ফেনী জেলার একটি ছোট্ট গ্রামে এক গরিব পরিবার বসবাস করত। তাদের নাম ছিল মজিবর আলী এবং ফাতিমা বেগম। তারা দুজনই অশিক্ষিত ছিলেন, জীবিকা নির্বাহ করতেন দিনমজুরির কাজ করে। কিন্তু তারা তাদের একমাত্র সন্তান, সাইফুলকে শিক্ষিত করার জন্য নিজেদের সব কিছু দিয়ে চেষ্টা করেছিলেন। সাইফুল ছিল তাদের গর্ব, তাদের সব স্বপ্নের প্রতীক। সাইফুল ছিল গ্রামের একমাত্র ছেলে যে শিক্ষিত ছিল। সে গ্রামের একটি স্কুলে পড়াশোনা করত এবং খুব মনোযোগী ছাত্র ছিল। তার বয়স ছিল মাত্র ২০ বছর, কিন্তু সে ছিল খুব সাহসী ও বুদ্ধিমান। সে সবসময় তার পরিবার এবং গ্রামবাসীর জন্য ভালো কিছু করার স্বপ্ন দেখত।
একদিন হঠাৎ করে প্রচণ্ড বৃষ্টি শুরু হলো। আকাশ যেন ভেঙে পড়ছে। দিনের পর দিন বৃষ্টি হচ্ছিল এবং নদীর পানি দ্রুত বেড়ে যাচ্ছিল। গ্রামের মানুষ খুব চিন্তিত হয়ে পড়ল। তারা জানত না কী করতে হবে। সাইফুলের পরিবারও উদ্বিগ্ন হয়ে উঠল। তার মা ফাতিমা বেগম বললেন, ‘সাইফুল, কী হবে আমাদের? এই পানি তো গ্রামের সবকিছু ধ্বংস করে ফেলবে!’ সাইফুল আশ্বস্ত করে বলল, ‘মা, চিন্তা করো না। আমি কিছু একটা করব। আমাদের পরিবার এবং গ্রামের মানুষকে রক্ষা করার জন্য আমাকে কিছু করতেই হবে।’
এদিকে বৃষ্টি বেড়েই চলছে। নদীর পানি বইছে বিপদসীমার ওপরে। সহযোগিতার জন্য অন্যান্য জেলার মানুষ আসতে পারছে না পানির প্রচণ্ড স্রোতের কারণে। দেখতে দেখতে একদিন সকালে সাইফুল ঘুম থেকে উঠে দেখে, তার গ্রামের চারপাশে সবকিছু পানিতে ডুবে গেছে। পুরো গ্রাম বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। কোনোরকম যোগাযোগ ব্যবস্থা নেই। বিদ্যুৎ নেই, ফোনের লাইন কেটে গেছে। গ্রামের মানুষ অসহায়ভাবে ঘরে বসে আছে, চারদিকে কান্নার আওয়াজ। কেউ বের হওয়ার সাহসও করছে না। পানি বাড়তে থাকলে তাদের ঘরবাড়ি সব ডুবে যেতে পারে। সাইফুল বুঝতে পারল, যদি দ্রুত কিছু করা না হয়, তবে অনেক মানুষ বিপদে পড়বে। সে পানির বোতল সংগ্রহ করে পানিতে ভেসে থাকার মতো কিছু একটা তৈরি করে। তারপর প্রয়োজনীয় জিনিস সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে বাইরে। অনেক কষ্টে সে গ্রামের প্রধানের কাছে যায়। গিয়ে বলে, ‘চাচা, আমাদের কিছু করতে হবে। আমরা সবাই যদি এভাবে বসে থাকি, তাহলে গ্রামের মানুষের বড় ক্ষতি হয়ে যাবে। গ্রামের প্রধান হতাশ হয়ে বললেন, কী করব, সাইফুল? আমাদের হাতে কোনো উপায় নেই। বৃষ্টি থামছে না, পানি বাড়ছে, আর আমাদের কোনো যোগাযোগ ব্যবস্থা নেই। সাইফুল বলল, চাচা, আমি চেষ্টা করব। আমি কিছু একটা উপায় বের করবই। আপনি শুধু গ্রামবাসীকে বলে দিন, তারা যেন আল্লাহর কাছে দোয়া করতে থাকে।’
সাইফুলের মাথায় তখন অনেক চিন্তা ঘুরছিল। সে জানত, গ্রামের মানুষদের বাঁচাতে হলে বাইরে থেকে সাহায্য আনতে হবে। কিন্তু কীভাবে যোগাযোগ করবে, তা সে জানত না। তবে সে হার মানল না। তার বাড়িতে গিয়ে ভাবতে লাগল। হঠাৎ তার মনে পড়ল, তার বন্ধু রফিক যে শহরে থাকে, তার কাছে একটি পুরনো রেডিও ছিল। রেডিওর মাধ্যমে যদি কোনোভাবে প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়, তবে হয়তো তাদের সাহায্য পাওয়া যাবে। সাইফুল দ্রুত রফিকের বাড়ির দিকে ছুটল। সেখানে গিয়ে দেখল, রফিকও খুব চিন্তিত। সাইফুল তাকে বলল, রফিক, তোর সেই পুরনো রেডিওটা আছে? রফিক বলল, হ্যাঁ, আছে। কিন্তু সেটা কি কাজে আসবে? সাইফুল বলল, চেষ্টা করতে দে। এই রেডিও দিয়েই আমি প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করব। রফিক দ্রুত রেডিও বের করে আনল। সাইফুল সেটিকে চালু করে বিভিন্ন ফ্রিকোয়েন্সি পরিবর্তন করে চেষ্টা করতে লাগল। অনেকক্ষণ চেষ্টা করার পর, অবশেষে সে একটি উদ্ধারকারী দলের সিগন্যাল পেল। সাইফুল দ্রুত তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করল এবং গ্রামের বর্তমান পরিস্থিতি জানাল। উদ্ধারকারী দলটি শুনে খুবই উদ্বিগ্ন হলো। তারা বলল, তুমি চিন্তা করো না। আমরা এখনই ফেনী জেলায় যাচ্ছি। তোমার গ্রামে আমরা দ্রুত পৌঁছে যাব। কিন্তু সমস্যা হলো, তাদের খবর ও ঠিকানা জানানো গেলেও সঠিক অবস্থান খুঁজে বের করতে পারছে না উদ্ধারকারী দল। এদিকে সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে। অনেকক্ষণ যাবত কেউ আসছে না দেখে সে বুঝতে পারে যে, অবস্থান খুঁজতে সমস্যা হচ্ছে। এদিকে বাইরে তখনো মাঝারি বৃষ্টি। সংকেত দেওয়ার জন্য আগুনও জ্বালানো যাচ্ছে না। তখন তারা দুজন বুদ্ধি করে এক গ্যাসের সিলিন্ডার সংগ্রহ করল। সিলিন্ডার থেকে পাইপ জয়েন দিয়ে লম্বা এক বাঁশের আগায় আগুন জ্বালানোর চেষ্টা করল। কয়েকবার ব্যর্থ হওয়ার পর, একবার জ্বলে উঠল আগুন। আগুন জ্বলছে, তবু কেউ আসছে না। বড় আগুন জ্বালাতে গিয়ে গ্যাস শেষ হচ্ছে দ্রুত। আর বেশিক্ষণ জ্বলবে না। তারা চিন্তিত। এমন সময় স্পিডবোর্টের শব্দ পাওয়া গেল। বাইরে তাকিয়ে দেখে দশ পনেরোটি স্পিডবোট এসে গ্রামে উপস্থিত।
সাইফুলের মনটা শান্ত হলো, তবে সে জানত, এখনো কাজ বাকি। সে গ্রামের প্রধানের কাছে গিয়ে বলল, চাচা, আমি প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পেরেছি। তারা আমাদের সাহায্যের জন্য এসেছে। আমরা এখন সবাইকে প্রস্তুত করতে হবে। গ্রামের প্রধান এবং সাইফুল একসঙ্গে মাইকে ঘোষণা দিল, সব গ্রামবাসী শুনুন, উদ্ধারকারী দল এসেছে। সবাই ঘর থেকে বেরিয়ে সাড়া দিন। কেউ ভয় পাবেন না। গ্রামবাসী ধীরে ধীরে ঘর থেকে বেরিয়ে এসে সাইফুলের নির্দেশনা মেনে চলতে শুরু করল। তাদের মধ্যে আশার আলো জ্বলতে শুরু করল। তারা সবাই সাইফুলের নেতৃত্বে সাড়া দিল। উদ্ধারকারী দল ধীরে ধীরে সবাইকে নিরাপদে সরিয়ে নিল। গ্রামের সবাই সাইফুলের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে আনন্দে কান্নাকাটি করছে। তার বুদ্ধি ও সাহসিকতা ছাড়া হয়তো তারা আজ বিপদ থেকে বাঁচতে পারত না।
কিছুদিন পর, পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে সাইফুলকে তার বীরত্বের জন্য সরকারিভাবে পুরস্কৃত করা হয়। ফেনী জেলার প্রশাসন তাকে সম্মাননা দিয়ে বলল, সাইফুল শুধু তার পরিবারকে নয়, পুরো গ্রামকে রক্ষা করেছে। তার মতো সাহসী ও বুদ্ধিমান ছেলে আমাদের দেশের গর্ব। সাইফুল এই সম্মান পেয়ে তার মা-বাবার কাছে এসে বলল, মা, বাবা, এই পুরস্কার শুধু আমার নয়, এটা তোমাদেরও। তোমরা যদি আমাকে শিক্ষিত না করতে, তাহলে আমি আজকে কিছুই করতে পারতাম না। তার মা-বাবা গর্বে চোখের জল ফেললেন। তারা জানতেন, সাইফুল শুধু তাদের গর্ব নয়, পুরো গ্রামের গর্ব। সাইফুলের বুদ্ধি, সাহস এবং মানবিকতার গল্প সেই দিন থেকে ফেনী জেলায় ছড়িয়ে পড়ল। এভাবে সাইফুল হয়ে উঠল এক প্রকৃত বীর, যার গল্প ছোট থেকে বড় সবাইকেই অনুপ্রেরণা দেয়।