আধুনিক প্রযুক্তি না থাকায় অগ্নিকান্ডের ভয়াবহতা না বুঝেই উদ্ধার অভিযান চালাচ্ছে ফায়ার সার্ভিস। ঘটনাস্থলের ব্যাপারে নির্ভরযোগ্য তথ্য না জেনেই নেমে পড়ছে অভিযানে। যাতে রক্ষা করা যাচ্ছে না সম্পদ। কখনো কখনো হতাহতও হচ্ছেন ফায়ার ফাইটাররা। সম্প্রতি টঙ্গী ও রূপনগরে কেমিক্যাল গুদাম এবং শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আমদানি কার্গো কমপ্লেক্সে আগুনের ঘটনায় সামনে এসেছে ফায়ার সার্ভিসের নানান সংকটের তথ্য। অবশ্য এ ব্যাপারে প্রকাশ্যে মুখ খুলতে চান না ফায়ার সার্ভিসসংশ্লিষ্টরা। তবে ফায়ার সার্ভিস সদর দপ্তর জানিয়েছে, প্রযুক্তি সংযুক্তির মাধ্যমে কেমিক্যালের আগুন নেভানোয় সক্ষমতা বাড়ানোসহ অন্যান্য সংকট কাটাতে বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছেন, সাধারণ আগুনের ব্যাপারে ফায়ার সার্ভিস দ্রুত ব্যবস্থা নিতে পারে। তবে আগুন যদি হয় কেমিক্যাল গুদাম কিংবা রাসায়নিক থাকা কোনো স্থলে, সে ক্ষেত্রে এর ভয়াবহতা বোঝার প্রযুক্তি কেমিক্যাল ডিটেক্টর নেই ফায়ার সার্ভিসের। এ ক্ষেত্রে মালিকপক্ষ তথ্য গোপন করলে অনেকটা আগুনে ঝাঁপ দিয়ে প্রাণ দিতে হচ্ছে ফায়ার ফাইটারদের। সূত্র জানান, বড় কোনো অগ্নিকা ঘটলেই ফায়ার সার্ভিসের নির্বাপণ কৌশল নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। দেশের জন্য প্রাণ বাজি রাখার পরেও এসব অভিযোগ অনেকটাই মনোবলে প্রভাব ফেলে বাহিনীর সদস্যদের। তার ওপর জনবল ও সরঞ্জামসংকট, প্রশিক্ষণের ঘাটতি, গ্রেডবৈষম্যের কারণে সুপারিশের পরেও নতুন অফিসারদের যোগদানে অনীহার মতো সংকটগুলো দিনদিন প্রকট আকার ধারণ করছে বাহিনীটিতে। যার প্রভাব পড়ছে অপারেশনের কাজে। এ ছাড়া ২৪ ঘণ্টা ডিউটি করলেও ওভারটাইম না পাওয়া, ঝুঁকিভাতা না থাকার মতো বিষয়গুলোতে মনঃক্ষুণ্ন থাকেন ফায়ার ফাইটাররা।
প্রযুক্তির সংকটে জীবন ঝুঁকিতে : ফায়ার সার্ভিস সূত্র জানান, দেশে যে হারে কেমিক্যাল বাড়ছে সে হারে বাড়ানো হচ্ছে না ফায়ার সার্ভিসের সক্ষমতা। যেমন কেমিক্যাল ডিটেক্টরের মতো অতি জরুরি যন্ত্র এখনো সংযুক্ত করা হয়নি বাহিনীতে। ফলে অগ্নিকা স্থলে কেমিক্যালের ধরন, ঘনত্ব ও প্রভাব মাপতে পারছেন না ফায়ার কর্মীরা। এতে নির্বাপণ চেষ্টার সময় বিস্ফোরণ ঘটলে প্রাণ দিতে হচ্ছে তাঁদের। আবার টকসিক গ্যাস সৃষ্টি হলে ফায়ার ফাইটারদের পাশাপাশি জনসাধরণেরও জীবন হুমকিতে পড়ছে। যার বড় প্রমাণ টঙ্গীতে ফেমাস কেমিক্যালস লিমিটেডে বিস্ফোরণে তিন ফায়ার ফাইটারসহ চারজনের মৃত্যু ও রূপনগরের শিয়ালবাড়িতে অগ্নিকান্ডের পরদিন একটি গার্মেন্টের ৩০-৪০ জন শ্রমিক অসুস্থ হওয়া। প্রযুক্তিগতভাবে সক্ষমতা থাকলে হতাহত অনেকাংশে এড়ানো সম্ভব বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
