চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে (চবি) আবারো এক সাংবাদিককে মারধর করে 'দেখে নেওয়ার' হুমকি দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা ছাত্রলীগের উপগ্রুপের কর্মীরা। এর আগেও সংবাদ সংগ্রহ করায় এক নারী সাংবাদিককে হেনস্তা ও হুমকি, চায়ের দোকানে বসাকে কেন্দ্র করে আরেক সংবাদ কর্মীকে মারধর, শিক্ষককে হুমকি এবং চীফ ইঞ্জিনিয়ার ও নিরাপত্তা প্রধানকে মারধর'সহ বিভিন্ন ঘটনায় সংবাদের শিরোনাম হয়েছে চবি ছাত্রলীগ।
প্রশাসনের প্রশ্রয়ে বেপরোয়া হয়ে উপাচার্য দপ্তর, পরিবহনের প্রায় ৬০ টি গাড়ি, শিক্ষক ক্লাব ও পুলিশ বক্স তছনছের পরে গত তিনদিনে পরপর সংঘর্ষে জড়িয়েছে এই সংগঠনটির নেতাকর্মীরা। বর্তমানে ক্যাম্পাসে থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে। ভাংচুর, সংঘর্ষ ও হুমকি-ধমকিসহ বিভিন্ন ঘটনার জেরে রবিবার (২৪ সেপ্টেম্বর) চবির কমিটি বিলুপ্ত করেছে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সংসদ।
চাঁদাবাজি, অনিয়ম এবং উশৃংখলতা তীব্র হওয়ায় ছাত্রলীগের উপর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। ফলে লাগামহীন এসব কর্মীদের নিয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের মনে ভয় ও শঙ্কা বিরাজ করছে।
রবিবার (২৪ সেপ্টেম্বর) বেলা সাড়ে ১১টায় শাখা ছাত্রলীগ সভাপতি রেজাউল হক রুবেলের নেতৃত্বাধীন সিএফসি গ্রুপের কর্মীরা প্রথম আলোর প্রতিনিধিকে মারধর করে। এসময় "আর নিউজ করিস, তারপর দেখব'' বলে হুমকিও দেন তারা।
মারধরের শিকার মোশাররফ জানান, বেলা সাড়ে ১১ টার দিকে আমি উপাচার্যের কার্যালয়ে যাচ্ছিলাম ছাত্রলীগের সংঘর্ষ, ভাঙচুর, প্রধান প্রকৌশলীকে মারধরসহ বিভিন্ন বিষয়ে বক্তব্য নেওয়ার জন্য। এ সময় নতুন কলা ও মানববিদ্যা অনুষদের সামনে ১৫ থেকে ২০ জন ছাত্রলীগের কর্মী আমাকে প্রথমে পিছন থেকে ধাক্কা দেয়। এরপর ছাত্রলীগ নিয়ে কেন প্রতিবেদন করেছি, তা জানতে চায়। কয়েকজন আমার কপালে, মুখে কিলঘুষি, বুকে লাথি দেয়, হাতেও আঘাত করে।
মোশাররফ বলেন, মারধরের সময় তারা আমাকে পরবর্তীতে ছাত্রলীগ নিয়ে আর কোন প্রতিবেদন না ছাপানোর হুমকি দেন। তারা বলেন, 'আর নিউজ করিস, তারপর দেখব তোরে কে বাঁচাতে আসে। ছাত্রলীগকে নিয়ে কোন নিউজ হবে না।'
তার শারীরিক অবস্থা বর্ণনা করে বিশ্ববিদ্যালয় চিকিৎসা কেন্দ্রের প্রধান চিকিৎসা কর্মকর্তা মো. আবু তৈয়ব বলেন, মোশাররফের কপালে চার সেলাই দিতে হয়েছে। তার হাতেও আঘাত আছে। এক্সরে করাতে হবে। এ ছাড়া উন্নত চিকিৎসার জন্য চমেকে পাঠানো হয়েছে।
