১৯ আগস্ট, ২০২২ ০৯:২০

মিরসরাই ট্রাজেডি; দুর্ঘটনা প্রতিরোধে ৬ সুপারিশ তদন্ত কমিটির

সাইদুল ইসলাম, চট্টগ্রাম

মিরসরাই ট্রাজেডি; দুর্ঘটনা প্রতিরোধে ৬ সুপারিশ তদন্ত কমিটির

মিরসরাইয়ে ট্রেন-মাইক্রোবাস সংঘর্ষের ঘটনার তদন্তে ভবিষ্যতে বা আগামীতে এই ধরণের দুর্ঘটনা প্রতিরোধে লেভেল ক্রসিং গেইটের অব্যবস্থাপনা দূর করতে ৬ টি সুপারিশ করেছে তদন্ত কমিটি। তাছাড়া আধুনিকায়নের প্রতিও মনোযোগী হতে বলা হয়েছে তদন্ত প্রতিবেদনে।

জানা গেছে, চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ের ট্রেনের সাথে মাইক্রোবাসের সংঘর্ষের ঘটনায় প্রতিবেদন জমা দিয়েছে তদন্ত কমিটি। প্রতিবেদনে গেটম্যান ও মাইক্রোবাস চালককে সমান ভাবে দায়ী করা হয়। কমিটির দেয়া ৬টি সুপারিশই লেভেল ক্রসিং (এলসি) গেইট সংক্রান্ত। 

দেশের অধিকাংশ লেভেল ক্রসিং গেইটই ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে ব্যবহার করা হয়। এর মধ্যে সারাদেশে বিদ্যমান এলসি গেটের অর্ধেকই অবৈধ। বৈধ যেসব এলসি গেট রয়েছে সেগুলোতে পর্যাপ্ত জনবল নেই। নেই আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার। জনসংখ্যার অতি ঘনত্বের দেশ হিসাবে বাংলাদেশে রেলপথের আশেপাশে মানুষের বসবাস, চলাচল ও সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা রয়েছে। নিয়ম অনুযায়ী রেলপথের চারপাশে চলাচলের ক্ষেত্রে আইন অনুযায়ী বিধিনিষেধ থাকলেও সেগুলোর প্রতিপালন করা কঠিন হয়ে পড়ে। যার কারণে প্রতিদিনই সারাদেশে কোন না কোন ভাবে ট্রেনের নিচে কাটা পড়ে মানুষ নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটছে। সাম্প্রতিক সময়ে এলসি গেটের বাধা না মেনে যানবাহন চলাচল বেড়ে যাওয়ায় ট্রেনের সাথে দূর্ঘটনাও বেড়েছে।  

প্রতিবেদনে সুপারিশগুলোর মধ্যে রয়েছে, বেরিয়ার ফেলানোর পর সাধারণ মানুষ যাতে গেট বেরিয়ার উঠাতে না পারে সেজন্য প্রত্যেকটি গেট লকিং রাখতে হবে, সকল এলসি গেইটে ট্রেন আসা যাওয়ার তথ্য প্রদানের জন্য টেলিফোন যোগাযোগ ব্যবস্থা করা যেতে পারে, সকল এলসি গেইটের উন্নত প্রযুক্তির প্রবর্তন, সকল এলসি গেইটে ক্লোজ সার্কিট (সিসি) ক্যামেরা স্থাপন, সকল এলসি গেইটে বিদ্যুতায়ন নিশ্চিত করা এবং রেলওয়ের জিএন্ডএস রুলের (আবশ্যিক নির্দেশনা) ২৩৩/খ এর সঠিক বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা। 

রেলওয়ের এ সংক্রান্ত নথি পর্যালোচনায় দেখা গেছে, এলসি গেইটগুলোর সিংহভাগই টেলিফোন সংযোগ নেই, বিদ্যুৎ সংযোগ নেই, এলসি গেইট বেরিয়ার লক করার ব্যবস্থা নেই। পাশাপাশি সাম্প্রতিক সময়ে দূর্ঘটনা ঝুঁকি বেড়ে গেলেও সিসি ক্যামেরা ছাড়াও ডিজিটাল ইন্টারলকিং পদ্ধতির ব্যবহার নেই। অপর দিকে রেলওয়ের আইন অনুযায়ী গেইটম্যান এলসি গেট পরিচালনার ক্ষেত্রে যেসব আবশ্যিক নিয়ম প্রতিপালন করার কথা সেগুলোও যথাযথ ভাবে মেনে চলা হয় না।  

গত ২৯ জুলাই বেলা দেড়টার দিকে ঢাকা থেকে চট্টগ্রামমুখী মহানগর প্রভাতী আন্ত:নগর ট্রেন মিরসরাই এলাকা দিয়ে যাওয়ার সময় রেললাইনের উপর থাকা পর্যটকবাহী একটি মাইক্রোবাসকে ধাক্কা দেয়। ওই ঘটনায় ট্রেনটি মাইক্রোবাসকে অন্তত এক কিলোমিটার নিয়ে যায়। এতে ঘটনাস্থলে মারা যান ১১ জন ও পরে দুই জনের মৃত্যু হয়। আহত বাকি ৫ জন বর্তমানে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছে। 
গত ১৪ আগষ্ট তদন্ত কমিটি তাদের কাজ সম্পন্ন করে স্বাক্ষর করেছেন। প্রতিবেদনে বেরিয়ার ফেললেও ঘটনাস্থলে উপস্থিত না থাকার জন্য গেটম্যানকে শাস্তির আওতায় আনতে সুপারিশ করা হয়।

