মিউজিক ভিডিওতে কাজ করার কথা বলে মুঠফোনে ডেকে এনে দুই তরুনীকে গণধর্ষণ করে ডিবি পুলিশের সোর্সসহ ৪ জন। আর এই ঘটনার জড়িত অভিযোগে দুই জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তবে ঘটনার মূল হোতা পালিয়ে গেছে। ভবনের প্রধান ফটকের তালা ভেঙে পালিয়ে যায় মূল হোতা ও গোয়েন্দা পুলিশের সোর্স লিটন আলী মন্ডল ও তার সহযোগী জাহাঙ্গীর ওরফে রেজাউল।
তারা দুজনেই ধর্ষণের ঘটনাস্থল ওই ভবনের পঞ্চম তলার একটি রুমে ভাড়া থাকতো। দুটি পৃথক গোয়েন্দা সংস্থার সদস্য হিসাবে নিজেদের পরিচয় দিতো। আর এই পরিচয় দিয়েই তারা ফজরের নামাজের আগে প্রধান ফটকের তালা ভেঙে পালিয়ে গেছে।
বৃহস্পতিবার দিবাগত রাতে সাভারে গোয়েন্দা কার্যালয়ের পাশের একটি ভবনের দ্বিতীয় তলায় লিজেন্ড কলেজের কমন রুমের ভিতর আটকিয়ে ২ তরুণীকে গণধর্ষণ করে ডিবি পুলিশের সোর্স লিটন আলী মন্ডল। ঘটনার পর থেকে সোর্স লিটন, ভবনটির মালিক কবীর হোসেন ও কলেজ কর্তৃপক্ষ কাউকেই পাওয়া যায়নি। গ্রেফতারকৃতরা হলেন, দিনাজপুর জেলার বিরল থানার সৈয়দপুর এলাকার ছফি উল্লার ছেলে মোকারম হোসেন (১৯) ও কুড়িগ্রাম জেলার ভুড়িমাড়ী থানার সখিপুড়ী গ্রামের মতিউর রহমানের ছেলে মিজানুর রহমান (২৮)। এদের মধ্যে মিজানুর ভবনটির নিরাপত্তা প্রহরী ও মোকারম কেয়ারটেকার। পালিয়ে যাওয়া ধর্ষক লিটন আলী মন্ডল (৩৪) ঝিনাইদাহ জেলার সদর থানার গোসালপুর এলাকার শমসের আলী মন্ডলের পুত্র। সে ডিবি পুলিশের সোর্স হিসেবে কাজ করতো।
ঢাকা জেলা (উত্তর) গোয়েন্দা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এএফএম সায়েদ বলেন, প্রতিবেশীরা দুই তরুণীকে উদ্ধার করে আমাদের খবর দেয় আমারা তাদের নিয়ে আসি। তবে ঘটনার মূল হোতা লিটন পালিয়ে গেছে। ঘটনায় সাথে জড়িত থাকায় ভবনের নিরাপত্তা প্রহরী ও কেয়ারটেকারকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে মামলার দায়ের করা হয়। তবে ধর্ষক লিটন তাদের সোর্স আগে ছিলো দাবি করে ওসি সায়েদ বলেন, লিটনকে ৫০ বোতল ফেন্সিডিল ও এক কেজি গাঁজাসহ এর আগে গ্রেফতার করা হয়েছিলো।
ডিবি কার্যালয়ে ধর্ষণের স্বীকার ২০/২৫ বছর বয়সী তরুণী জানান, তিনি ও তার বান্ধবী গাজিপুরের কোনাবাড়ীতে থাকেন। উত্তরার ‘মা মিউজিক ভিশন’ নামে একটি প্রতিষ্ঠানে মিউজিক ভিডিওতে অভিনয় করেন তারা। লিটনের সাথে কয়েক মাস আগে তাদের মুঠফোনে পরিচয় হয়। সেই সুবাদে লিটন তাদের ফোন করে বড় একটি প্রতিষ্ঠানে মিউজিক ভিডিও'র কাজ দেয়ার কথা বলে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় সাভার বাজার বাসস্ট্যান্ডের সিটি সেন্টারের সামনে আসতে বলে।
তখন তারা আসলে লিটন ও সিটিএসবির কনস্টেবল পরিচয়দানকারী রেজাউল তাদের সাথে কথা বলে ডিবি কার্যালয়ের পাশে তাদের ফ্যামিলি বাসায় বেড়াতে নিয়ে যায়। তরুণী বলেন, বাড়ির দ্বিতীয় তলায় একটি ফ্লাটে নিয়ে গেলে আমরা লিটন ভাইকে বলি ভাবি কই, তখন সে বলেন, বাহিরে গেছে এই বলেই সে দরজা আটকিয়ে দেয়। দুই তরুণীকে দুই কক্ষে আটকে রাখে তারা। রাতে ২ জনকে গণধর্ষণ করে লিটনসহ অন্য বন্ধুরা। পরে ধর্ষকের হাত থেকে বাঁচতে অন্য কক্ষে আটকে থাকা তরুণী জানালা দিয়ে চিৎকার চেচাঁমেচি করলে শুক্রবার ভোরে প্রতিবেশীরা বিষয়টি বুঝতে পেরে ওই বাড়িতে যায় এবং ডিবি পুলিশকে খবর দেয়। এরই মধ্যে লিটন ও রেজাউল বাড়ি থেকে বেরিয়ে চলে যায়। সরজমিনে ডিবি অফিসের পাশে বি/১১৮/৩ সোবহানবাগ কবীর হোসেনের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, নীচ তলার ফ্ল্যাটটি লিজেন্ড কলেজ, দ্বিতীয় তলায় যে ফ্ল্যাটে ধর্ষণ করা হয়েছে সেটি তালাবদ্ধ। ফ্লাটে লিজেন্ড কলেজ কর্তৃপক্ষের অফিস রুমে এই ঘটনা ঘটানো হয়।