হ্যাজম্যাট টিমের কাজ কী : ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, রাসায়নিক অগ্নিকাণ্ড বা গ্যাস লিকেজ মোকাবিলার বিশেষ টিম রয়েছে তাঁদের। এর নাম হ্যাজম্যাট টিম। এ টিম দেশে ও বিদেশে উন্নত প্রশিক্ষণ নিয়েছে। এরা বিশেষ পোশাকে ঘটনাস্থলে গিয়ে কেমিক্যালের সাইন দেখে ছবি পাঠায়। এরপর সেগুলো বিশ্লেষণ করে পরবর্তী নির্বাপণ কার্যক্রম চালানো হয়।
স্টেশন ৫৩৭, স্টেশন অফিসার ১৬৫ : ফায়ার সার্ভিস অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, সারা দেশে ৫৩৭টি ফায়ার স্টেশন রয়েছে। কিন্তু স্টেশন অফিসারের সংখ্যা ১৬৫। এ পদগুলোতে বাধ্য হয়ে জুনিয়র অফিসারদের কাজে লাগানো হয়। কয়েকজন ফায়ার স্টেশন অফিসারের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কোনো ফায়ার স্টেশনে উপযুক্ত টিম লিডার না থাকলে অপারেশনাল কাজে ভুল সিদ্ধান্ত, ঘটনাস্থলে শৃঙ্খলা ধরে রাখতে ব্যর্থ হওয়া, দুর্ঘটনাস্থলে বাহিনীর সদস্যদের নীতি-নৈতিকতার মান ভেঙে পড়ার আশঙ্কা থাকে। অধিদপ্তর সূত্র জানিয়েছেন, ১ থেকে ২০ গ্রেডের বিভিন্ন পদে মোট ৯৩৫টি শূন্যপদ রয়েছে। বাহিনীর সক্ষমতা বাড়াতে যার বেশির ভাগই অতিগুরুত্বপূর্ণ। এ ছাড়া গ্রেডবৈষম্যের কারণে ভালো মানের অফিসার পেতেও সংকটে পড়তে হচ্ছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
বন্ধ ফায়ার একাডেমি নির্মাণকাজ : অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা বলেছেন, প্রশিক্ষণ ঘাটতি দূর করার জন্য কয়েক বছর আগে মুন্সিগঞ্জের গজারিয়ায় ১০০ একর জমির ওপর আন্তর্জাতিক মানের ফায়ার একাডেমি নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। যেখানে পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন ডিপ্লোমা (পিজিডি) এবং ‘মাস্টার্স ইন ফায়ার সায়েন্স’ কোর্স চালুর পদক্ষেপ নেওয়া হয়। এ ছাড়া এখানে ‘ফায়ার ফরেনসিক ল্যাব’ নির্মাণের কথা ছিল। কিন্তু নানান সীমাবদ্ধতায় জমি অধিগ্রহণের পর থমকে গেছে কাজ।
সংকট সম্পর্কে যা বলছে অধিদপ্তর : ফায়ার সার্ভিস অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রশিক্ষণ, পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) লে. কর্নেল এম এ আজাদ আনোয়ার বলেন, ‘নানান সংকট আমাদের। তবে যে কোনো বড় ঘটনা আমরা মোকাবিলা করতে সক্ষম। অন্য সমস্যাগুলো সমাধানে চেষ্টা চলছে। আর ফায়ার একাডেমির কাজও মন্ত্রণালয়ের পরামর্শ অনুযায়ী ওয়ার্ল্ড ব্যাংক ও জাইকার অর্থায়নে শুরু হওয়ার কথা রয়েছে।’