প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, ট্রেন যাওয়ার আগে গেটম্যান দুই পাশের ব্যারিয়ার ফেলেছিল। কিন্তু কেউ না কেউ একটি ব্যারিয়ার উঠিয়ে ফেললে মাইক্রোবাসটি ক্রসিং পার হয়ে যায়। কিন্তু অপর প্রান্তের ব্যারিয়ার নামানো থাকায় দ্রুত সময়ের মধ্যে রেল ক্রসিং পার হতে পারেনি। গেটম্যান ব্যারিয়ার ফেলে শুক্রবারের নামাজ পড়ার জন্য গেলেও অতীতে কাজে ফাঁকি দেয়ার কোন অভিযোগ ছিল না তার বিরুদ্ধে। 

প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, রেল ক্রসিং পার হওয়ার সময় ভিউ ক্লিয়ারেন্স অনুযায়ী অন্তত ৬০০ থেকে ৮০০ মিটার দূরবর্তী স্থান থেকে একটি ট্রেনকে দেখতে পাওয়ার কথা। রেলওয়ে আইন অনুযায়ী, রেল ক্রসিং পার হওয়ার সময় বিভিন্ন সতর্কতামূলক নির্দেশিকা প্রতিপালন, রেলওয়ের সতর্কতা এলার্ম শুনে পাড়াপাড় কিংবা ট্রেনের হুইসেল শুনে ক্রসিং পার হওয়ার নিয়ম রয়েছে। তাছাড়া একটি মাইক্রোবাসে ১০ থেকে সর্বোচ্চ ১২ ভ্রমণ সম্ভব হলেও ওই মাইক্রোবাসে চালক-হেলপার সহ ১৮ জন যাত্রী ছিল। যার কারণে মাইক্রোবাসের অভ্যন্তরে উচ্চস্বরে গান বাজানো, হইহুল্লোর সহ মোটরযান আইন মেনে না চলায় মর্মান্তিক এই দুর্ঘটনা ঘটেছে। এই ঘটনায় গেটম্যানের চেয়েও মাইক্রোবাস চালকের দায় সবচেয়ে বেশি বলে উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনে।  

জানা গেছে, ট্রেন দুর্ঘটনায় হতাহতরা চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলার আমানবাজারের পূর্ব খন্দকিয়া গ্রামের বাসিন্দা। নিহত ১৩ জনের মধ্যে গাড়িচালক ছাড়া অন্যরা স্থানীয় একটি কোচিং সেন্টারের শিক্ষক ও শিক্ষার্থী। ঘটনার দিন সকালে তাঁরা মাইক্রোবাসে মিরসরাইয়ের খৈয়াছড়া ঝরনা দেখতে যান। দুপুরে সেখান থেকে ফেরার পথে দুর্ঘটনার কবলে পড়েন তাঁরা। দুর্ঘটনার পর গেটম্যান সাদ্দাম হোসেনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। তিনি বর্তমানে কারাগারে আটক রয়েছেন। 

এ ঘটনার তদন্তে চার ও পাঁচ সদস্যের দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে রেলওয়ে। একটি তদন্ত কমিটির প্রধান করা হয়েছে পূর্বাঞ্চলের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মোহাম্মদ আরমান হোসেনকে। অপর কমিটির প্রধান করা হয় রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলের বিভাগীয় পরিবহন কর্মকর্তা (ডিটিও-অতিরিক্ত দায়িত্ব) আনসার আলীকে। বিভাগীয় পরিবহন কর্মকর্তার কমিটি প্রতিবেদন জমা দিলেও আরেকটি কমিটি এখনো প্রতিবেদন জমা দেয়নি। 

রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক (জিএম) মো. জাহাঙ্গীর হোসেন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, মিরসরাইয়ে লেভেল ক্রসিং গেইটে সংঘটিত দুর্ঘটনার বিষয়ে গঠিত বিভাগীয় তদন্ত কমিটি তাদের রিপোর্ট জমা দিয়েছে। প্রতিবেদনে এলসি গেইটগুলোর রক্ষাণাবেক্ষণ ও পরিচালনায় বেশ কিছু সুপারিশ করেছে। দুর্ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় এলসি গেইটের আধুনিকায়ন ও আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াতে রেলওয়ে কাজ করছে। রেলের এ সংক্রান্ত দফতরগুলো এলসি গেইটের সমস্যা ও সংকট দূর করে আধুনিক এলসি গেইট ব্যবস্থাপনার জন্য কাজ করছে বলে জানিয়েছেন তিনি। 

বিডি-প্রতিদিন/সালাহ উদ্দীন

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর