোয়া করছি। হজের ঠিক দুই দিন আগে ওয়াশিংটন থেকে একজন ফোন করে এজেন্সির লোকদের বলল, মাওলানা আব্দুল হামিদ নামে একজন হুজুর আছেন। বাংলাদেশের ঢাকায় বাড়ি। তাঁকে বলুন কাগজপত্র যেন এখনই ওয়াশিংটন পাঠিয়ে দেন। এখান থেকে তাঁর ভিসা হবে। এজেন্সির লোকেরা কিছুতেই আমাকে ছাড়বে না। আমিও কিছুতেই মানছি না।
শেষে তারা বলল, আপনি কাগজ নিতে চাইলে নিজ দায়িত্বে নেবেন। ভিসা না হলে আমরা দায়ী থাকব না। আমি তা-ই মেনে নিলাম। কাগজপত্র তুলে দ্রুত ওয়াশিংটন পাঠিয়ে দিলাম। এক দিনের মধ্যে আমার ভিসা লেগে গেল। সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে সৌদির উদ্দেশে বিমানে উঠলাম। মুখে আমার হজের পবিত্র তালবিয়া। আর চোখে কৃতজ্ঞতার অশ্রু। কিভাবে সেদিন ভিসা হয়েছিল, কার মাধ্যমে হয়েছিল—আমি আজও তা জানতে পারিনি।
লেখক : শিক্ষক, জামিয়া ইসলামিয়া ফতেপুর, মানিকগঞ্জ