বৃহস্পতিবার, ২৪ নভেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

সেই ভাসমান ক্রেন এখন মাওয়ায়

এগিয়ে চলেছে পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজ

মুন্সীগঞ্জ প্রতিনিধি

সেই ভাসমান ক্রেন এখন মাওয়ায়

অবশেষে দৃশ্যমান হতে চলেছে স্বপ্নের পদ্মা সেতু। শিগগিরই সেতুর মূল অবকাঠামো নির্মাণ বাস্তব রূপ নিতে যাচ্ছে। দেশের সর্ববৃহৎ এ সেতুর মূল অবকাঠামোগত নির্মাণ-প্রস্তুতি এখন চলছে জোরেশোরে। এরই মধ্যে সেতুর মূল অবকাঠামো (সুপার স্ট্রাকচার) নির্মাণে সর্বশ্রেষ্ঠ স্প্যানটি গতকাল দুপুরে মাওয়ার পদ্মা সেতু প্রকল্প এলাকায় এসে পৌঁছেছে। পদ্মা সেতুর সুপার স্ট্রাকচার (স্প্যান) স্থাপনে তিন হাজার ৬০০ টন ক্ষমতার ক্রেনটি প্রকল্প এলাকায় সবচেয়ে বড়। চীনের জোহাও থেকে মাদার ভেসেলে করে এটি রওনা হয়ে বাংলাদেশের কুতুবদিয়া চ্যানেল হয়ে মাওয়ায় আসে। নতুন ক্রেনটি আসার পর পাইল স্থাপন কাজের গতি বেড়ে যাবে। এর আগে শুক্রবার রাতে এটি কুতুবদিয়া চ্যানেলে এসে পৌঁছায়। পদ্মা সেতু প্রকল্পের নির্বাহী প্রকৌশলী দেওয়ান আবদুল কাদের জানান, সবচেয়ে বেশি ক্ষমতাসম্পন্ন বিশাল আকারের এ ক্রেনটিই সেতুর সুপার স্ট্রাকচার স্থাপনে কাজে লাগানো হবে। তিনি বলেন, তিন হাজার ৬০০ টন ক্ষমতার এই ক্রেন পদ্মা সেতু নির্মাণকাজে ব্যবহৃত হবে। বিশাল আকারের ভাসমান ক্রেনটি চট্টগ্রাম বন্দরের একটি বিশেষ টাগবোট দিয়ে নদীপথে টেনে মাওয়ায় নিয়ে আসা হয়। বাংলাদেশে ভাসমান ক্রেন হিসেবে কোরিয়া থেকে আমদানি করা বিআইডব্লিউটিএর উদ্ধারকারী জাহাজ প্রত্যয় ও নির্ভীকের ধারণক্ষমতা এক হাজার ৪০০ টন। সে তুলনায় চীনা এ ক্রেনের ক্ষমতা আড়াই গুণেরও বেশি। ভারী ক্রেনটি চলে আসার মধ্য দিয়ে সুপার স্ট্রাকচার স্থাপনের সব আয়োজন প্রায় সম্পন্ন। মূল সেতুর ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ সুপার স্ট্রাকচারে মোট ৪১টি স্প্যান থাকবে। প্রতিটি স্প্যানের দৈর্ঘ্য হবে ১৫০ মিটার এবং আনুমানিক ওজন ২ হাজার ৯০০ টন। ৩৫ মিটার উঁচু পিলার উঠবে। আর পিলারের ওপরই বসবে স্প্যান। এই পিলার গ্রুপের দৈর্ঘ্য ১২৮ মিটার। এর মধ্যে নদীর তলদেশ থেকে মাটির গভীরেই রয়েছে ১২২ মিটার। বাকি ছয় মিটার পানির মধ্যে। এখানে যাতে পানি ঢুকতে না পারে এমনভাবেই রাখা হয়েছে এটি। এদিকে জাজিরা প্রান্তে ভায়াডাক্টের (ভূমিতে সংযোগ সেতু) পাইলের কাজও শুরু হয়েছে। এটির কাজও এগিয়ে চলেছে দ্রুতগতিতে। পদ্মা সেতুর পাইল গ্রুপ সম্পন্ন হওয়া এটি প্রথম পিলার। এখান থেকেই পিলার তৈরির কাজ চলছে। এদিকে ৩৮ নম্বর পিলারের কাজও চলছে। এক পিলার থেকে অন্য পিলারের দূরত্ব ১৫০ মিটার। দুই পিলারের মাঝেই বসিয়ে দেওয়া হবে সুপার স্ট্রাকচারটি। আর এর ফলে দৃশ্যমান হতে শুরু করবে পদ্মা সেতু। জাজিরা প্রান্তে ভায়াডাক্টের পাইলের কাজও শুরু হয়েছে। এটির কাজও এগিয়ে চলেছে। উল্লেখ্য, পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ২৮ হাজার ৭৯৩ কোটি ৩৯ লাখ টাকা। চার লেনবিশিষ্ট এই সেতু ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এবং ২২ মিটার চওড়া। এটি ২০১৮ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হবে বলে সরকারের পক্ষ থেকে আগেই জানানো হয়েছে। ৩ মিটার ব্যাসের ৪০০ ফুট দীর্ঘ পাইলটি ৪০ ফুট ভিতরে প্রবেশ করেছে। অন্যদিকে নদীর মাঝে মাঝে চলছে ড্রেজিং ও পিলার পাইলিংয়ের কাজ। চীনের প্রকৌশলীরা জানিয়েছেন, নতুন বছরের জানুয়ারি বা ফেব্রুয়ারি মাসে দুটি পিলারের ওপর স্প্যান-গার্ডার বসিয়ে দেওয়া সম্ভব হবে, এতে পদ্মা নদীর ওপর সেতু আকৃতি স্পষ্ট হবে। অর্থাৎ বছর শেষ হলেই পিলারের ওপর ভর করে দাঁড়াবে স্বপ্নের পদ্মা সেতু। এই সেতুটির মূল অবকাঠামো তৈরি করা হচ্ছে স্টিল দিয়ে। তীব্র বায়ুপ্রবাহ ও ভূমিকম্পজনিত ধাক্কা মোকাবিলায় বেছে নেওয়া হয়েছে ওয়ারেন ট্রাস ফর্ম। চীন ও বাংলাদেশের শ্রমিকরা যৌথভাবে সেতুর জয়েন্ট, সেকশন, গার্ডার, টপকর্ড ও বটমকর্ড অংশের কাজ নিয়ে ব্যস্ত। এগুলোর বেশির ভাগ কাজই স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে হচ্ছে। মাওয়া পয়েন্টে টোল প্লাজা, সংযোগ সড়কে থাকা ব্রিজ, সংযোগ সড়কের পাশের সার্ভিস রোড তৈরি হচ্ছে। পদ্মা সেতু প্রকল্পের প্রকৌশলী দেওয়ান কাদের জানান, যে দুটি স্প্যানের কাজ চলছে সেগুলো মাওয়া অংশের ৬ ও ৭ নম্বর পিলারের মাঝামাঝিতে এবং আরেকটি স্প্যান ৩৭ ও ৩৮ এর মাঝামাঝি বসবে। সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, পদ্মা নদীর মধ্যে কয়েকটি পিলার দৃশ্যমান হয়েছে। নতুন আরও কয়েকটি পিলারের কাজ চলছে। নদীর দুই পাশে সংযোগ সড়কের কাজও প্রায় শেষের দিকে। তবে সংযোগ সেতুর কিছু কাজ উদ্বোধনের ঠিক আগে শেষ করা হবে, যাতে ফিনিশিং সুন্দর হয়। পদ্মা সেতুর মাধ্যমে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার সঙ্গে দেশের অন্য জেলাগুলোর যাতায়াত ব্যবস্থা অনেক এগিয়ে যাবে। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোতে শিল্প-কারখানা গড়ে ওঠার সুযোগ সৃষ্টি হতে যাচ্ছে। এর মাধ্যমে ব্যবসা-বাণিজ্য প্রসার লাভ করবে। পদ্মা সেতু বাস্তবায়িত হলে উন্নয়নশীল নয়, উন্নত বাংলাদেশ হিসেবে বিশ্বের দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে—এমনটাই আশা দেশবাসীর।

সর্বশেষ খবর