মঙ্গলবার, ২১ সেপ্টেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

অটোগ্যাসে ঝুঁকছেন গাড়িমালিকরা

দেশব্যাপী কয়েক শ স্টেশন সাশ্রয়ী জ্বালানি, পরিবেশবান্ধব গাড়ির ইঞ্জিনের জন্য কম ক্ষতিকর

জিন্নাতুন নূর

গাড়ির ইঞ্জিনের জন্য কম ক্ষতিকর আবার ব্যবহারেও অন্য জ্বালানির তুলনায় সাশ্রয়ী হওয়ায় দেশে তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাস (এলপিজি) বা অটোগ্যাসের ব্যবহার জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। বাসা-বাড়ি ও রেস্টুরেন্টে ব্যবহার হলেও এই গ্যাস এখন গাড়ির জ্বালানি হিসেবেও ব্যবহৃত হচ্ছে। এমনকি সংকুচিত প্রাকৃতিক গ্যাসের (সিএনজি) জায়গা দ্রুত অটোগ্যাসের দখলে চলে যাচ্ছে। এক লিটার অকটেনের দাম যেখানে ৮৯ টাকা, সেখানে প্রতি লিটার এলপিজির মূল্য ৪২ টাকা, যে কারণে যানবাহনে এলপিজি সিলিন্ডার কনভারসনের হার ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। আর এলপিজি সিলিন্ডার একবার পূর্ণ করলে তা দিয়ে সিএনজির তুলনায় চার বা পাঁচ গুণ বেশি দূরত্ব অতিক্রম করা যায়। সরকারও জীবাশ্ম  জ্বালানির ওপর থেকে ধীরে ধীরে নির্ভরশীলতা তুলে নিতে আগ্রহী। ২০১৯ সালে মানুষজন যখন তাদের পরিবহনের জ্বালানি ব্যবস্থা এলপিজিতে রূপান্তর শুরু করে তখন থেকে অটোগ্যাসের চাহিদা বৃদ্ধি পেতে থাকে। অপারেটরদের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যে, বর্তমানে ৩৫ হাজার যানবাহনে অটোগ্যাস ব্যবহার করা হচ্ছে। আর প্রতি মাসে ব্যবহৃত হচ্ছে ছয় হাজার থেকে সাড়ে ছয় হাজার টন অটোগ্যাস। তবে চলতি বছরের শুরুতে লকডাউনের কারণে অটোগ্যাস বিক্রির হার কিছুটা কমে গিয়েছিল বলে অটোগ্যাস ব্যবসায়ীরা জানান। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, অটোগ্যাসের সুবিধার জন্য সিএনজিচালিত যানবাহনগুলোও এলপিজিতে কনভারসন (রূপান্তর) করা হচ্ছে। বিদ্যমান পেট্রোল পাম্পে অটোগ্যাস ফিলিং সুবিধাও সৃষ্টি করা হচ্ছে। আবার অকটেনের তুলনায় সাশ্রয়ী হওয়ায় গাড়ির মালিকদের ঝোঁক এখন অটোগ্যাসে। যানবাহনে এলপিজির ব্যবহার বৃদ্ধি পাওয়ায় অটোগ্যাস ফিলিং স্টেশন এবং এর ব্যবহারকারীর সংখ্যাও ক্রমে বৃদ্ধি পাচ্ছে। জ্বালানি মন্ত্রণালয়ও এর মধ্যে দেশব্যাপী ১৩টি এলপিজি অপারেটরকে ২ হাজার ৫৫০টি অটোগ্যাস স্টেশন স্থাপনের অনুমতি দিয়েছে। আবার বেশ কিছু স্টেশনের সঙ্গে কনভারসন সেন্টারও থাকবে। সেখানে জীবাশ্মচালিত যানবাহনকে অটোগ্যাসে চলার উপযোগী যানবাহনে রূপান্তর করা হবে। এরই মধ্যে এসব অপারেটর ৪০০টি অটোগ্যাস স্টেশন স্থাপন করেছে। আর সেখানে দৈনিক ২০০ থেকে ৩০০ গাড়িকে অটোগ্যাসে চলার উপযোগী করা হচ্ছে। এ জন্য বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) তিনটি প্রতিষ্ঠান- পদ্মা অয়েল কোম্পানি, মেঘনা পেট্রোলিয়াম ও যমুনা অয়েল কোম্পানির সঙ্গে অপারেটরগুলো চুক্তি সই করেছে। এখন অপারেটররা এসব প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধনকৃত রিফুয়েলিং স্টেশনগুলোর সঙ্গে চুক্তি করে অটোগ্যাস স্টেশন বসিয়ে সেখানে এলপিজি সরবরাহ করছে। রাষ্ট্রায়ত্ত তিনটি কোম্পানির সঙ্গে প্রায় ২ হাজার ১০০ নিবন্ধককৃত স্টেশন রয়েছে। এসব স্টেশনে অটোগ্যাস পাম্প বসাতে একজন এলপিজি অপারেটরকে প্রতি লিটার এলপিজির জন্য বিপিসি ও তেল প্রতিষ্ঠানগুলোর এক টাকা করে রয়্যালটি দেওয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। যেহেতু দেশের সিএনজি গ্রিড লাইনগুলো যানবাহনে মোট চাহিদার ৩৫ শতাংশ পূরণ করতে পারছে, এ জন্য দেশের দক্ষিণ ও উত্তরাঞ্চলে এরই মধ্যে অনেক অপারেটর অটোগ্যাস স্টেশন স্থাপন করছেন।

সংশ্লিষ্টরা জানান, সিএনজি ফিলিং স্টেশনের অনুমোদন বন্ধসহ গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধি করে ব্যবসায়ীদের চাপে রাখা হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে দেশব্যাপী যানবাহনে এলপিজির চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ঘনীভূত প্রাকৃতিক গ্যাস বা সিএনজির বদলে এলপিজি চালু হলে দেশীয় গ্যাসের ওপর চাপ কমবে। এ ছাড়া পেট্রোল, অকটেন ও ডিজেলের তুলনায় এলপিজির খরচ তুলনামূলক কম। এটি পরিবেশবান্ধব জ্বালানি এবং দেশের যে কোনো প্রান্তে সহজেই পরিবহনযোগ্য হওয়ায় এর চাহিদা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। রাজধানীর মিরপুর কালশী এলাকার সুমাত্রা ফিলিং স্টেশনে সম্প্রতি গিয়ে দেখা যায়, এলপিজি নেওয়ার জন্য প্রাইভেট কারের দীর্ঘ লাইন। লাইনে দাঁড়ানো চালক আবদুস সালাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ৬০ লিটার এলপিজিতে ৩০০ কিলোমিটার পর্যন্ত চলা যায়।

আর একই সিলিন্ডার সিএনজিতে চলে মাত্র ৮০ কিমি। এ জন্য সিএনজি বাদ দিয়ে এখন এলপিজি ব্যবহার করছি। আবার এলপিজি প্রতিদিন নেওয়ার প্রয়োজনও পড়ে না।

চট্টগ্রামের বিএম অ্যানার্জি এরই মধ্যে ১৫০টি অটোগ্যাস স্টেশন স্থাপন করেছে। এর মধ্যে ৪০টি অটোগ্যাস স্টেশন প্রতিষ্ঠান নিজস্ব অর্থায়নে ৫৫ থেকে ৬০ কোটি টাকা ব্যয়ে এগুলো তৈরি করেছে। ২০১৮ সালে বাঁশখালীতে প্রতিষ্ঠানটি দুটি অটোগ্যাস স্টেশন দিয়ে যাত্রা শুরু করে। কিন্তু অটোগ্যাস সম্পর্কে সে সময় মানুষের ধারণা কম থাকায় এর বিক্রি কম ছিল। জ্বালানি মন্ত্রণালয় থেকে বিএম অ্যানার্জি মোট ৪৫০টি অটোগ্যাস স্টেশন এবং ৫০টি কনভারসন সেন্টার স্থাপনের অনুমতি পেয়েছে। এর বাইরে এক বছরের মধ্যে আরও ৫০টি অটোগ্যাস স্টেশন স্থাপন করতে যাচ্ছে বিএম অ্যানার্জি।

এ ছাড়া ওমেরা গ্যাস ওয়ান কর্তৃপক্ষ এরই মধ্যে ৩২টি অটোগ্যাস স্টেশন স্থাপন করেছে। ২০২০ সালে যেখানে ওমেরা প্রতি মাসে ৭০০ টন অটোগ্যাস বিক্রি করত, এখন তা দাঁড়িয়েছে ১ হাজার টনে।

পেট্রোম্যাক্স এলপিজি ১০০টি অটোগ্যাস স্টেশন স্থাপনের অনুমতি পেলেও এর মধ্যে ৪০টি স্থাপন করেছে। ২০১৯ সালে যেখানে প্রতিষ্ঠানটি ১০০ থেকে ১৫০ টন অটোগ্যাস বিক্রি করত, সেখানে ২০২০ সালে তাদের বিক্রি দাঁড়ায় ২৫০ টনে। বর্তমানে পেট্রোম্যাক্সের বিক্রির পরিমাণ প্রতি মাসে ৫০০ টন।

এ ছাড়া জি-গ্যাস এলপিজি এরই মধ্যে ৪২টি অটোগ্যাস কোম্পানি স্থাপন করেছে। ২০১৯ সালে যেখানে প্রতিমাসে প্রতিষ্ঠানটি ১০০ টন অটোগ্যাস বিক্রি করত, বর্তমানে তারা ৬৫০ টন অটোগ্যাস বিক্রি করছে। এ ছাড়া এলপিজির বাজার বৃদ্ধি করতে পদ্মা অয়েল কোম্পানি লিমিটেডের সঙ্গে কাজ করবে বসুন্ধরা এলপি গ্যাস লিমিটেড।

এলপিজি অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (লোয়াব) প্রেসিডেন্ট আজম জে চৌধুরী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমাদের প্রাকৃতিক গ্যাসের ওপর এমনিতেই অনেক চাপ। এর মধ্যে সরকারি বিধিনিষেধ অনুযায়ী সিএনজি স্টেশনগুলোও এখন বেশ কয়েক ঘণ্টা বন্ধ থাকবে। অনেক গ্যাসস্টেশনে আবার চাপও খুব কম। প্রাকৃতিক গ্যাসের বিকল্প হিসেবে অটোগ্যাসের ভালো সম্ভাবনা আছে। আবার অটোগ্যাসের বেশ কিছু চ্যালেঞ্জও আছে। এ জন্য সরকারকে নির্দিষ্ট নীতিমালা তৈরি করতে হবে। নীতিমালা ঠিকভাবে তৈরি করলে যানবাহনে সিএনজি গ্যাস যেভাবে বৃদ্ধি পেয়েছিল একইভাবে অটোগ্যাসের ব্যবহারও বৃদ্ধি পাবে। এ ছাড়া অটোগ্যাসের খরচ অকটেনের চেয়ে কম। আর এ গ্যাস গাড়ির ইঞ্জিনের জন্যও কম ক্ষতিকর এবং পরিবেশবান্ধব।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর