বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়-বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ হওয়ায় সত্ত্বেও ছাত্রলীগের ব্যানারে শোক দিবসের কর্মসূচি পালনকে কেন্দ্র করে দ্বিতীয় দিনেও উত্তেজনা ছড়িয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে। শিক্ষার্থীরা বুয়েট ক্যাফেটেরিয়ার সামনে অবস্থান নিয়ে ‘রাজনীতিমুক্ত ক্যাম্পাসে’র দাবি পুনর্ব্যক্ত করেছেন। এছাড়াও আজ সোমবার ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শাহাদাত বার্ষিকী ও জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষ্যে স্মরণসভা ও দোয়া অনুষ্ঠানের কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন তারা।
অন্যদিকে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক কর্মসূচি থেকে বুয়েটে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ‘জামায়াত-শিবিরের প্রেতাত্মা’ আখ্যা দিয়ে ক্যাম্পাসটিতে ছাত্ররাজনীতি পুনরায় চালু করার দাবি জানিয়েছেন ছাত্রলীগের সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয়।
এর আগে, শনিবার বিকেল পাঁচটায় বুয়েট ক্যাফেটেরিয়ায় 'বাংলাদেশ ছাত্রলীগ, বুয়েটের সাবেক নেতৃবৃন্দ' -এর উদ্যোগে বঙ্গবন্ধুর শাহাদাত বার্ষিকী উপলক্ষ্যে 'আলোচনা ও দু'আ'র আয়োজন করলে তা নিয়ে আপত্তি জানায় বুয়েটের সাধারণ শিক্ষার্থীরা। অনুষ্ঠানটি চলাকালেই ক্যাফেটেরিয়ার সামনে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ জানায় তারা।
তবে, এ ঘটনার পর শিক্ষার্থীদের এ প্রতিবাদকে ‘বঙ্গবন্ধুর শোকসভার বিরোধিতা’ বলে আখ্যা দিয়ে বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি চালুর জোর দাবি জানিয়ে আসছেন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার নেতা-কর্মীরা। তাদের দাবি, ছাত্ররাজনৈতিক কার্যক্রম না থাকায় বুয়েটে মৌলবাদী গোষ্ঠী মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে।
‘বুয়েটে পাকিস্তানি প্রেতাত্মারা মাথাচাড়া দিচ্ছে’
রবিবার দুপুরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে ঢাবি ছাত্রলীগ কর্তৃক আয়োজিত বঙ্গবন্ধুর খুনিদের ফিরিয়ে আনার ও বিচারের রায় কার্যকরের দাবিতে এক মানববন্ধনে ছাত্রলীগ সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয় বলেন, বুয়েট ক্যাম্পাসে পাকিস্তানের প্রেতাত্মা যারা মাথা ছাড়া দিচ্ছে তাদের চিহ্নিত করা হবে। প্রশাসন ও গোয়েন্দা সংস্থার কাছে অনুরোধ করব, যারা বঙ্গবন্ধুর শোকের প্রোগ্রাম বানচাল করার প্রচেষ্টা হাতে নিয়েছে তাদেরকে আপনারা খুঁজে বের করুন, তাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদোহ মামলা করা উচিত। আন্দোলনকারীদের নিয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে তিনি বলেন, জামায়াত-শিবিরের প্রেতাত্মারা নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের বড় ভাইদের সাথে কী বেয়াদবিটা করল দেখেছেন!
বুয়েটের প্রশাসনের উদ্দেশ্যে জয় বলেন, ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করে আপনারা কি বুঝাতে চান? আপনারা কি বুয়েটকে জঙ্গিমুক্ত করতে পারবেন? পারবেন না। এই জঙ্গি চক্র আপনাদেরকেই প্রথমে হত্যা করবে। বুয়েটকে জঙ্গিমুক্ত করতে ছাত্ররাজনীতি আবারো সচল করার বিষয়টি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে বিবেচনার কথা বলেন জয়।
‘আমরা বঙ্গবন্ধুর আদর্শে উজ্জীবিত, জবাবদিহির জন্য বিক্ষোভ’
এদিকে, শনিবার ঘটনায় আজ বিকেলে মধুর ক্যান্টিন থেকে বুয়েট শহীদ মিনার পর্যন্ত লং মার্চ কর্মসূচি পালন করা হবে ফেসবুকে এমন পোস্ট দিতে দেখা যায় ছাত্রলীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের। অবশ্য, এ ব্যাপারে পরবর্তী সময়ে সাংগঠনিক সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে জানিয়ে তা স্থগিতের কথাও জানান তারা।
লংমার্চের সংবাদে বুয়েট ক্যাফেটেরিয়ার সামনে অবস্থান নেন বুয়েটের শিক্ষার্থীরা। পরে এক সংবাদ সম্মেলনে ‘বঙ্গবন্ধুর আদর্শে উজ্জীবিত বুয়েটের সাধারণ শিক্ষার্থী’র ব্যানারে নিজেদের অবস্থান তুলে ধরেন তারা। শনিবারের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে সেখানে বলা হয়, সেমিনার কক্ষে (শোক দিবসের) অনুষ্ঠান যথারীতি সমাপ্ত হয় এবং শিক্ষার্থীরা সেখানে কোনোরূপ বাধা প্রদান করেনি। আমাদের বিক্ষোভের মূল উদ্দেশ্য ছিল, ক্যাম্পাসে রাজনৈতিক ছাত্রসংগঠনের ব্যানার ব্যবহার করার অনুমতি প্রদান করায় কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে জবাবদিহিতা আদায় করা। অতীতে বুয়েটের একাধিক শিক্ষার্থী ক্যাম্পাসে বিরাজমান রাজনৈতিক অপসংস্কৃতির বলি হয়েছে, যাদের সর্বশেষ সংযোজন ছিল আবরার ফাহাদ। লেজুড়বৃত্তিক ছাত্র রাজনীতির কালো থাবা নিরাপদ আমাদের নিরাপদ ক্যাম্পাস যেন পুনরায় ত্রাসের রাজত্বে পরিণত না করতে পারে, সেই আশঙ্কার জায়গা থেকে গতকাল আমরা সাধারণ শিক্ষার্থীরা সমবেত হই।
তারা আরও বলেন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্ন প্লাটফর্মে আমাদের কর্মসূচি ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার জোর অপপ্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে। উক্ত অপপ্রচার আমাদেরকে করেছে ভীত, সন্ত্রস্ত এবং একই সাথে ব্যথিত। আজকে আমরা স্পষ্টভাবে ব্যক্ত করতে চাই, আমাদের গতকালকের কর্মসূচি কোনভাবেই ক্যাম্পাসে আয়োজিত শোক দিবসের অনুষ্ঠান বিরোধী ছিল না। ধর্ম, বর্ণ, রাজনৈতিক পরিচয় নির্বিশেষে বুয়েটের সাধারণ শিক্ষার্থীবৃন্দ বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে ধারণ করে। তাঁর চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে আমরা সমৃদ্ধিময় সোনার বাংলাদেশ গড়ে তুলতে সদা প্রস্তুত। আমরা এও বিশ্বাস করি যে, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু সার্বজনীন, তাঁর চেতনা ধারণ করতে কোন রাজনৈতিক সংগঠনের পরিচয় ধারণের প্রয়োজন পড়ে না।
সংবাদ সম্মেলন থেকে সোমবার শোক দিবস উপলক্ষ্যে সাধারণ শিক্ষার্থীদের উদ্যোগে স্মরণসভা এবং দোয়া মাহফিল আয়োজনের কথাও জানানো হয়।
আরও সতর্কতার সাথে প্রাক্তনদের অনুষ্ঠানে অনুমতি
এদিকে, ভবিষ্যতে প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের অনুষ্ঠানের আরও সতর্কতার সাথে অনুমতি দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন বুয়েটের ছাত্রকল্যাণ পরিদপ্তরের পরিচালক মিজানুর রহমান। তিনি বলেন, গতকালের অনুষ্ঠানের জন্য বুয়েটের প্রাক্তন শিক্ষার্থী হিসেবে অনুমতি চাওয়া হয়েছিল, কিন্তু সেটি করা হয় একটি রাজনৈতিক সংগঠনের ব্যানারে। এটি নিয়েই মূলত ভুল–বোঝাবুঝিটা তৈরি হয়। গতকালের অনুষ্ঠানের আয়োজক ছিলেন অ্যালামনাইরা। অ্যালামনাইদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কোনো সক্ষমতা আমাদের নেই। যেটুকু আমাদের হাতে আছে তা হলো, ভবিষ্যতে অ্যালামনাইদের কেউ ক্যাম্পাসে কোনো অনুষ্ঠান করার অনুমতি চাইলে আরেকটু যাচাই-বাছাই করে সতর্কতার সঙ্গে অনুমতি দিতে হবে।’
উল্লেখ্য, ২০১৯ সালের ৭ অক্টোবর তৎকালীন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের নির্যাতনে বুয়েট শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ নিহত হন। এর প্রতিবাদে বুয়েটের সাধারণ শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের প্রেক্ষিতে ২০১৯ সালের ১১ অক্টোবর বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে সকল রাজনৈতিক সংগঠন এবং এর কার্যক্রম কর্তৃপক্ষের নির্দেশক্রমে নিষিদ্ধ করা হয়।
বিডি-প্রতিদিন/সালাহ উদ্দীন