ঢাকার গেন্ডারিয়া রেলস্টেশন এলাকা থেকে গত ৫ অক্টোবর সকালে অজ্ঞাত (২৫) এক নারীর গলা কাটা লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। তার পরনে ছিল খয়েরি সালোয়ার ও কামিজ এবং খয়েরি সাদা ফুলতোলা ওড়না। ময়নাতদন্তের জন্য লাশটি ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) মর্গে পাঠানো হয়। পুলিশ বাদী হয়ে গেন্ডারিয়া থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করে। তবে পুলিশ বলছে, লাশ উদ্ধারের পর ওই নারীর পরিচয় শনাক্তের চেষ্টা করা হচ্ছে। কিন্তু ওই নারীর জাতীয় পরিচয়পত্র না থাকায় শনাক্ত করা সম্ভব হচ্ছে না। ক্লু-লেস এ ঘটনা তদন্তে বেগ পেতে হচ্ছে। ঢাকার যাত্রাবাড়ীর সায়েদাবাদ এলাকা থেকে গত ২৩ অক্টোবর দুপুরে একটি নির্মাণাধীন ভবনের নিচতলা থেকে হাত-পা বাঁধা বস্তাবন্দি অবস্থায় এক যুবকের অর্ধগলিত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। তার পরনে হালকা গোলাপি রঙের হাফ হাতা গেঞ্জি ও কালো টিশার্ট ছিল। ময়নাতদন্তের জন্য লাশটি ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) মর্গে পাঠানো হয়। পুলিশ বাদী হয়ে যাত্রাবাড়ী থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করে। পুলিশ বলছে, প্রাথমিকভাবে ধারণা হাত-পা বেঁধে ওই যুবককে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়ে থাকতে পারে। এই যুবকের পরিচয় শনাক্তের চেষ্টা চলছে। তবে লাশ পচে যাওয়ায় পরিচয় বের করা বা তদন্ত কার্যক্রম এগিয়ে নিতে বেগ পেতে হচ্ছে। বুড়িগঙ্গা নদী থেকে গত ২৩ আগস্ট উদ্ধার করা হয়েছিল অজ্ঞাত পরিচয় এক নারী (২৬) ও এক শিশুকে (৫)। তাদের প্রথমে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়েছিল। পরে লাশ নদীতে ফেলে দেয় দুর্বৃত্তরা। ময়নাতদন্তে প্রাথমিকভাবে বিষয়টি উঠে এসেছে। এ ঘটনায় সদরঘাট নৌ থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের হয়েছে। কিন্তু আঙুলের ছাপ মুছে যাওয়ায় নিহতদের পরিচয় শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। পুলিশ দুজনের ডিএনএ সংরক্ষণ করেছে, যাতে কেউ লাশ শনাক্ত করতে এলে মিলিয়ে দেখা যায়। পাশাপাশি বিভিন্ন থানায় নিখোঁজ ডায়েরির সঙ্গে ওই নারী ও শিশুর তথ্য মিলিয়ে দেখা হচ্ছে। এমনকি বিভিন্ন ভিডিও ফুটেজও বিশ্লেষণ করছে পুলিশ। নৌপুলিশ বলছে, সাধারণ গ্রেপ্তার এড়াতে অপরাধীরা লাশ নদীতে ফেলে দেয়।
শুধু এই লাশগুলোই নয়। ঢাকাসহ সারা দেশের নদী বা ডোবা, সড়ক বা মহাসড়কের পাশে, পরিত্যক্ত জায়গা বা ভবনে, সেতু বা রেললাইনে, ফুটপাত, ডাস্টবিনের পাশে প্রায় প্রতিদিনই মিলছে কারও না কারও মৃতদেহ। এদের মধ্যে কেউ অসুস্থ হয়ে মৃত, কেউবা সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত, কেউবা পরিকল্পিতভাবে হত্যাকাণ্ডের শিকার। পুলিশ লাশ উদ্ধার করে মর্গে পাঠাচ্ছে। ময়নাতদন্তও হচ্ছে। হত্যাকাণ্ডের প্রমাণ আসছে। কিন্তু হত্যা রহস্য আটকে থাকছে পরিচয়ে। অচেনা লাশ মানেই ঝামেলা। তাই কেউ আগ্রহ দেখায় না। অথচ এই মানুষগুলোও একদিন ছিল কারও প্রিয়জন। মৃতদেহগুলো মর্গে পড়ে থাকে দিনের পর দিন। এক সময় লাশের পরিচয় না পাওয়ায় বেওয়ারিশ হিসেবে ঠাঁই হয় কবরে বা শ্মশানে।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, খুনের শিকার অজ্ঞাত পরিচয় লাশ মিলছে। অনেক সময়ই লাশ উদ্ধারের পর ময়নাতদন্ত রিপোর্টে খুনের প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। আমরা লাশ উদ্ধারের পর সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করি। এরপর ময়নাতদন্তের জন্য লাশ মর্গে পাঠানো হয়। সরাসরি খুনের প্রমাণ পেলে থানায় মামলা হচ্ছে। ময়নাতদন্ত রিপোর্টে খুনের প্রমাণ পেলেও থানায় মামলা হচ্ছে। খুনের শিকার অজ্ঞাত নারী বা পুরুষের পরিচয় শনাক্তে সিআইডির ফরেনসিক বিভাগের ডিএনএ ল্যাবে পরীক্ষা করা হয়। বিভিন্ন মেডিকেল থেকে ডিএনএ সংগ্রহ করে পরিচয় শনাক্ত করা হয়। আমরা অজ্ঞাতদের পরিচয় এবং খুনিদের শনাক্তে সর্বোচ্চ চেষ্টা করে থাকি। কিন্তু পরিচয় শনাক্ত বা খুনিদের ব্যাপারে কোনো প্রমাণ না পেলে বেওয়ারিশ হিসেবে লাশ দাফন বা সৎকার করা হচ্ছে।
অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রতি মাসে থানাগুলোতে প্রায় আড়াই হাজার অপমৃত্যুর মামলা নথিভুক্ত হয়। এর মধ্যে অনেকেই হত্যাকাণ্ডের শিকার। অপরাধীরা প্রমাণ নষ্ট করতে ও আইনের চোখ ফাঁকি দিতে হত্যার পর লাশ বিভিন্ন স্থানে ফেলে দেয়। অজ্ঞাত লাশ শুধু অনাকাঙ্ক্ষিতই নয়, এটি নাগরিক জীবনে নিরাপত্তাহীনতার বড় কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতির সূচক হিসেবে গণ্য হয় অজ্ঞাত লাশ। এমন লাশ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলছে। কিন্তু লাশ উদ্ধার পর্যন্তই দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। পরিচয় উদ্ধার করে হত্যার সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের কর্তব্য।
জানা গেছে, ২০১০ থেকে চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত হাসপাতালের মর্গে থাকা ১৫ বছরে ১৫ হাজার ৩৪৪ অজ্ঞাত পরিচয় মানুষের লাশ দাফন করেছে আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম। সংগঠনটি মাসে গড়ে ৩৫ থেকে ৪০টি বেওয়ারিশ লাশ দাফন করে থাকে। এ ছাড়া চলতি বছর প্রতি মাসে নৌপুলিশ গড়ে ৪৩টি লাশ উদ্ধার করেছে। গত বছর প্রতি মাসে ৩৬টি লাশ উদ্ধার হয়েছিল। নৌপুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুসারে, এ বছরের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত দেশজুড়ে অন্তত ৩০১ নারী-পুরুষ ও শিশুর লাশ উদ্ধার হয়েছে। এর মধ্যে ২০৯ জনের পরিচয় জানা গেলেও ৯২ জন এখনো অজ্ঞাত। গত বছর নদী থেকে অন্তত ৪৪০টি লাশ উদ্ধার হয়েছিল, যার মধ্যে ১৪১ জনের পরিচয় এখনো শনাক্ত হয়নি। ২০১৯ থেকে ২০২৫ সালের মে মাস পর্যন্ত সাড়ে ৬ বছরে রেলওয়ে থানা এলাকায় হত্যা মামলা হয়েছে ৯২টি।
পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) এ এইচ এম শাহাদাত হোসাইন বলেন, কেউ লাশ শনাক্ত করতে এলে মিলিয়ে দেখার জন্য আমরা ডিএনএ নমুনা সংরক্ষণ করে রাখি। এমনকি ছবিও তুলে রাখা হয়। হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদঘাটনে আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি। পরিচয় উদঘাটনে নিখোঁজ জিডির সঙ্গে মেলানো হয়। ঘটনার আশপাশের সিসিটিভির ফুটেজ বিশ্লেষণ করেও হত্যাকারীদের শনাক্তের চেষ্টা করা হয়। অপরাধীরা চায় হত্যাকাণ্ডের আলামত মুছে ফেলতে বা নষ্ট করতে। কিন্তু অপরাধ করে কেউ পার পায় না, একদিন না একদিন সে চিহ্নিত হয় এবং তাকে আইনের আওতায় নিয়ে আসা হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক বলেন, পরিকল্পিতভাবে খুন করে ডোবা, নদী, নালা, ঝোপ-ঝাড়ে বা রাস্তার পাশে ফেলে রাখায় লাশ পচে যাচ্ছে। রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার করে লাশ বিকৃত করা হচ্ছে। খণ্ডবিখণ্ড করা হচ্ছে। পচে যাওয়া, বিকৃত করা বা খণ্ডবিখণ্ড করা এসব লাশের পরিচয় শনাক্ত অনেক সময় কঠিন হয়ে পড়ে। পরিকল্পিতভাবে হত্যা করে আলামত নষ্ট করে দিচ্ছে খুনিরা। ফলে এসব হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদঘাটনে বেগ পেতে হয়। যে কারণেই খুনের ঘটনা সংঘঠিত হোক না কেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এ বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। একটা লাশও যেন বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন না হয় সেটি নিশ্চিত করতে হবে। দীর্ঘমেয়াদি তদন্ত এবং সোর্স নিয়োগ করে হত্যাকাণ্ডের রহস্য উন্মোচন করতে হবে। এসব ঘটনায় যারা জড়িত তাদের দ্রুত গ্রেপ্তার করে বিচারের মুখোমুখি করা উচিত। তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত হলে অন্যরা এসব অন্যায় করতে ভয় পাবে এবং এসব ঘটনা থেকে বেরিয়ে আসবে।