তবে ঘটনার পর থেকে ভবনটির মালিক কবীর হোসেন পলাতক থাকলেও মুঠফোনে তিনি বলেন, আমি জানি না রুমে রাতে কি হইছে। ওই ফ্ল্যাটটি লিজেন্ড কলেজ ভাড়া নিছে। তবে ওই ধর্ষণের ঘটনার সাথে তিনি জড়িত নন বলে দাবি করেন। এছাড়াও দুই তরুণীকে উদ্ধার করে স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ওয়ান স্টফ ক্রাইসিস সেন্টারে ভর্তি করা হয়। ধর্ষিতা বুবলী (ছন্দ্র নাম) বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, লিটন আলী মন্ডল, সিটি এসবির কনস্টেবল রেজাউল আমাদেরকে বলেন, ভালো মডেল বানানো হবে, যে ভাবে বলি সেই ভাবে কাজ করতে হবে। একটি বাড়ির সামনে পৌঁছালে সেখানে আগে থেকেই অবস্থান করা ৩ বখাটে আমাকে ওই বাড়ির ভেতর নিয়ে হাত ও মুখ বেঁধে এবং অস্ত্র দেখিয়ে গণধর্ষণ করে। তিনি আরো বলেন, রাতভর গণধর্ষণের পর বখাটেরা তাকে সেখানে রেখেই পালিয়ে যায়।
এদিকে দুই তরুণী ধর্ষণ মামলায় গ্রেফতার হওয়া দুই আসামির দুই দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। আসামিরা হলেন, নিরাপত্তাকর্মী মোকাররম ও মিজান। শনিবার বিকালে ঢাকা জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিচারক তাওহীদ আল আজাদ এই রিমান্ড আবেদন মঞ্জুর করেন। আদালতের সাধারণ নিবন্ধন কর্মকর্তা (জিআরও) এসআই আতিকুর রহমান এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তিনি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন , ‘সাভারে দুই তরুণী গণধর্ষণ মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা সাভার থানার পুলিশ পরিদর্শক (অপারেশন) শহীদ সোহরাওয়ার্দী গ্রেফতার হওয়া দুই আসামিকে আদালতে হাজির করে পাঁচ দিনের রিমান্ড আবেদন করেন।’ রিমান্ড আবেদনে উল্লেখ করা হয়, এই ঘটনার সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের নাম-ঠিকানা জেনে গ্রেফতার করার জন্য দুই আসামিকে নিবিড়ভাবে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পাঁচ দিনের রিমান্ড প্রয়োজন। আদালত শুনানি শেষে প্রত্যেকের দুই দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেন। আসামিদের পক্ষে কোনো আইনজীবী ছিলেন না বলে জানিয়েছেন জিআরও আতিকুর রহমান।
অন্যদিকে মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন সম্প্রতি ধর্ষণের ঘটনা বেড়েছে বলেই তাদের মনে হচ্ছে। মানবাধিকার সংস্থা বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী এলিনা খান বাংলাদেশ প্রতিনিকে বলেন, খবরের কাগজে যা দেখা যায় ধর্ষণের প্রকৃত ঘটনা তার চেয়ে বেশি। এলিনা খান বলেন, অপরাধীরা মনে করে ভিকটিম থানায় মামলা করবে না। এজন্য ধর্ষণের প্রবণতাও বাড়ছে।
তিনি বলেন, 'প্রতিদিন বিভিন্ন পত্রিকায় আমরা ১০-১২টি ধর্ষণের খবর দেখি। বাস্তবে তার চেয়ে বেশি। অনেকে লজ্জায় ঘটনা প্রকাশ করতে চায় না।'
বিডি প্রতিদিন/৯ জুলাই ২০১৭/হিমেল