আজ ১৫ ডিসেম্বর। পার্বতীপুর হানাদারমুক্ত দিবস। ১৯৭১ সালের এ দিনে দেশের মুক্তিকামী জনতা পার্বতীপুরকে শত্রুমুক্ত করে। ৭ মার্চের পর সারা দেশের মত পার্বতীপুরেও শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলন।
আন্দোলনের স্রোতে ব্যবসা-বাণিজ্য, অফিস আদালত, স্কুল-কলেজের শিক্ষা কার্যক্রম অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। ট্রেন চলাচল প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। ২৩ শে মার্চ শহরের অবাঙালিদের নির্যাতন ও বৈষম্যমূলক আচরণে ক্ষুদ্ধ হয়ে গ্রাম-গঞ্জের সাধারণ মানুষ শহর ঘেরাও করে সিদ্দিক মহল্লায় অগ্নিসংযোগ করে। এ সময় অবাঙালিরা নিরস্ত্র বাঙ্গালীর উপর ব্যাপক গুলি চালায়। বাড়ি বাড়ি গিয়ে বাঙালিদের ধরে নিয়ে আসে হানাদাররা। ২৪ ও ২৫ মার্চ স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মচারীসহ ১১ জন, ব্যবসায়ী ৪ জন, কাশিয়া তেলীর পরিবারের ৪জন, তৎকালীন সিনেমা হলের ম্যানেজারের গোটা পরিবার, ওয়াহিদ কোম্পানির দুই কর্মচারি, পার্বতীপুর থানার এএসআই গোলাম মোস্তফার পরিবারের সকল সদস্য, ক্যাপ্টেন ডাক্তারের পুত্র ডা. সামসাদ সহ অসংখ্য লোককে কয়লা ইঞ্জিনের বয়লারে নৃশংসভাবে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়।
এ গণহত্যার পর পার্বতীপুরের বাঙালিরা ক্রোধে ফেটে পড়ে। ২৬ মার্চ দেশব্যাপী যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। মুক্তিযুদ্ধের কৌশলগত ট্রেনিং না থাকায় দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ ছাত্র, শিক্ষক, সরকারি কর্মচারি, যুবকরা সংঘবদ্ধ হতে শুরু করে। এর পর তৎকালীন বেঙ্গল রেজিমেন্ট পুলিশ আর আনছার বাহিনীর সদস্যরা এসে তাবু ফেলে খোলাহাটী আটরাই গ্রামে।
তাদের নেতৃত্বে ছিলেন ক্যাপ্টেন আনোয়ার। ড. আব্দুল বারী ও আব্দুল মতিনের বাড়ি ও তৎসংলগ্ন এলাকা তারা ব্যবহার করে। স্থানীয় যুবকদের নিয়ে সংগ্রামী দল গঠন করে।
২৮ মার্চ একজন পাঞ্জাবী মেজরের অধীনে ক'জন বাঙালি সৈন্য হুগলীপাড়ার সিও অফিস (বর্তমান উপজেলা পরিষদ চত্ত্বর) চত্ত্বরে পাহারা দিচ্ছিল। দ্বিতল ভবনে কামান পেতে মেজর বাঙালিদের তৎপরতা লক্ষ করে ওয়ারলেসে খবর দেওয়ার সময় সঙ্গে থাকা বাঙালি সেনারা তাকে হত্যা করে।
এ ঘটনা জানতে পেরে হানাদাররা হুগলীপাড়ার ছাত্র আব্দুল লতিফকে র্নিমমভাবে হত্যা করে রেল ইঞ্জিনের বয়লারে পুড়িয়ে। ১ এপ্রিল সশস্ত্র বাহিনী ও স্থানীয় যুবকদল সন্ধ্যা থেকে শহরের চারিদিকে অবস্থান নেয়। মর্টার লাঞ্চার বসানো হয় বৃত্তিপাড়ায়। হলদীবাড়ীতে একটি সশস্ত্র দল মোতায়েন করা হয়। গ্রামাঞ্চলের লোকজন দা, বল্লম নিয়ে শহরের বাইরে সমবেত হতে লাগল। ভোর ৬ টায় তুমুল গোলাগুলি শুরু হয়। প্রচন্ড শব্দে প্রথম সেল নিক্ষিপ্ত হয় শহরের শোয়েব বিল্ডিং (বর্তমানে পৌরসভা) এর উপর এবং তা ভেঙে যায়। এভাবে বেশ কয়েকটি সেল পার্বতীপুরের বিভিন্ন অংশে আঘাত হানার পর অবাঙালিদের গুলি বর্ষণ থেমে যায়।
