এক সময় আকাশভরা তারার দৃশ্য ছিল পৃথিবীর মানুষের কাছে খুবই সাধারণ। ১৮ শতকের আগে, যখন প্যারিসে প্রথম গ্যাস লাইটের মাধ্যমে রাস্তা আলোকিত হয়, তখনো ছায়াপথ বা মিল্কি ওয়ে দেখা যেত চাঁদের মতোই স্বাভাবিকভাবে। কিন্তু গত কয়েক দশকে আলোক দূষণ এতটাই তীব্র হয়ে উঠেছে, বহু মানুষই রাতের আকাশের আসল সৌন্দর্য, সেই হাজারো তারার ঝিকিমিকি, দেখতে পায় না।
জ্যোতিঃপদার্থবিদ এবং ডকুমেন্টারি ফটোগ্রাফার জর্দি বুসকে ছোটবেলা থেকেই মহাকাশের প্রতি আকৃষ্ট ছিলেন। স্পেনের একটি ছোট গ্রাম, যেখানে মাত্র চারজন স্থায়ী বাসিন্দা ছিল। সেই গ্রামের আকাশ তাকে প্রথম বিস্মিত করে। তার মনে হতো, তিনি যেন রকেটে চড়ে মহাকাশে চলে এসেছেন। এই অভিজ্ঞতা তাকে অনুপ্রাণিত করে। এখন তিনি একজন জ্যোতিঃপদার্থবিদ এবং বিজ্ঞান প্রচারক হিসেবে বিশ্বের সেই শেষ স্থানগুলোর সন্ধানে ঘুরে বেড়ান। যেখানে এখনো দেখা মেলে সত্যিকার অর্থে কালো, তারাময় রাতের আকাশের।
মরক্কো থেকে শুরু করে আর্জেন্টিনার পাতাগোনিয়া পর্যন্ত জর্দি বুসকের তোলা বেশ কয়েকটি অসাধারণ ছবি উন্মোচন করে পৃথিবীর শেষ কিছু অন্ধকার আকাশের অভয়ারণ্য। যা মানবজাতিকে স্মরণ করিয়ে দেয় সেই পুরোনো মহিমার কথা। যা একসময় আমাদের চারপাশকে আচ্ছন্ন করে রাখত।
জর্দি বুসকে তাঁর অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে তুলে ধরেছেন কয়েকটি স্থানের কথা। যা রাতের আকাশকে এখনো আদিম যুগের মতো বাঁচিয়ে রেখেছে।
১. আন্দিস পর্বতমালা ও আতাকামা মরুভূমি
চিলির আতাকামা মরুভূমি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৪ হাজার মিটার উচ্চতায় অবস্থিত এবং এটি বিশ্বের শুষ্কতম অঞ্চলগুলোর একটি। এর অর্থ হলো, রাতে এখানে মেঘের চিহ্নও থাকে না, যা তারার ছবি তোলার জন্য আদর্শ। বুসকে এখানে ছায়াপথের এক বিশাল প্যানোরামিক দৃশ্য ধারণ করেছেন।
অন্যদিকে, বলিভিয়ার উচ্চভূমিতে প্রায় ৩ হাজার ৭০০ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত লবণ মরুভূমি বা উয়ুনি হলো অন্যরকম এক স্থান। সেখানে শুয়ে আকাশ দেখলে মনে হয়, যেন মহাশূন্যে বা চাঁদের পৃষ্ঠে ভাসছেন।
২. ছায়াপথের কেন্দ্র ও ম্যাগেলানিক মেঘ
স্পেনের ক্যানারি দ্বীপপুঞ্জ থেকে বুসকে ছায়াপথের কেন্দ্রের ছবি তুলেছেন। যা গ্রীষ্মকালে উত্তর গোলার্ধ থেকে সবচেয়ে ভালোভাবে দেখা যায়। এই উজ্জ্বল অংশটির দিকে তাকালে বোঝা যায়, পৃথিবী প্রতি ২৫ কোটি বছরে ছায়াপথকে একবার প্রদক্ষিণ করে।
এছাড়া, সত্যিকারের অন্ধকার স্থানে খালি চোখেও গ্যালাক্সি দেখা যায়। বুসকে বলিভিয়ার দৈত্যাকার ক্যাকটাস বাগানে বৃহৎ ম্যাগেলানিক ক্লাউড নামক বামন গ্যালাক্সির ছবি তুলেছেন। এটি আমাদের ছায়াপথের একটি উপগ্রহ গ্যালাক্সি এবং এটি শুধুমাত্র দক্ষিণ গোলার্ধ থেকেই দৃশ্যমান।
৩. দিগন্তের মিথ্যা ঊষা রাশিচক্রের আলো
রাতের আকাশের গুণগত মান পরীক্ষার একটি কঠিন মাপকাঠি হলো রাশিচক্রের আলো দৃশ্যমানতা। এই আলো সূর্যের আলো দ্বারা সৃষ্ট, যা আমাদের সৌরজগতের ভাসমান ধূলিকণা থেকে প্রতিফলিত হয়। দেখতে এটি একটি অস্পষ্ট, সরু এবং ত্রিভুজাকার আভার মতো। মরুর বুকে একে মিথ্যা ঊষা বলা হয়, কারণ এটি ভোরের আলোর মতো ভ্রম সৃষ্টি করতে পারে। বলিভিয়ার লবণ মরুভূমিতে এই বিরল দৃশ্য ক্যামেরাবন্দি করেছেন বুসকে।
৪. পাতাগোনিয়া ও মরক্কোর উপকূল
আর্জেন্টিনার পাতাগোনিয়ার কিংবদন্তী পর্বতশৃঙ্গ সেরো তোরের ছবি তোলার জন্য বুসকেকে তিনবার যেতে হয়েছে, কারণ এটি প্রায়শই মেঘে ঢাকা থাকে। এখানে তারার বিভিন্ন রং তাদের পৃষ্ঠের তাপমাত্রা এবং জীবনচক্রের স্তর সম্পর্কে ধারণা দেয়—যেমন, লাল তারা সাধারণত শীতল ও বয়স্ক হয়।
অন্যদিকে, মরক্কোর আটলান্টিক উপকূলে তারার মৃদু আলো দেখা যায়, যা সমুদ্রের দিকে ভূমির চেয়েও বেশি উজ্জ্বল। দুঃখজনকভাবে, আলোক দূষণের কারণে এই এলাকায় সদ্যোজাত সামুদ্রিক কচ্ছপেরা বিভ্রান্ত হয়ে ভুল পথে হেঁটে যায়।
৫. ইউরোপের শেষ আশ্রয়
ইউরোপে এখন আলোক দূষণমুক্ত স্থান খুঁজে পাওয়া কঠিন। তবুও স্পেনের মতো কিছু পাহাড়ি গ্রামীণ অঞ্চলে পিয়েরেনিস পর্বতমালায় এখনো আকাশের কিছু অংশ অন্ধকার থাকে। বুসকে এমন একটি দৃশ্যের ছবি তুলেছেন, যা রাতের আকাশের দিকে তাকিয়ে যে অনন্তকালের অনুভূতি জাগে তাকে ফুটিয়ে তোলে।
বুসকের বার্তা: তারার দিকে তাকান, জীবনকে মূল্যায়ন করুন জর্দি বুসকে সবাইকে রাতের আকাশ দেখতে উৎসাহিত করেন। তার মতে, রাতের আকাশের বিশালতার দিকে তাকিয়ে আমাদের অগ্রাধিকারগুলো পুনর্বিবেচনা করা উচিত। যখন আমরা রাতের আকাশের বিশালতাকে অনুভব করি, তখন এটি মনে করিয়ে দেয় যে আমাদের গ্রহটি একটি ব্যতিক্রমী স্থান। তার আহ্বান, আমাদের সংক্ষিপ্ত জীবনের তুলনায় এই মহাজাগতিক বস্তুদের দিকে তাকিয়ে পৃথিবীর এই যাত্রাপথে আরও সচেতন হওয়া প্রয়োজন।
সূত্র: বিবিসি
বিডি প্রতিদিন/নাজমুল