আমাদের হাতে তিন মাসের লম্বা সময় ছিল। যা আমরা হেলায় হারাচ্ছি এবং সে সময়ে তাসের ঘরের মত থুবড়ে পড়বে স্বাভাবিক প্রতিরোধ টুকুও। বিপদের আন্দাজও করতে পারছি না, এত ভয়াবহ হবে সেটা!
স্পেইন হল ইউরোপের উষ্ণতর, আলোকোজ্জ্বল দেশ। রোদে খটখট সারা বছর। মরুভূমির মত ভূপ্রকৃতি। লোকজনের আয়ুষ্কাল দীর্ঘ। জাপানিদের পরেই স্পেনের গড় আয়ু। ৯০ শতাংশ স্প্যানিশ সুস্থ খায়, সুস্থ চলে। সুস্থ থাকে। সামনেই সামার। পর্যটন নির্ভর সুন্দর দেশটির রুটি রুজির অন্যতম সময়। এ সময়ে করোনা নিয়ে মাতামাতি করতে কারোই ভালো লাগছিল না।
করোনা যখন ইতালিতে বিষবাষ্প ছাড়ছে তখনো স্পেন ছিল নির্বিকার! অথচ করোনা হাটিহাটি পা পা করে সপ্তাহ খানেকের মধ্যেই হানা দিলো রাজধানি মাদ্রিদে! কর্তারা তখনো শাক দিয়ে মাছ ঢাকছেন! সেরে যাবে! চলে যাবে! ছুহ ছুহ করছেন!
এক সপ্তাহ পরেই বুঝা গেল, করোনা না গরম মানে, না সুস্থ শরীর মানে, না নারী শিশু মানে! করোনা কোন করুণা করছে না, বিদ্যুৎ বেগে ছড়াচ্ছে, যাকে বাগে পাচ্ছে আইসিইউ অবদি টেনে নিয়ে মেরে ফেলছে! মরার পর কেউ ছুঁতে পারছে না। দেখতে পারছে না। মরার বুকে আছড়ে পরে কাঁদতে পারছে না। জানাজায় লোক হচ্ছে না, ফিউনারেল হচ্ছে না। দাফন হচ্ছে না। সরাসরি ক্রিমেশনে পুড়িয়ে ফেলছে!
সেই স্পেন থেকে বলছি। আজ পাঁচদিন হয় জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়েছে। রাস্তায় সেনা ও পুলিশ ঘুরছে। আপনি কেবল তিন কাজের জন্য বের হতে পারবেন! খাদ্য কেনা বা ওষধ কেনা বা গ্রেফতার হওয়ার শখ হওয়া!
জরিমানা গুনবেন ২০০ ইউরো, যদি কোয়ারেন্টাইনের নিয়ম না মানেন। খোলা আছে শুধু ব্যাংক, মুদি দোকান আর ফার্মেসি। বাকিরা সিল গালা তালা। দূর পাল্লার বাস ট্রেন ৭৫% বন্ধ করা হয়েছে। শহরের সিটি সার্ভিস ৫০% কমানো হয়েছে। যেখানেই যাবেন, যুক্তি দেখাতে হবে। কেন, কিসের তাড়া?! এই হল কোয়ারেন্টাইন।
সকল সরকারি তো বটেই, বেসরকারি হাসপাতাল ক্লিনিক নেয়া হয়েছে সরকারের আওতায়। সব নিয়ন্ত্রণ সরকারের। সকল ইন্টার্ন এর মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। যে কোন ডিসিপ্লিনের চিকিৎসক হলেই প্রস্তুত করা হচ্ছে করোনা সৈনিক হিসেবে! শেষ বর্ষের ছাত্র ছাত্রীদের যুক্ত করা হচ্ছে চিকিৎসকের কাতারে! এরপর যুদ্ধ চলছে। হাসপাতালে হাসপাতালে। তবুও কমছে না মৃত্যু মিছিল।
হাত কামড়াচ্ছে সরকার, দুয়ো দিচ্ছে একে অন্যকে! আহা! আর একটা সপ্তাহ! আর দিন দশেক আগেও যদি সবাইকে খেদিয়ে ঘরে ঢুকাতাম, তো এই দাবানল রুখে দেয়া যেত! যেমন, চীন রুখেছে, সাউথ কোরিয়া ও সিঙ্গাপুর রুখেছে। বাংলাদেশ ভালো থাকুক, সেটা কে না চায়! আমার সর্বস্ব সেখানেই। মরার পরের ঠিকানা সেটা। দেশ থেকে আমার কথা ভেবে ফোন আসলে অসহায় লাগে! আমি ভাবছি তাদের নিয়ে, তারা ভাবে আমাকে নিয়ে!
আমি ডাক্তারি পড়াশোনা করেছি, এসব ভাইরাস ব্যাক্টিরিয়ার নাশকতা সম্পর্কে জানি। এখানে স্বচক্ষে ইউরোপের দুর্গতিও দেখছি। তবুও চাই, ভুল প্রমাণিত হোক আমার ধারণা। করোনা যাদু মন্ত্র বলে সরে যাক বাংলার আকাশ থেকে। নয়ত, আজাব আসন্ন। অতি আসন্ন।’
লেখক : চিকিৎসক
সিএমসি ৪৬, ২০০৩/২০০৪
সেকেন্ড সেক্রেটারি
অ্যাম্বাসি অব বাংলাদেশ
মাদ্রিদ, স্পেন।
বিডি-প্রতিদিন/শফিক