বাঙালিদের সশস্ত্র বাহিনীর একটি দল ঢুকে যায় শহরে। ২ এপ্রিল মুক্তিযোদ্ধাদের পার্বতীপুর আক্রমনের প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য পাক সেনা ও তাদের সহচর অবাঙালি বিহারী, পেশোয়ারী, ইরানী ও অন্যান্য উর্দুভাষী ব্যক্তিরা হিংস্র উন্মত্ততার মেতে ওঠে। তারা পার্বতীপুর শহরের ৫ বর্গ কিলোমিটার এলাকায় অগ্নি সংযোগ, লুটপাট, হত্যা, ধর্ষণ ও নির্যাতন চালায়। মেয়েদের উপর চালায় পাশবিক নির্যাতন।
পার্বতীপুরে সবচেয়ে মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ড ঘটে ৮ এপ্রিল। এদিন পার্বতীপুর শহরের অবাঙালিদের নেতা বাচ্চা খানের নেতৃত্বে একটি সামরিক গাড়ি যায় খোলাহাটিতে এবং বিপরীত দিক থেকে আরও একটি দল খোলাহটি পৌঁছে।
দুইটি দলের পাক সেনারা বিকেল ৩টার দিকে আক্রমন ও নির্বিচারে গুলি চালিয়ে শিশুসহ প্রায় ৩শ' নিরীহ গ্রামবাসীকে হত্যা করে। কয়েকশ' নারী, বৃদ্ধ, শিশু আত্মরক্ষার্থে পালিয়ে যাবার সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হয়। শত শত ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয় হানাদার ও তাদের দোসররা। পার্বতীপুরে পাক সেনাদের এ গণহত্যা ও নৃশংসতা হিটলারের নাৎসী বাহিনীকেও হার মানায়। ধর্ষিত হয় অসংখ্য মা-বোন। লুট হয় ধনসম্পদ।
পাকসেনা, মিলিশিয়া, রাজাকার বাহিনীর বর্বর নির্যাতন নিপীড়ন দিনের পর দিন বৃদ্ধি পেতে থাকে। খিয়ারপাড়া গ্রামের ১৪ জন যুবককে একসঙ্গে ধরে নিয়ে সারিবদ্ধভাবে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করা হয়। ভবানীপুর থেকে ইউপি চেয়ারম্যান সরদার আ. হাকিমকে ধরে নিয়ে কয়লা ইঞ্জিনের বয়লারে জীবন্ত পুড়িয়ে মারে।
এছাড়া হানাদার বাহিনী পার্বতীপুর-সৈয়দপুর রেল পথের ১নং লেবেল ক্রসিংয়ের পাশে শত শত মানুষকে জবাই করে হত্যা করে। ভোটগাছ এলাকার একটি কূপে গুলি করে অসংখ্যা মানুষকে গণকবর দিয়েছিল। চন্ডিপুর ইউনিয়নের কালিকাবাড়ি ডাঙ্গা গ্রামে কঁচুকাটার মত বাঙালিদের হত্যা করে একটি কূপের মধ্যে ফেলে সেটি ভরে ফেলে।
১৩ ডিসেম্বর ভবানীপুর, হাবড়া, বেলাইচন্ডি, খোলাহাটি ও হরিরামপুর এলাকার পাকসেনা ক্যাম্প, রাজাকার ক্যাম্পগুলো মুক্তিযোদ্ধারা দখলে নেওয়া শুরু করে। অবস্থা বেগতিক দেখে হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসররা পার্বতীপুর থেকে পালাতে থাকে। ১৪ ডিসেম্বর প্রথম ভারতীয় বিমান বাহিনী বোমা মেরে পার্বতীপুরে রেলওয়ে তেল ট্যাংকার ধ্বংস করে দেয়। মিত্র বাহিনীর বিমান হামলা ও মুক্তিযোদ্ধাদের প্রচন্ড আক্রমনের মুখে পাকসেনা, রাজাকার এবং অবাঙালি সকল বাসিন্দা শেষ রাতে রেলযোগে পার্বতীপুর থেকে সৈয়দপুর পালিয়ে যায়।
পাকসেনার শেষ সামরিক গাড়িটি পালানোর পথে বেলাইচন্ডির অদূরে বান্নিঘাটে পেতে রাখা মাইন বিষ্ফোরণে উড়ে যায়। এতে একজন কর্ণেল, একজন মেজর ও একজন লেফটেনেন্ট নিহত হয়। ১৫ ডিসেম্বর মুক্তিযাদ্ধা ও শত শত লোকজন পার্বতীপুর শহরে প্রবেশ করে এবং শোয়েব ভবন (বর্তমান পৌরসভা ভবন)সহ বড় বড় ভবনে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করে বিজয়োল্লাস শুরু করে। আজকের এ দিনে পার্বতীপুর হানাদার মুক্ত হয়।
বিডি-প্রতিদিন/১৫ ডিসেম্বর ২০১৫/ এস আহমেদ