বদলে যাচ্ছে ট্যানারির বর্জ্যে দূষিত, দুর্গন্ধ এলাকা হিসেবে পরিচিত হাজারীবাগ। ভূমির পুনরুন্নয়নের (রিজেনারেশন) মাধ্যমে আধুনিক আবাসিক এলাকা হিসেবে গড়ে তোলা হবে। সেখানে মাঠ, উন্মুক্ত স্থান, হাসপাতাল, বাণিজ্যিক সুবিধাসহ মডেল আবাসিক জোন তৈরি করা হচ্ছে। সে লক্ষ্যে প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। হাজারীবাগ ট্যানারির পরিত্যক্ত এলাকাসহ ১০০ একর জমি অধিগ্রহণ করে পুনরুন্নয়নের পরিকল্পনা করেছে সংস্থাটি। এরই মধ্যে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় ট্যানারি এলাকা পুনরুন্নয়নের নিমিত্ত নতুন প্রকল্পের অনুমোদন দিয়েছে।
ডিটেইল এরিয়া প্ল্যান (ড্যাপ ২০১০-১৫) অনুযায়ী হাজারীবাগ এলাকাকে উন্মুক্ত স্থান হিসেবে সংরক্ষণের নির্দেশ দেওয়া ছিল। যেহেতু হাজারীবাগ ট্যানারি এলাকার মাটি ৮-২০ ফুট গভীর পর্যন্ত দূষিত, তাই সামগ্রিক পরিকল্পনা দরকার। সুপারিশ অনুযায়ী ট্যানারি এলাকার ৮ ফুট মাটি অপসারণ করে সেখানে পরিকল্পিত বাণিজ্যিক এলাকা, স্কুল, ক্লিনিক, পার্ক ও উন্মুক্ত স্থান তৈরি করা যেতে পারে। একই সঙ্গে ২০২২-৩৫ ড্যাপে হাজারীবাগ পুরনো ট্যানারি এলাকাকে রিজেনারেশন সাইট হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। একই সঙ্গে হাজারীবাগ এলাকাকে মিশ্র ব্যবহার হিসেবে সুপারিশ করা হয়েছে। রাজউক সূত্রমতে, পৃথিবীর অনেক দেশে আরবান রিজেনারেশনের (নগর পুনরুন্নয়ন) মাধ্যমে পুরনো জরাজীর্ণ শহরগুলোকে আধুনিকতায় উন্নীত করা হয়েছে। সে হিসেবে হাজারীবাগ পুনরুন্নয়ন করা যেতে পারে। তবে হাজারীবাগ পুরনো ট্যানারি এলাকায় ব্যক্তিপর্যায়ে প্লটের মাধ্যমে ইমারত নির্মাণ করা হলে এলাকার দূষণ রোধ করা সম্ভব না-ও হতে পারে। কারণ ব্যক্তিপর্যায়ে করলে দূষিত মাটি অপসারণ না-ও করতে পারেন মালিকরা। আর যেহেতু ট্যানারি এলাকাটি ধানমন্ডি আবাসিক এলাকার খুবই সন্নিকটে এবং শহরের সব অংশের সঙ্গে যোগাযোগের ভালো ব্যবস্থা রয়েছে, তাই এ এলাকাটিকে পর্যাপ্ত নাগরিক সুবিধাদির সংস্থান করে সুপরিকল্পিত মিশ্র ব্যবহারসংবলিত এলাকা হিসেবে পুনরুন্নয়ন করা যেতে পারে। হাজারীবাগ ট্যানারি শিল্পাঞ্চল এলাকায় যাদের প্লট আছে রাজউক তাদের কাছ থেকে সরকারি আইন মেনে ভূমি অধিগ্রহণ করে সেই ভূমিতে পরিকল্পিত প্লট করে বিক্রি করতে চায়। সরকারি আইন অনুযায়ী, ভূমি অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে ভূমিমালিকরা মৌজা মূল্যের ৩ গুণ দাম পাবেন। বিচ্ছিন্নভাবে এ এলাকায় ভবন তৈরি না করে এখানকার ট্যানারির টক্সিক মাটি পরিশোধন করে পরিকল্পিত এলাকা গড়ে তোলা হবে। এরই মধ্যে ২৭ আগস্ট গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় ‘ঢাকা আরবান রিজেনারেশন প্রকল্প’ শীর্ষক হাজারীবাগ এলাকাটিকে পুনরুন্নয়ন করতে অনুশাসন জারি করেছে। একই সঙ্গে ট্যানারি এলাকাটি পুনরুন্নয়নের নিমিত্ত নতুন প্রকল্প নিতে বলা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) নগর পরিকল্পনাবিদ মো. আশরাফুল ইসলাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, পুরনো ট্যানারি এলাকাটিতে এখন কেমিক্যাল গোডাউন রয়েছে। একই সঙ্গে জুতা তৈরির কারখানাও রয়েছে, যা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। আরবান রিজেনারেশন প্রকল্প হিসেবে ট্যানারি এলাকাটির উন্নয়নের পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে রাজউক। এখানে আবাসিক ভবন, বিশ্ববিদ্যালয়, স্কুল-কলেজ, শপিং মল, একটি হাসপাতালসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা দিয়ে এটি তৈরি করা হবে। সব ধরনের নাগরিক সুবিধা দিয়ে এটি একটি কমিউনিটি এলাকা হবে। এরই মধ্যে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় এর অনুমোদন দিয়েছে। একই সঙ্গে প্রকল্প নিতেও বলা হয়েছে।
তিনি বলেন, পুরনো ট্যানারি এলাকাটি ৬১ একর। এর সঙ্গে আরও ৩৯ একর যোগ করে পুরো ১০০ একর জমি হবে। রাজউক এই ১০০ একর জায়গা অধিগ্রহণ করবে। যেহেতু ধানমন্ডি আবাসিক এলাকার পাশে হবে এই আবাসিক জোন, তাই জিগাতলা থেকে বেড়িবাঁধের সঙ্গে সংযুক্ত রাস্তা তৈরি করা হবে।
উল্লেখ্য, রাজউকের ঢাকা আরবান রিজেনারেশন নামে এ প্রকল্পের উদ্দেশ্য রাজধানীর হাজারীবাগ, বংশাল, চকবাজার, ইসলামবাগ, মৌলভীবাজার, লালবাগ, কামরাঙ্গীর চরকে নতুনভাবে সাজিয়ে তোলা। এতে প্রাধান্য পাবে নাগরিক সুবিধা। সেখানকার বাসিন্দারা যেন সব ধরনের নাগরিক সুযোগসুবিধা পান, তা নিশ্চিতে কাজ করছে রাজউক।
হাজারীবাগের ইতিহাস : ১৯৫০ সালে সর্বপ্রথম পাকিস্তানিরা পুরান ঢাকার হাজারীবাগে ট্যানারিশিল্প গড়ে তোলে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের পর বাঙালিরা একের পর এক ছোট-বড়-মাঝারি মিলিয়ে এখানে প্রায় ২০০ ট্যানারি গড়ে তোলে। ট্যানারির কারণে তখন প্রচুর পরিমাণে বিদ্যুৎ, পানি ও গ্যাসের প্রয়োজন হতো। তাতে ওই এলাকার আশপাশে এসব সেবায় বিঘ্ন ঘটত। এ ছাড়া দূষণের মাত্রা এতটাই বেড়ে যায় যে, হাজারীবাগ ও আশপাশে কেউ থাকতে চাইত না। ফলে বাড়ির মালিকরাও বিরাট ক্ষতির সম্মুখীন হতো। তাই ১৯৮০ সালে সর্বপ্রথম হাজারীবাগের স্থানীয় লোকজন ট্যানারি স্থানান্তরের আওয়াজ তোলে।
বিভিন্ন পক্ষের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার হাজারীবাগের ট্যানারিগুলো সাভারের হেমায়েতপুরে স্থানান্তর করে। ২০১৭ সালের এপ্রিলে হাজারীবাগের ট্যানারির প্লটে বিদ্যুৎ, গ্যাসসহ সব সেবা সংস্থার লাইন বিচ্ছিন্ন করার মাধ্যমে ট্যানারি মালিকদের সাভারে স্থানান্তরে বাধ্য করা হয়। তখন থেকে ট্যানারি হাজারীবাগ থেকে চলে গেলেও এর দূষণের ক্ষত এখনো বয়ে বেড়াচ্ছে বাসিন্দারা। তাই হাজারীবাগের বাসিন্দাদের নাগরিক সুবিধা নিশ্চিত করতে সরকার উদ্যোগী হয়ে উন্নয়নে নজর দিয়েছে।