বুধবার, ২২ সেপ্টেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

কুড়িগ্রামে বাল্যবিয়ের হিড়িক

কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি

কুড়িগ্রামে বাল্যবিয়ের হিড়িক

দীর্ঘ প্রায় দেড় বছর থেকে করোনা মহামারীর কারণে সারা দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। দরিদ্র্যপীড়িত দেশের উত্তরের জেলা কুড়িগ্রামেও সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল। এ সময়টাতে এ অঞ্চলের দরিদ্র ও অশিক্ষিত কিংবা কম শিক্ষিত অনেক অভিভাবক তাদের কন্যা সন্তানকে বোঝা হিসেবেই মনে করেন। লেখাপড়া বন্ধ থাকায় দিনের পর দিন কন্যা সন্তান বড় হচ্ছিল। সমাজে ও এলাকায় কিংবা পরিবারের বোঝা মনে করতে থাকেন কতিপয় অভিভাবক। পাশাপাশি কন্যা শিশুদের নিরাপত্তার অভাব, যৌতুক প্রথা ও কুসংস্কারের কারণে বাল্যবিয়ে দিতে বাধ্য হন জেলার ফুলবাড়ী উপজেলার বেশ কিছু অভিভাবক। করোনাকালীন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার সুবাদে ফুলবাড়ী উপজেলায় এক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই ৮৫ জন শিক্ষার্থী বাল্যবিয়ের শিকার হয়। গত ১২ সেপ্টেম্বর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া হয়। এর পরপরই বিদ্যালয়ে ছাত্রী উপস্থিতি কম হওয়ায় শিক্ষকদের মধ্যে হতাশা বিরাজ করে। দেখা গেছে ছাত্রী সংখ্যা অনেক কমে গেছে। কম বয়সেই এসব শিক্ষার্থী এখন স্বামীর বাড়িতে ঘর-সংসার করছে। এলাকাবাসীসহ জনতার দাবি  দারিদ্র্যতা, যোগাযোগ বিচ্ছন্নতাসহ নানা প্রতিবন্ধকতার জন্য এ উপজেলায় বাল্যবিয়ের হার উদ্বেগজনকহারে বাড়ছে। কোনোক্রমেই রোধ করা সম্ভব হচ্ছে না বাল্যবিয়ে। সম্প্রতি ফুলবাড়ী উপজেলার বড়ভিটা বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ে এ চিত্র দেখা যায়। ওই প্রতিষ্ঠানের প্রধান শিক্ষক মতিউর রহমান খন্দকার জানান, ইতিপূর্বে তার বিদ্যালয়ে ৩৪৫ জন শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছিল। কিন্তু এরই মধ্যে ৮৫ জন বালিকার বাল্যবিয়ে হয়ে যায়। তিনি অত্যন্ত আশ্চর্যান্বিত হয়ে বিষয়টি নিশ্চিত করেন। এছাড়া এ বিষয়ে উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তাকে লিখিতভাবে জানিয়েছেন বলে জানান তিনি। তার ভাষ্যমতে, এ সময়েই বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে-ষষ্ঠ শ্রেণিতে দুজন, সপ্তম শ্রেণিতে ১১ জন, অষ্টম শ্রেণিতে ১৭ জন, নবম শ্রেণিতে ২৮ জন, দশম শ্রেণিতে ১৪ জন এবং আগামী নভেম্বরের অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া এসএসসি পরীক্ষার্থী ১৩ জন বাল্যবিয়ের শিকার। গত ২০২০ মার্চ মাসে করোনা মহামারীর কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হওয়ার আগে এ বিদ্যালয়ে প্রতিদিন গড়ে শিক্ষার্থীর উপস্থিতি ছিল ৭০-৯০ শতাংশ।

 কিন্তু এখন করোনা পরবর্তী বিদ্যালয় চালু হলে উপস্থিতি রয়েছে ৪০-৫০ শতাংশ। বড়ভিটা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী নাছিমা, নুপুর ও আতিকা খাতুনসহ অনেকেই জানায়, গত ১২ সেপ্টেম্বর  বিদ্যালয় খোলার প্রথম দিনে এসে দেখে যে তাদের ১৭ জন বান্ধবীর বিয়ে হয়ে গেছে। এজন্য তারা দুশ্চিন্তিত হয়ে পড়ে। অপর ৯ম শ্রেণির শিক্ষার্থী  সুমী আক্তার জানায়, আমার ক্লাসেরও ২৮ জন বান্ধবীর বাল্যবিয়ে হয়েছে। সবমিলে স্যারদের কাছে জানলাম আমাদের স্কুলে ৮৫ থেকে ৯০ জন শিক্ষার্থীর বাল্যবিয়ে হয়েছে। ওই প্রতিষ্ঠানের বাল্যবিয়ের শিকার নিলুফা ইয়াসমিনের বাবা সাইকেল মেকার বাবলু মিয়া জানান, বাধ্য হয়ে মেয়েকে বিয়ে দিয়েছি। কোনোরকম মানুষের সাইকেল ভালো করেই যা পাই তা দিয়েই চলে সংসার। তাও করোনার কারণে অনেক কষ্টে চলতে হয়। মেয়ের  একটা ভালো সম্বন্ধ পাওয়ায় পর আর দেরি করি নাই। সঙ্গে সঙ্গে মেয়েটার বিয়ে দিয়েছি। ওই বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মতিউর রহমান খন্দকার জানান, বিদ্যালয় খোলার পর শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি কম থাকায় শিক্ষকরা প্রতিটি শিক্ষার্থীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে খোঁজ খবর নিতে থাকি। যে সব শিক্ষার্থীর বিয়ে হয়ে গেছে আমরা তাদের বাড়িও যাচ্ছি। সব শিক্ষার্থীকে স্কুলে ফেরাতে কাজ করছি। ফুলবাড়ী উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার মো. আব্দুল হাই জানান, বড়ভিটার এ স্কুলের বাল্যবিয়ের বিষয়টি অত্যন্ত উদ্বেগজনক। বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অভিভাবকদের সঙ্গে মতবিনিময় করে ব্যাপক জনসচেতনতা বাড়াতে শিক্ষকদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ফুলবাড়ী উপজেলা নির্বাহী অফিসার সুমন দাস জানান, তিনি বড়ভিটা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের ৮৫ জন শিক্ষার্থীর বাল্যবিয়ের বিষয়টি শুনেছেন। তবে বাল্যবিয়ে কিভাবে প্রতিরোধ করা যায় সে বিষয়ে তিনি জনসচেতনতা বাড়ানোর তাগিদ করেন।

সর্বশেষ খবর