বুধবার, ১৩ জুলাই, ২০১৬ ০০:০০ টা

আমার কিছু কথা আছে ...

নঈম নিজাম

আমার কিছু কথা আছে ...

স্কলাসটিকার এ লেভেলের ছাত্র মোবাশ্বির নিখোঁজ হয় ২৯ ফেব্রুয়ারি। বাংলাদেশ প্রতিদিনে খবরটি প্রকাশিত হয় ২ মার্চ ২০১৬। রিপোর্ট লেখার সময় আমাদের ক্রাইম রিপোর্টার তখন কথা বলেছিলেন গুলশান থানার সঙ্গে। পুলিশ জানায়, এ ব্যাপারে জিডি হয়েছে। তারা তদন্ত করবেন। তারা কী তদন্ত করেছিলেন জানি না। আমাদের রিপোর্টাররা বসে থাকলেন না। তারা খোঁজ শুরু করেন।  খবর আসতে থাকে। জানা গেল মোবাশ্বিরের বাবা একটি ফোন কোম্পানিতে কাজ করেন। মা সরকারি কলেজের শিক্ষক। ঘটনার দিন মোবাশ্বির কোচিংয়ের কথা বলে বাসা থেকে বের হয়। সঙ্গে ছিল বাসার গাড়ি ও ড্রাইভার। গুলশান আগোরা ডিপার্টমেন্টালের সামনে যানজট দেখে মোবাশ্বির গাড়ি থেকে নেমে পড়ে। ড্রাইভারকে বলে, সন্ধ্যা ৬টায় তুলে নেবে। ড্রাইভার এসে সন্ধ্যায় অপেক্ষা করে। পরে যায় কোচিং সেন্টারে খোঁজ নিতে। জানল, মোবাশ্বির কোচিং করতে আসেনি। তাহলে কোথায় গেল সে? বাংলাদেশ প্রতিদিনের রিপোর্টার খোঁজ নিয়ে জানালেন, সেদিন বিকালে বনানী ১১ নম্বরের ভিডিও ফুটেজে দেখা যায় মোবাশ্বির হাঁটছে। ভিডিও ফুটেজ শেষ। মোবাশ্বিরকে আর দেখা যায় না। এরপর থেকেই সে নিখোঁজ। আমাদের তদন্ত থামেনি। কাজ করতে থাকেন রিপোর্টাররা। তারা জানতে পারেন শুধু মোবাশ্বির নয়, আরও অনেকে নিখোঁজ। তাদের খোঁজ নিতে বললাম। এপ্রিলের শেষে আরেকটি রিপোর্ট প্রকাশ করি— বাংলাদেশের তরুণরা জঙ্গিতে যোগ দিয়ে চলে যাচ্ছে সিরিয়া। মোবাশ্বিরও তাদের দলে। মোবাশ্বিরের পরিবার থেকে আমাদের অফিসে যোগাযোগ করা হয়। তারা প্রতিবাদ করেন, মোবাশ্বির আর যাই হোক জঙ্গি হতে পারে না। পুত্রের সন্ধানে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কাছে ঘুরতে থাকেন তারা। কিন্তু কেউ কিছু বলতে পারছেন না। দীর্ঘ চার মাস পর জানা গেল গুলশান হামলার জঙ্গিদের একজন এই মোবাশ্বির। নারকীয় হত্যালীলায় অংশ নেওয়া অন্যরাও একইভাবে ঘর পালিয়ে জঙ্গি। ভয়ঙ্কর কাজে তারা জড়িয়ে পড়েছে।

