বগুড়া শহরের বুক চিরে প্রবাহিত হওয়া করতোয়া নদীর দুপাড় অবৈধভাবে দখল করে গড়ে উঠেছে ছোট-বড় বিভিন্ন ভবন ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। নদীর জায়গা দখল করে অবৈধভাবে ভবন ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান নির্মাণের পর ভাড়া দিয়ে আয় করা হচ্ছে লাখ লাখ টাকা। এর সঙ্গে দুপাড়ে প্রতিনিয়ত বিভিন্ন স্থানে দখল করে স্থাপনা নির্মাণ, ড্রেনের আবর্জনা ফেলায় তলদেশ ভরাট হয়ে মরে যাচ্ছে নদীটি। দিনের পর দিন সরু হয়ে এক সময়ের যৌবনভরা নদীটিতে পানিপ্রবাহ না থাকায় শহরের বড় নালায় পরিণত হয়ে হারিয়ে যাচ্ছে করতোয়া।
জানা যায়, নদীর সবচেয়ে খারাপ অবস্থা বগুড়া অংশে। এখানকার প্রভাবশালীরা জোর করে নদীর পাড় দখল করে গড়ে তুলছেন বহুতল ভবন। নির্মাণ করছেন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানসহ টিনশেড বাড়ি। এসব প্রতিষ্ঠান ভাড়া দিয়ে প্রতি মাসে তারা লাখ লাখ টাকা পকেটে তুলছেন। কোথাও কোথাও আবার নদীর মধ্যেই সীমানাপ্রাচীর দিয়ে দখল করে ভবন তৈরি করছেন স্থানীয় প্রভাবশালীরা। প্রশাসন থেকে উচ্ছেদ অভিযান চালালেও কোনো কাজ হচ্ছে না। করতোয়া নদী বগুড়া শহরের বুক চিরে প্রবাহিত হয়ে শেরপুর উপজেলার চান্দাইকোনায় বাঙালি নদীতে গিয়ে মিলেছে। উৎপত্তিস্থল থেকে এর দৈর্ঘ্য প্রায় ১৮০ কিলোমিটার। এর মধ্যে অধিকাংশ স্থানে নদী দূষণ, দখল, ভরাট, চাষের আওতায় নেওয়া, বাঁধ দিয়ে মাছ চাষ, পানিপ্রবাহ না থাকায় এখন মৃতপ্রায় নদীতে পরিণত হয়েছে। গোবিন্দগঞ্জ থেকে বগুড়ার দিকে নদীর প্রবাহ পুরোপুরি বন্ধ হয়ে সরু খালে পরিণত হয়েছে। করতোয়া নদীতে দু-একটি স্থানে পানি দেখা গেলেও শহর ও শহরতলির প্রায় ২৭ কিলোমিটারে শুধু ড্রেনের কালো পানি বয়ে যায়। শহর এলাকার মধ্যে চেলোপাড়া, উত্তর চেলোপাড়া, মালতীনগর, ফুলবাড়ী, মাটিডালি, রাজাবাজার, ফতেহ আলী সেতু, মহাস্থানগড় এলাকায় দখলের হার সবেচেয়ে বেশি। করতোয়া নদীর তীরবর্তী ২৮টিরও বেশি স্পট দখল করে বহুতল ভবন নির্মাণ চললেও দখলবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয় না বলে স্থানীয়দের অভিযোগ। ময়লা ও কল-কারখানার বর্জ্য ফেলায় পানি দূষিত হওয়ায় নদীতে এখন আর মাছও পাওয়া যায় না।
শহরের মালতিনগর এলাকার নদীপাড়ের বাসিন্দা আবু সাঈদ জানান, প্রশাসন থেকে উচ্ছেদ অভিযান চালালেও আবারও অনেকেই সে স্থানে অস্থায়ীভাবে ঘর তুলেছেন। অনেকে ঘর নির্মাণ করে ব্যবসার জন্য ভাড়া দিয়েছেন। বগুড়ার প্রবীণ ব্যক্তিরা জানান, করতোয়া নদীতে সত্তর দশকে প্রচুর পানি থাকায় প্রমত্তা ছিল। জনশ্রুতি আছে, করতোয়া নদীতে সওদাগরি জাহাজ, লঞ্চ এবং বড় বড় নৌকা, বজরা যাতায়াত করত। পুন্ড্রবর্ধন নগরী বগুড়া এবং করতোয়া নদীকে কেন্দ্র করে এ অঞ্চলে সভ্যতা গড়ে উঠেছিল। জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, দুপাড়ে অবৈধভাবে উচ্চ ভবন, বাড়িঘর, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানসহ ড্রেন নির্মাণ করা হয়েছে। অনেকে সেগুলো ভাড়াও দিয়েছেন। অনেকবার নদী দখলের সঙ্গে জড়িতদের নামের তালিকা তৈরি করে কিছু দখল থেকে মুক্ত করা হয়েছে। বাকিগুলোর মামলা চলছে। বগুড়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. নাজমুল হক জানান, নদী রক্ষায় বেশকিছু কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়েছে। বর্তমানে এ প্রকল্পের আওতায় রয়েছে করতোয়া নদীর পরিবেশ দূষণ বন্ধ, শহরের যানজট নিরসনে সড়ক নির্মাণ। নদী দখলমুক্তকরণ। জেলা প্রশাসক মো. সাইফুল ইসলাম জানান, দখল-দূষণে নদীর প্রাণবৈচিত্র্য প্রায় নিঃশেষ। সভ্যতার বিবর্তনে করতোয়া এখন ধুঁকছে। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে নদীর দুপাড়ে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে অনেকবার অভিযান চালানো হয়েছে। ইতোমধ্যে অবৈধ দখলদারদের তালিকা তৈরি করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। স্মার্ট বগুড়া গড়ার অংশ হিসেবেই স্মার্ট করতোয়া রিভার ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম প্রকল্প বাস্তবায়ন দরকার। এ প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে করতোয়া তার যেমন হারানো যৌবন ফিরে পাবে, তেমনি স্মার্ট বগুড়া গড়াও সহজ হবে।