এদিকে সাংবাদিকের উপর হামলাকে গণতন্ত্রের জন্য হুমকি মনে করছেন চবি যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক খ. আলী আর রাজী। তিনি বলেন, এটা স্বাধীন সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে যেমন বাধা, তেমনি গণতন্ত্রের জন্যও বড় ধরনের বাধা। সাংবাদিকতা করতে গিয়ে জীবনকে ঝুঁকিতে ফেলতে হলে দেশে গণতন্ত্র বলে কিছু থাকবে না। আজকে তার জীবন বিপন্ন হতে পারতো। জীবনের চেয়ে তো বড় সাংবাদিকতা হতে পারে না। জীবন না থাকলে সাংবাদিকতা দিয়ে কি করবেন? কোনো যুদ্ধের ক্ষেত্রেও সাংবাদিকদের একটা নিরাপত্তা থাকে। কিন্তু এখানকার প্রশাসন এতটাই অযোগ্য যে সাংবাদিকদের কোনো নিরাপত্তা দিতে পারে না। বিচার না হওয়াতে যারা সাংবাদিক পেটাচ্ছে তারা একটা বার্তা দিচ্ছে যে, দেখো আমরা সাংবাদিকদেরই কেয়ার করি না। এমন পরিস্থিতি হলে সাধারণ শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা কথা বলার সাহস পাবে কিভাবে? এ পরিস্থিতির পরিবর্তন না হলে ফলাফল আরও ভয়াবহ হবে।
এবিষয়ে শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক আবদুল হক বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ৭৩ এর অধ্যাদেশকে সমুন্নত রেখে আইনের শাসন এবং নীতি নৈতিকতা মেনে প্রশাসন পরিচালনা করতে হয়। কিন্তু এই প্রশাসনের আগ্রহের জায়গা হচ্ছে নিয়োগ বাণিজ্য এবং ব্যক্তিগত সুবিধা আদায় করা। নিয়োগ কেলেঙ্কারি'সহ বিভিন্ন সুবিধাভোগ করতে করতে প্রশাসনের ইমেজ তলানিতে পৌঁছে দিয়েছে। এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের যে একটা প্রশাসন আছে তা কেউ অনুভব করে না। এভাবে একটা বিশ্ববিদ্যালয় চলে না। প্রথম আলোর প্রতিনিধিকে মারধর কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এর আগেও এমন অনেক ঘটনা ঘটেছে যার বিচার হয়নি। বিচারহীনতার সংস্কৃতির দরুন এখানে এতো এতো অব্যবস্থাপনা রয়েছে, প্রশাসনের কোনো ভাবমূর্তি নাই। ডিসিপ্লিনারি কমিটি ঘটনাগুলোর বিচার করে শাস্তি দেয় আবার ছাত্রলীগ ক্ষমা চাইলে ক্ষমা করে দেয়, শাস্তি কার্যকর নতজানু নীতি ফলো করে অর্থাৎ যে লাউ সে কদু। এসব বিচার করার জন্য করা, কার্যত কিছুই না।
এদিকে এঘটনার প্রতিবাদে বিকেল ৩টায় ভুক্তভোগী সাংবাদিক মোশাররফ শাহের উপর বর্বরোচিত হামলার প্রতিবাদে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতি (চবিসাস) মানববন্ধন করেছে। এসময় দপ্তর সম্পাদক মোহাম্মদ আজহারের সঞ্চালনায় সভাপতি মাহবুব এ রহমান বলেন, প্রশাসন বিশ্ববিদ্যালয়কে ছাত্রলীগের কাছে ইজারা দিয়েছে বলে মনে হচ্ছে। বহিষ্কৃত ছাত্রলীগ কর্মী তার গ্রুপের নেতাকে নিয়ে ক্যাম্পাস দাপিয়ে বেড়ালেও প্রশাসন কিছু দেখছেন না, আবার শাস্তি ক্ষমা করে পরীক্ষায় বসতে দিচ্ছেন। এসব নতজানু নীতির কারণে ছাত্রলীগ নিয়মশৃঙ্খলা ভঙ্গ করতে কোনো ভয় পাচ্ছে না। আমি কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের কাছে আহ্বান করবো এসব ঘটনায় জড়িতদের শাস্তির আওতায় নিয়ে আসা হোক। স্বাধীন সাংবাদিকতা করতে ছাত্রলীগ এভাবে বাধা দিতে পারে না। এঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে ব্যবস্থা নিতেই হবে।
এসব ঘটনায় কথা বলতে একাধিকবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হয় চবি উপাচার্য ও উপ-উপাচার্যের সাথে। তবে তারা কল কেটে দেন।
বিডি প্রতিদিন/হিমেল