বৃহস্পতিবার, ৬ আগস্ট, ২০২০ ০০:০০ টা

তাজহাট জমিদারবাড়ি ৬ মাস ধরে লকডাউন

নজরুল মৃধা, রংপুর

রংপুর নগরীর অনন্য সৌন্দর্যবর্ধনকারী তাজহাট জমিদারবাড়ি ও জাদুঘরে এবারের ঈদেও দর্শনার্থীদের প্রবেশাধিকার ছিল না। প্রায় ৬ মাস থেকে ভবনটি লকডাউন থাকায় মূল ফটকের বাইরে থেকেই ভবনটি দেখে ভ্রমণ পিপাসুরা তাদের তৃষ্ণা মেটাচ্ছেন। অথচ কয়েক মাস আগেও শত শত দর্শনার্থীর হাঁকডাকে মুখর ছিল এ জমিদার বাড়ির প্রাঙ্গণ।  ১৯৯৫ সালে এ ভবনটিকে প্রত্নতত্ত্ব সম্পদ হিসেবে গণ্য করা হয়। ২০০২ সালে এটিকে জাদুঘরে রূপান্তরিত করা হয়। এর নাম রাখা হয় রংপুর জাদুঘর। বর্তমানে এটি ১৬ দশমিক ৬ একর জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত। এ জাদুঘরে তিন শতাধিক মূল্যবান নিদর্শন রয়েছে। প্রতিদিন দেশি ও বিদেশি পর্যটকরা এ বাড়ির সৌন্দর্য দর্শনে আসতেন। কিন্তু মহামারী করোনা এ রাজবাড়ির প্রাণচাঞ্চল্য স্তব্ধ করে দিয়েছে। সংস্কৃতি ও  প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতর গত ১৯ মার্চ থেকে এ দৃষ্টিনন্দন ভবনটি লকডাউন ঘোষণা করেন। ফলে সব ধরনের দর্শনার্থীর প্রবেশাধিকার এখানে নিষিদ্ধ হয়ে যায়। হাতেগোনা কয়েকজন এখন ভবন ও জাদুঘরের দেখভাল করছেন।   জানা গেছে, তাজহাট জমিদার বাড়ি প্রতিষ্ঠা করেন মান্নালাল রায়। তিনি ভারতের পাঞ্জাব থেকে এসেছিলেন। পেশায় ছিলেন একজন স্বর্ণকার। স্বর্ণখচিত টুপি বা তাজ নির্মাণ করায় এ অঞ্চলের নাম তাজহাট হয়েছে। জাতিতে ক্ষত্রিয় হলেও তার শিখ ধর্মের প্রতি দুর্বলতা ছিল। মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেবের সঙ্গে শিখদের সংঘাতের সময় স্বর্ণ ব্যবসায়ী মান্নালাল পাঞ্জাব থেকে পালিয়ে মাহিগঞ্জে বসতি স্থাপন করেন। তিনি হীরা-মনি-মুক্তাখচিত টুপি (তাজ) বিক্রি করতেন। আর এভাবেই প্রতিষ্ঠিত হয় তার জমিদারি। ১৮৯৭ সালে ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত হলে বাড়িটি পুনর্নিমাণ করা হয়। ৫৬ একর এলাকাজুড়ে পুবমুখী দোতলা এ জমিদার বাড়ির সামনের দিকে প্রায় ৭৭ মিটার দৈর্ঘ্য। এ দালানে ওঠার জন্য শ্বেতপাথরে আবৃত রয়েছে দৃষ্টিনন্দন সিঁড়ি। বাড়ির ছাদের মূল অংশে আটকোনা পিলারের ওপর অবস্থিত রেনেসাঁ গম্বুজ।

এ গম্বুজ আংশিকভাবে সরু পিলারের ওপর ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। প্রাসাদের গৃহমুখের দুই প্রান্তে অষ্টাভুজাকৃতির বাইরে বেরিয়ে যাওয়ার অংশ রয়েছে। প্রাসাদটির গাড়ি বারান্দা প্রায় ১০ মিটিার দীর্ঘ। গাড়ি বারান্দার ওপরে যে ঝুল বারান্দা রয়েছে তার ছাদ চারটি পিলারের ওপর অবস্থিত। এ প্রাসাদের দুই প্রান্তের বারান্দাতেও ত্রিকোনাকৃতির ছাদ রয়েছে। প্রাসাদের ভূমি নকশা অনেকটা ইংরেজি ‘ট’-এর মতো। প্রাসাদে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে চোখ পড়ে ১৪-১৯ মিটার বিশাল হলঘর। হল ঘরের দুই দিকে একটি করে ঘর রয়েছে। প্রাসাদটির ভিতরে তিন মিটার প্রশস্ত একটি টানা বারান্দা রয়েছে। পুরো ভবনে মোট ২২টি কক্ষ। ভবনের সামনে মার্বেল পাথরের সুদৃশ্য একটি ফোয়ারা রয়েছে।

এ জমিদার বংশের মধ্যে জনপ্রিয় জমিদার ছিলেন গিরিধারি লাল রায়। ১৮৭৯ সালে তার মৃত্যু হলে তার ছেলে গোবিন্দ লাল রায় জমিদারি লাভ করেন। গোবিন্দলাল রায় প্রজাহিতৈষী ও দানশীলতার জন্য ১৮৮৮ সালে ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক রাজা, ১৮৯২ সালে রাজা বাহাদুর ও ১৮৯৬ সালে মহারাজা উপাধিতে ভূষিত হন। এ সময়টিই ছিল তাজহাট জমিদারদের সোনালি অধ্যায়। ১৮৯৭ সালে তার মৃত্যু হলে তার ছেলে গোপাল লাল রায় জমিদার নিযুক্ত হন। তিনি ছিলেন এ বংশের শেষ জমিদার। তিনিও ১৯১২ সালে রাজা ও ১৯১৮ সালে রাজাবাহাদুর উপাধিতে ভূষিত হন। ১৯৫০ সালে জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হলে কুমার গোপাল রায়ের বংশধররা ভারতে চলে যান। ১৯৫২ সালে জমিদার বাড়িটি কৃষি বিভাগের অধীনে চলে যায়।  গড়ে ওঠে কৃষি প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট। ১৯৮৪-১৯৯১ পর্যন্ত তাজহাট রাজবাড়ি বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাই কোর্ট বেঞ্চ হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে।

এ জাদুঘরের কাস্টডিয়ান হাসিবুল হাসান সুমি জানান, করোনার কারণে মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে ভবনটি লকডাউন করা হয়েছে। তাই এখানে কোনো দর্শনার্থীকে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর