বৃহস্পতিবার, ১৪ এপ্রিল, ২০২২ ০০:০০ টা

পরিচয় মেলে না বেওয়ারিশ লাশের

অজ্ঞাত লাশের ৭৭ দশমিক ৭৯ শতাংশের পরিচয় মেলেনি আজও

মাহবুব মমতাজী

পরিচয় মেলে না বেওয়ারিশ লাশের

২০১৯ সালের ২৭ নভেম্বর। গাজীপুরের জয়দেবপুর থেকে অজ্ঞাত এক ব্যক্তির লাশ উদ্ধার করেছে ঢাকা রেলওয়ে থানা পুলিশ। গাজীপুরের পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) টিম লাশের ফিঙ্গার প্রিন্ট নিয়েও তা শনাক্ত করতে পারেনি। এ ঘটনায় জয়দেবপুর থানায় একটি অপমৃত্যুর মামলাও হয়েছে। মামলা নম্বর ২৪৫। একই বছর ১৯ নভেম্বর রাজধানীর আগারগাঁওয়ে গলা কাটা অজ্ঞাত এক ব্যক্তির লাশ উদ্ধার করেন শেরেবাংলানগর থানার এসআই জনি। ১৭২৮ নম্বর সাধারণ ডায়েরিতে (জিডি) শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ মর্গে তাৎক্ষণিকভাবে লাশের ময়নাতদন্ত করা হয়। পরে সেটি হত্যা মামলায় রূপান্তরিত হয়। ঘটনা দুটির আড়াই বছর পরও তাদের পরিচয় জানা যায়নি। পরে এসব অজ্ঞাত লাশ বেওয়ারিশ হিসেবে দাতব্য সংস্থা আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের মাধ্যমে দাফন করা হয়েছে। অজ্ঞাত লাশের ৭৭ দশমিক ৭৯ শতাংশের পরিচয় মেলেনি এখন পর্যন্ত। আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম বলছে, ২০১৪ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২০১৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর। এই পাঁচ বছরে ৬ হাজার ২১৩ জনকে বেওয়ারিশ লাশ হিসেবে দাফন করেছে তারা। অর্থাৎ প্রতি বছরে ১ হাজার জনের বেশি মানুষ বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করা হয়েছে। আর ২০১৯ থেকে ২০২১ পর্যন্ত দাফন করেছে ১ হাজার ৪৫৩টি লাশ। এর বাইরে ২০২০ সালের নভেম্বরে ২২টি অজ্ঞাত হাত-পা দাফন করেছে তারা। একজন ব্যক্তি মারা যাওয়ার পর তার সুরতহাল, ময়নাতদন্ত, জিডি, মামলা সবকিছু হয় সংশ্লিষ্ট থানাতে। এর একটা কপি দেওয়া হয় আঞ্জুমান মুফিদুলে। এ ছাড়া দেশের সব থানাতে এ বিবরণ বা প্রতিবেদন পাঠিয়ে দেওয়া হয়। তাহলে কেন একটা ব্যক্তির পরিচয় পাওয়া যায় না? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে কথা হয় বিভিন্ন থানা ও পুলিশের তদন্ত সংস্থার নানা পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে। তারা জানান, বিভিন্ন থানায় প্রায় সময় নিখোঁজের জিডি হয়। হয়তো কখনো পাওয়া যায়, আবার কখনো পাওয়া যায় না। আবার অন্য এলাকায় অজ্ঞাত লাশ পাওয়া যায়। তার ফিঙ্গার প্রিন্ট নিয়েও পরিচয় জানা যায় না। এর পরও নিখোঁজের তথ্য এবং অজ্ঞাত লাশের তথ্য নিয়ে যাচাই করার কোনো ব্যবস্থা নেই। তবে এটি করার জন্য পুলিশ সদর দফতর একটি সফটওয়্যার তৈরি করছে বলে জানানো হয়। আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের কর্মকর্তা আবদুল আউয়াল জানান, এখন পর্যন্ত অজ্ঞাত যেসব লাশ দাফন হয়েছে, পরে তাদের ওয়ারিশ পাওয়া গেছে এমন ঘটনা ঘটেনি। অর্থাৎ দাফনের পরও কারও পরিচয় আর বের করা যায়নি।  তবে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০১৮ সালের ১ নভেম্বর একটি ব্যতিক্রম ঘটনা ঘটেছে। ঢাকা কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে একটি অজ্ঞাত লাশ উদ্ধার করা হয়। পরে পুলিশ প্রাথমিক সুরতহাল করে আঞ্জুমান মুফিদুলের কাছে দিয়ে দেয় বেওয়ারিশ হিসেবে দাফনের জন্য। ঘটনা এখানেই শেষ হয়ে যেতে পারত হাজারখানেক বেওয়ারিশ লাশের মতোই। কিন্তু ঘটনার মোড় নেয় যখন আঞ্জুমান মুফিদুলের কর্মীরা তাকে দাফনের আগে গোসলের জন্য নেন। মৃত ব্যক্তির কোমরে কিছু কাগজ খুঁজে পান তারা। তার কোমরে আইডি কার্ড আর ব্যাংকের ক্রেডিট কার্ড পাওয়া যায়। আইডি কার্ড দিয়ে শনাক্ত করা যায়নি। এরপর পুলিশকে জানালে তারা ব্যাংকের ক্রেডিট কার্ড দিয়ে তার পরিচয় বের করে। এদিকে ২০১৯ সালের ২ আগস্ট ফাস্ট পার্সেল অ্যান্ড কুরিয়ার সার্ভিসের পার্সেল সহকারী এনামুল হক নিখোঁজ হন। নিখোঁজ এনামুল খুলনার চালনা উপজেলার রেজাউল করিম খানের ছেলে। ওই দিন সন্ধ্যার পরও বাসায় না ফেরায় সম্ভাব্য সব স্থানে খোঁজ করেও তাকে পাওয়া যায়নি। এ বিষয়ে নিখোঁজের পরিবার শাহবাগ থানায় একটি জিডি করে। জিডি নম্বর ৩৪০। তবে এনামুলকে এখনো পাওয়া যায়নি বলে শাহবাগ থানায় খোঁজ নিয়ে জানা যায়।  পিবিআইর সাইবার ক্রাইম অ্যান্ড ডিজিটাল ফরেনসিক ল্যাবের তথ্য অনুযায়ী, গত তিন বছরে উদ্ধার হওয়া অজ্ঞাত লাশের ৭৭ দশমিক ৭৯ শতাংশের পরিচয় শনাক্ত করা যায়নি।

আর যাদের পরিচয় শনাক্ত করা গেছে তাদের ২০ ভাগ হত্যার শিকার।

সংস্থাটি বলছে, উদ্ধার হওয়া লাশের বেশিরভাগই সড়ক ও রেল দুর্ঘটনায় মারা যাওয়া ভবঘুরে কিংবা ছিন্নমূল মানুষ। অজ্ঞাত লাশ উদ্ধারের পর সেগুলো শনাক্তের জন্য পিবিআই ফিঙ্গার প্রিন্ট আইডেন্টিফিকেশন অ্যান্ড ভেরিফিকেশন সিস্টেম (এফআইভিইএস) ব্যবহার করে থাকে। অজ্ঞাত লাশের বেশিরভাগের পরিচয় শনাক্ত না হওয়ার কারণ হিসেবে পিবিআই কর্মকর্তারা বলছেন, অজ্ঞাতপরিচয়ের লাশের একটি বড় অংশের জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) থাকে না। এ ছাড়া ইটভাটা, হোটেলে পানির কাজসহ বিভিন্ন কাজ করতে গিয়ে অনেকের হাতের ফিঙ্গার (আঙুল) ক্ষয় হয় এবং পচে যাওয়া অনেক লাশের আঙুল বিকৃত হয়ে যায়। ফলে নির্বাচন কমিশন তথ্যভান্ডারে থাকা তাদের এনআইডির ফিঙ্গার প্রিন্টের সঙ্গে পরবর্তীকালে আর মেলে না।

পিবিআইর সাইবার ক্রাইম অ্যান্ড ডিজিটাল ফরেনসিক ল্যাব সূত্রে জানা যায়, ২০১৯ সালের মার্চ থেকে চলতি বছর ১৩ এপ্রিল পর্যন্ত সারা দেশে ২ হাজার ৮১৯টি অজ্ঞাত লাশের পরিচয় শনাক্তে কাজ করেছে পিবিআই। এর মধ্যে পরিচয় শনাক্ত হয়ে ৬২৬টি লাশের, যাদের মধ্যে পুরুষ ৪৫৯ ও নারী ১৬৭ জন। শনাক্তের হার ২২ দশমিক ২১ শতাংশ।

সাইবার ক্রাইম অ্যান্ড ডিজিটাল ফরেনসিক ল্যাবে কর্মর সার্জেন্ট নাভিদ ইমতিয়াজ জানান, লাশ শনাক্ত করার পদ্ধতি নিয়ে পিবিআই কাজ শুরু করে ২০১৬ সালে। ২০১৮ সালে এসে তারা পুরো ব্যবস্থাটি দাঁড় করায়। ২০১৯ সালের মার্চ থেকে কাজ শুরু করে। যাদের এনআইডি নেই এবং যাদের বয়স ১৮ বছরের কম এই প্রযুক্তিতে তাদের পরিচয় শনাক্ত করা কঠিন। পিবিআইর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ফরেনসিক) মোস্তফা কামাল রাশেদ জানিয়েছেন, এখন পর্যন্ত অসংখ্য ক্লুলেস হত্যাকান্ডে র রহস্য উদঘাটন করা হয়েছে এ প্রক্রিয়ায়।

আরও জানা যায়, ২০১৯ সালের ১০ নভেম্বর কিশোরগঞ্জের ভৈরব থেকে অজ্ঞাত একটি লাশ উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় ভৈরব হাইওয়ে থানায় একটি জিডি হয়। জিডি নম্বর ২১৬। পুলিশ জানায়, ওই ব্যক্তি সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান। এখন পর্যন্ত তার পরিচয় জানা যায়নি। টাঙ্গাইলের কালিহাতি উপজেলায় গত বছর ২৭ মার্চ অজ্ঞাত একটি লাশ উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় কালিহাতি থানায় একটি জিডি করা হয়। জিডি নম্বর ৯০৬। একই বছরে ২৮ মার্চ গাজীপুর রেলওয়ে থানা পুলিশ রেল দুর্ঘটনায় মারা যাওয়া অজ্ঞাত এক ব্যক্তির লাশ উদ্ধার করে। এ ঘটনায় রেলওয়ে থানায় একটি অপমৃত্যু মামলা হয়। মামলা নম্বর ১৪।

সর্বশেষ খবর