বৃহস্পতিবার, ১২ জানুয়ারি, ২০১৭ ০০:০০ টা

সহিংস কিশোরদের ভয়ঙ্কর গ্রুপ

জিন্নাতুন নূর

ছায়াছবিতে এলাকায় আধিপত্য বিস্তার নিয়ে লড়াই দেখা যায়। নায়ক-খলনায়করা দেখান অস্ত্রের ঝনঝনানি; তাদের মধ্যে চলে হামলা আর পাল্টা হামলা। বাস্তব জীবনেও দেশের বিভিন্ন এলাকায় পেশাদার সন্ত্রাসীদের মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্বে রক্তক্ষয় ও প্রাণহানি ঘটে। কিন্তু এলাকায় শক্তি প্রদর্শনে শিশু-কিশোরদের ‘গ্যাং’, ‘গ্রুপ’ বা ‘দল’ গঠন করার ভয়ঙ্কর বিষয়টি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও অভিভাবকদের গভীর উদ্বিগ্ন করে তুলছে। সম্প্রতি রাজধানীর উত্তরায় ট্রাস্ট কলেজের নবম শ্রেণির ছাত্র আদনান কবিরকে স্থানীয় গ্রুপ ‘ডিসকো বয়েজ উত্তরা’র ছেলেরা হত্যা করে। আদনান নিজেও ‘নাইন স্টার’ নামে উত্তরার আরেকটি গ্রুপের সদস্য ছিল।

জানা যায়, উত্তরায় দুই বছর ধরে কিশোরদের কয়েকটি গ্রুপ নিজেদের প্রভাব বিস্তারকে কেন্দ্র করে নিয়মিত সংঘর্ষে জড়াচ্ছে। এই গ্রুপের কর্মীরা ফেসবুকেও পরস্পরকে অশ্রাব্য ভাষায় ধমকাধমকি করে। কথায় কথায় জানে মেরে ফেলার হুমকি দেয়। ফেসবুকে সহিংসতা প্রকাশের জন্য তারা বিভিন্ন ইমো যেমন বোম, রিভলবার, ছুরি ইত্যাদি ব্যবহার করে। উত্তেজনা বৃদ্ধি করতে এদের প্রত্যেকের আসল নামের পাশে ব্র্যাকেটে নিজের দেওয়া নেতিবাচক একটি নামও থাকে। এরা বিভিন্ন সময় উত্তরার বিভিন্ন রাস্তায় উচ্চ শব্দে মোটরবাইক হাঁকায়, মেয়েদের উত্ত্যক্ত করে। কিশোরদের এই ভয়ঙ্কর গ্রুপের কর্মীরা অষ্টম, নবম ও দশম শ্রেণির ছাত্র। এদের বয়স ১৪ থেকে ১৮। আর এদের নেতারা এইচএসসি পরীক্ষার্থী। মূলত নাইন স্টার ও ডিসকো বয়েজ এ দুটি গ্রুপের তৎপরতা বেশি দেখা গেলেও ‘বিগ বস’, ‘পাওয়ার বয়েস উত্তরা’, ‘নাইন এম এম বয়েজ উত্তরা’ নামে আরও কয়েকটি গ্রুপ রয়েছে। প্রথমে খেলা ও আড্ডা থেকে এ গ্রুপগুলো গঠিত হলেও একপর্যায়ে প্রভাব বিস্তারকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষে জড়ায়। জানা যায়, দীর্ঘদিন ধরেই নাইন স্টার গ্রুপ ও ডিসকো বয়েজের মধ্যে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে দ্বন্দ্ব চলছিল। উত্তরা ১১ ও ৯ নম্বর সেক্টরে আধিপত্য ছিল ডিসকো গ্রুপের আর ১২ ও ১৩ নম্বর সেক্টর ছিল নাইন স্টার গ্রুপের দখলে। নিহত আদনান কবির ছিল নাইন স্টার গ্রুপের সদস্য। তার বন্ধু চৌধুরী রাজ (পাগল)। ফেসবুকে নিজের পরিচয় হিসেবে লিখেছে ‘ঢাকাইয়া গ্যাংস্টার’, ‘ভাই অ্যাট আন্ডারওয়ার্ল্ড’। এ ছাড়া ফেসবুকে শাহরিয়ার ইসলাম নামে ডিসকো গ্রুপের আরেক সদস্য সম্প্রতি দেওয়া একটি স্ট্যাটাসে লিখেছে, ওভ ঁ wanna play gangstah (gangster) in Bangladesh than be a member of disco boys of uttara. এ ছাড়া আদনানের হত্যাকাণ্ডের পরও এক গ্রুপের সদস্যরা ফেসবুকে অন্য গ্রুপকে আদনান হত্যার প্রতিশোধ নেওয়ার হুমকি দিয়েছে। জানা যায়, উত্তরার মাইলস্টোন, ট্রাস্ট, রাজউকসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্ররা এই গ্রুপগুলোর সঙ্গে জড়িত। এদের মধ্যে যেমন উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তান আছে তেমন আছে নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তানও। তাদের অনেকেই আবার পড়ালেখায় অনিয়মিত। অনেকে ফেসবুক ও ইনস্ট্রাগ্রামে মদভর্তি বোতলসহ ছবি আপলোড করছে। এলাকায় মহড়া দেওয়ার সময় তারা হকিস্টিক, লাঠি, দেশি ছুরি ইত্যাদি বহন করে। আদনানকে মারার সময়ও ধারালো অস্ত্র, হকিস্টিক ব্যবহার করা হয়েছিল। এর আগে গত বছর রাজধানীতে ক্রিকেট খেলাকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষে বাবুল শিকদার নামে এক কিশোরের মৃত্যু হয়। সে ছিল এসএসসি পরীক্ষার্থী। কল্যাণপুরের জনতা হাউজিংয়ের ধান খেত মোড়ে দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ বাধলে প্রতিপক্ষ দলের বিধান নামে এক ছেলে স্টাম্প দিয়ে তার মাথায় আঘাত করলে বাবুল গুরুতর আহত হয়। এরপর সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে নেওয়ার পথে তার মৃত্যু হয়। বিভিন্ন গবেষণা বলছে, বাংলাদেশে ইন্টারনেট ও স্মার্টফোনের সহজলভ্যতার জন্য এখন ৮ বছর বয়সেই একটি শিশু ফেসবুক আইডি খুলছে। আর ফেসবুকে বিভিন্ন সময় সহিংসতার ছবি ও ভিডিও প্রকাশ করায় শিশু-কিশোরদের মনে সহিংসতার সঞ্চার হচ্ছে। ওরা মনে করে, সহিংস হয়ে উঠলে ফেসবুকে সহজেই জনপ্রিয়তা পাওয়া যায়। সমাজবিজ্ঞানী ও মনোবিজ্ঞানীরা মনে করেন, অস্থির ও বাণিজ্যনির্ভর সমাজব্যবস্থায় মাদকদ্রব্য সহজলভ্য হওয়ায় শিশু-কিশোররা সহিংসতামূলক আচরণে প্রলুব্ধ হচ্ছে। মনোবিজ্ঞানী অধ্যাপক মেহতাব খানম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, শিশু-কিশোররা এখন একটি অস্থির সমাজব্যবস্থার মধ্য দিয়ে সময় পার করছে। ফলে সহজেই তারা সহিংসতামূলক আচরণে প্রলুব্ধ হচ্ছে। রাজধানীর সিসা বার ও ডিজেগুলোতেও এখন কিশোর-কিশোরীরা নিয়মিত যাতায়াত করছে। এসব জায়গায় গিয়ে বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে তাদের অনেকেই ভয়াবহ মাদক ইয়াবা গ্রহণ করছে। এর প্রভাবে রাতভর মোবাইলে কথোপকথন এবং ইন্টারনেটে বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমের অপব্যবহার করছে। এ ছাড়া বিভিন্ন সহিংসতামূলক ভিনদেশি চলচ্চিত্র ও গেমসের প্রতি আসক্তি তৈরি হচ্ছে। এর ফলাফল হিসেবে কিশোররা দিন দিন অস্থির ও সহিংস হয়ে উঠছে। মাদক নিরাময় কেন্দ্র ‘লাইট হাউস’-এর কনসালট্যান্ট ডা. জসীম চৌধুরী বলেন, ইয়াবা সেবনের ফলে কিশোরদের মানসিক আচরণ ক্রমেই সহিংস হয়ে উঠছে। যদি এখনই মাদকে ঝুঁকিপূর্ণ কিশোরদের সঠিক পথে ফিরিয়ে আনা না যায় তাহলে সামনের ১০ বছরে দেশে ভয়ঙ্কর অপরাধ ও ‘হোমিসাইড সুইসাইড’-এর মতো ঘটনা বেড়ে যাবে। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, শিশুদের জন্য শ্রেষ্ঠ বিদ্যালয় হচ্ছে তার পরিবার। কিন্তু এখন সেই পরিবারেই অবক্ষয় ঘটছে। উচ্চবিত্ত পরিবারের অভিভাবকরা সন্তানদের প্রয়োজনের অতিরিক্ত টাকার জোগান দিয়ে নিশ্চিন্ত থাকেন। আর খোঁজখবর রাখেন না। অন্যদিকে বর্তমানে দেশে সুস্থ বিনোদনের যথেষ্ট অভাব। ছেলেমেয়েদের সংস্কৃতি ও শরীরচর্চার কোনো সুযোগ নেই। এ ছাড়া আকাশ সংস্কৃতির আগ্রাসনে ছেলেমেয়েদের আচরণেও নেতিবাচক পরিবর্তন এসেছে। এ অবস্থার উন্নতির জন্য রাষ্ট্রের মনিটরিং বাড়াতে হবে। সেই সঙ্গে অভিভাবকদেরও ভূমিকা রাখতে হবে।

সর্বশেষ খবর