বলাকা কবিতায় কবিগুরু লিখেছেন— ওরে ভাই, কার নিন্দা করো তুমি

মাথা করে নত।

এ আমার এ তোমার পাপ।

গুলশান আক্রমণ আমাদের ভাবিয়ে তুলেছে। ভেঙে দিয়েছে মন। ভাবছি কেন এমন হলো। কাকে দোষারোপ করব? নামিদামি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভালো পরিবারের সন্তানরা ভয়ঙ্কর অপরাধ করেছে। অফিসের এক সহকর্মী বললেন, এখনো সবকিছু ভালো ঠেকছে না। এখনো ১৪০ তরুণ নিখোঁজ পরিবার থেকে। তাদের কেউ কেউ চলে গেছে সিরিয়া। বাকিরা কোথায় আছে কেউ জানে না। আর প্রশ্ন হচ্ছে, ওরা কীভাবে জঙ্গি হলো। বাড়ি পালানোর পর কোথায় ছিল? কারা ওদের আশ্রয়-প্রশ্রয়দাতা? কারা প্রশিক্ষণ দিয়েছে, কোথায় দিয়েছে? অর্থায়ন করেছে কারা? অনেক প্রশ্নের জবাব মিলছে না। যেমনই বোঝা যাচ্ছে না জঙ্গি দমনে আমরা সক্ষম কিনা? সব কিছু নতুন করে ভাবতে হবে। কারণ স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের হুমকিদাতাদের দমন করতে হবে কঠোরভাবে। জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাসবাদ আমাদের এই প্রিয় ভূখণ্ডে চলতে পারে না। চিরতরে জঙ্গিবাদ নির্মূলে কাজ করতে হবে। অগোছানো কাজ আর দোষারোপের সংস্কৃতিতে থেকে সব কিছু সামাল দেওয়া কঠিন। জঙ্গি দমনে সুবিধাভোগী তোষামোদকারী মোসাহেবদের খপ্পর থেকে মুক্ত থাকতে হবে দল ও সরকারকে। কারণ আওয়ামী লীগ যখন ক্ষমতায় থাকে তখন একদল সুবিধাভোগী লোক তৈরি হয়। বিরোধী দলে গেলে আরেক দল আন্দোলন করে। দলকে ক্ষমতায় আনে। সরকারি দলে মাঠের এই মানুষদের খারাপ সময়ে দেখা যায় না। এমনকি সরকারি দলেও অনেকে খারাপ কিছু দেখলে কেটে পড়েন। গুলশান আক্রমণে সারা রাত ঘুমাতে পারেননি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কিন্তু তার মতো জেগে ছিলেন কতজন মন্ত্রী, জোটের নেতা, দলের নেতা? বড় বড় কথা বললে তো হবে না। সেই রাতে অনেক আওয়ামী লীগ নেতাকে ফোন করেছি। আমার ধারণা ছিল মন্ত্রী, এমপি, জোট ও দলের নেতারা সবাই গণভবনে গিয়ে বসে আছেন। তারা অপেক্ষা করছেন প্রধানমন্ত্রীর ইশারার জন্য। ঢাকার বাইরে যে নেতারা ছিলেন তাদের কথা আলাদা। কিন্তু যারা ঢাকায় ছিলেন তারা কী করেছেন? তারা কি গণভবনে গিয়েছিলেন? দলীয় অফিসে অবস্থান নিয়েছিলেন? অঙ্গসহযোগী সংগঠনকে দলীয় কার্যালয়ে ফোন করে আসতে বলেছিলেন? কেউই তা করেননি। কঠিন সত্য গুলশান আক্রমণের রাতে গণভবনে মন্ত্রিপরিষদের সদস্য, দলের সিনিয়র নেতা কাউকে দেখা যায়নি। এমনকি জোটের নেতারাও যাননি। শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তারা মধ্যরাতে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করতে গণভবনে দেখলেন, মধ্যম সারির তিন নেতা বসে ঝিমুচ্ছেন। তারা হলেন জাহাঙ্গীর কবীর নানক, আফজাল হোসেন ও এসএম কামাল। নানক ফোন করেছেন মীর্জা আজমকে। মীর্জা আজম তখন জামালপুরের মাদারগঞ্জে।

আগেও দেখেছি সব কিছুতে শেখ হাসিনাকে একাই লড়তে হয়। অনেকে আসেন সুযোগ বুঝে। কাজের সময় দেখা মেলে না। অনেকে সমস্যা মিটে গেলে হৈচৈ করেন। খাজনার চেয়ে বাজনা বেশি। সমস্যা এখানেই। আসলে সময়ের কাজ সময়ে করতে হয়। আওয়ামী লীগ অনেক কিছু ভুলে যায়। এমনকি সুসময়ে মনে রাখে না দুঃসময়ের কর্মীদের। আজকাল চারদিকে শুধু আওয়ামী লীগ দেখি। ভুল বললাম, অতি আওয়ামী লীগ দেখি। এই অতিরাই কেউ সুবিধা ভোগ করছে। কেউ আশায় আশায় আলো নিয়ে অপেক্ষা করছে ব্যবসা-বাণিজ্য, নিয়োগের জন্য। ভয়টা এখানেই। কারণ সময় খারাপ হলে সুবিধাভোগীদের দেখা মেলে না। গুলশান আক্রমণের পর অনেক আওয়ামী বুদ্ধিজীবী মিডিয়ার সঙ্গে কথা বলতে সম্মত হননি। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের সময়ও তাই দেখেছিলাম। ২০০১ সালের পরও তাই দেখেছি। ’৯১ সালের কথাও মনে আছে। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের সময় অনেক নেতা এলাকাতেও যাননি। ঢাকায় বসে নির্বাচিত হয়েছেন ভোট ছাড়া। আবার একটা কঠিন সময় শুরু হয়েছে। এই কঠিন সময়কে হালকা করে দেখার সুযোগ নেই। জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে সতর্ক অবস্থান নিতে হবে। অন্যথায় বাংলাদেশকে কঠিন আগামীর মোকাবিলা করতে হবে। আইএস আছে কি নেই বিতর্ক করে লাভ নেই। বাস্তবতা হচ্ছে আমাদের একটা সমস্যা আছে। এই সমস্যা যে নামেই হোক না কেন তার সমাধান করতে হবে। শরীরে ক্যান্সার ধরা পড়লে বসে থেকে, বিতর্ক করলে চলে না। দরকার চিকিৎসার। এই চিকিৎসা করাতে হবে। বুঝতে হবে জঙ্গিবাদ মোকাবিলায় আমাদের সক্ষমতার অভাব রয়েছে। পুরো সক্ষমতা থাকলে পাঁচ জঙ্গি মোকাবিলায় সারা রাত অপেক্ষা করতে হতো না। দুজন পুলিশ অফিসারকে আমরা হারাতাম না। আমি বাস্তববাদী মানুষ। কল্পনার সমুদ্রে বাস করে লাভ নেই। নীতিনির্ধারকদের বুঝতে হবে চাটুকাররা কোনো কাজের নন। তোষামোদকারীদের বলা দরকার কম কথা, কাজে প্রমাণ দাও। কারণ সময়ে তোমাদের দেখি না। তখন কষ্টটা দলের ত্যাগীরাই করেন। সবারই মনে রাখা দরকার দেশটা আগে। দেশ না থাকলে আমাদের কারোরই কোনো অস্তিত্ব থাকে না। মাঝে মাঝে আমার ভয় হয়। এই ভয় শর্ষের ভিতরে ভূতকে নিয়ে। বুঝতে হবে শর্ষের ভিতরে ভূত থাকলে চলবে না। এই ভূত তাড়াতে হবে। মুখে এক, অন্তরে অন্য থাকলে চলে না। আড়াল করা যায় না সত্যকে। সত্য কঠিন হলেও প্রকাশ করতে হবে।

মনে রাখতে হবে একটি যুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন হয়। এই বাংলাদেশ জঙ্গিবাদের ঘাঁটি হতে পারে না। কারণ আমাদের মুক্তিযুদ্ধের মূল ভিত্তি ছিল অসাম্প্রদায়িকতা। দেশকে জঙ্গিবাদের ঘাঁটিমুক্ত করতে বাস্তবমুখী কাজ করতে হবে। রাজনীতিবিদরা অনেক কিছু পারেন। দরকার তাদের আন্তরিকতা। এক সময় রাজনীতি মানে ছিল বিশাল সম্মানের ব্যাপার। তখন নেতাদের লোভ-লালসা ছিল না। তাদের চোখের সামনে ছিল জনতা। আর জনগণের আস্থাও নেতাদের কথার ওপর। এখন কোনোটাই নেই। এখন রাজনীতি মানে অর্থবিত্তের মালিক বনা। রাজনীতি এক ধরনের ব্যবসায় রূপান্তর হয়েছে। খুব সহজে টাকা বানানোর উপায় আর কোথাও নেই। সত্যিকারের রাজনীতিবিদদের ভাবতে হবে তাদের কোন সহকর্মীদের কারণে দুর্নাম নিতে হচ্ছে। পারস্পরিক কোন্দল কমিয়ে আনতে হবে। সুস্থ ধারার রাজনীতি ছাড়া জঙ্গিবাদ বন্ধ সম্ভব নয়। গ্রামগঞ্জে সুস্থ ধারার সংস্কৃতির বিকাশে দরকার রাজনীতিবিদদের সরাসরি হস্তক্ষেপ। একটা সময় গ্রামগঞ্জে পুঁথিপাঠের আসর বসত। মানুষ দল বেঁধে গাজীর গান শুনত। রাতে যাত্রাপালা দেখে ভোরে বাড়ি ফিরত ফজরের নামাজ পড়ে। জেলা শহরে কৃষি মেলায় সার্কাস, পুতুল নাচ, যাত্রাপালা থাকত। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ছাত্রসংসদ ছিল। শিল্প সংস্কৃতির চর্চা ছিল। পরিবারের মাঝে একটা বন্ধন ছিল। মানুষের নীতি নৈতিকতা ছিল। মানবিক, সাংস্কৃতিক, সামাজিক মূল্যবোধ ছিল। এখন কোনোটাই নেই। এখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দখলের সংস্কৃতি চলে। শিক্ষকরা ছাত্রদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন না। শিক্ষকরা নিজেরাই অতি রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ছেন। পেশাজীবীরা দখলের নোংরা খেলায় মত্ত। আর রাজনীতিবিদরা দখলবাজদের উৎসাহিত করেন। সেদিন একটি সামাজিক ক্লাবে বসে একজন বললেন, ঢাকা, কক্সবাজার, সিলেট, শ্রীমঙ্গল ও হবিগঞ্জের পাঁচতারকা হোটেলগুলো বার লাইসেন্সের আবেদন করে বসে আছে। তারা লাইসেন্স পাচ্ছে না। এমনকি অনেকগুলো সামাজিক ক্লাবও আবেদন-নিবেদন করে ক্লান্ত। সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলো নীরব। মালয়েশিয়া, মালদ্বীপ, আরব আমিরাত, কাতারের পর্যটনের দরজা খোলা। জঙ্গিবাদের কবল থেকে মুক্ত হতে এই মুসলিম দেশগুলোর কিছু কৌশল নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে। খুলে দিতে হবে উদারতার অনেক দরজা। সুস্থ ধারার সংস্কৃতির বিকাশ ঘটাতে হবে। ঈদের দিন সন্ধ্যার পর বেইলি রোড দিয়ে এক আত্মীয়ের বাড়ি যাচ্ছিলাম। রাস্তাজুড়ে যানজট। গুলশানের ক্ষত কাটিয়ে তারুণ্য ঘুরে বেড়াচ্ছে। ফুচকা খাচ্ছে, কেএফসি থেকে বের হচ্ছে। শোক কাটিয়ে সৃষ্টি হচ্ছে প্রাণচাঞ্চল্য। আমার ভালো লাগল। আমরা এই বাংলাদেশ দেখতে চাই।  উন্নত সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে চলাকে ধরে রাখতে চাই। অন্ধকারকে ছিন্ন করে আলোর পথে জেগে উঠতে হবে সবাইকে।

পাদটীকা : সিঙ্গাপুর গিয়েছিলাম মাসখানেক আগে। বিমানবন্দর থেকে সিঙ্গাপুরের একটি সিমকার্ড কিনলাম। মোবাইলে সিমকার্ড লাগানোর পর দোকানের সামনে নীরবে দাঁড়িয়ে আছি। দোকানি জানতে চান আর কিছু লাগবে কিনা। বললাম, না অপেক্ষা করছি বায়োমেট্রিক মানে আঙ্গুলের ছাপ দেওয়ার জন্য। দোকানি বললেন, তোমার সিমকার্ড এর মাঝে চালু হয়ে গেছে। কথা বলে দেখতে পার ঢাকায়। ফোন দিলাম ঢাকার অফিসে। কথা বললাম। আঙ্গুলের ছাপ দিতে হলো না। আবার বললাম, আঙ্গুলের ছাপ আসলে নেবে না? দোকানি বলল, তোমার পাসপোর্টের ফটোকপি রেখেছি। এই পাসপোর্ট নেওয়ার সময় তুমি আঙ্গুলের ছাপ দিয়েছ। কম্পিউটার টিপেই আমরা পেয়ে গেছি তোমার আঙ্গুলের ছাপ। তাই সিমকার্ড নেওয়ার সময় দরকার হয় না।  আজকাল অন্য দেশে গেলে সিমকার্ড নিয়েই আমি অনুরোধ করি আমার আঙ্গুলের ছাপ নিতে।  কিন্তু কেউ নেয় না।

     লেখক : সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর