চিকিৎসা মানুষের অন্যতম মৌলিক অধিকার। আপন মানুষটির শারিরীক সুস্থতা, সন্তানের পৃথিবীর আলোয় বেড়ে উঠা দেখতে প্রত্যেকটা মানুষই সকল কিছু ত্যাগে যেন প্রস্তুত থাকেন। আর এই সুযোগে বেসরকারি হাসপাতাল বা ক্লিনিকগুলো মুনাফা লাভেই বেশি মনোযোগী! রোগীর জীবন যেন খেলনা মাত্র। ভুল চিকিৎসা ও গাফিলতিতে রোগীর মৃত্যু যেন থামছেই না কালিহাতীর নিরাময় হাসপাতালে।
১৫ নভেম্বর শুক্রবার প্রসব ব্যথা নিয়ে নিরাময় (প্রা.) হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসেন উপজেলার বীরবাসিন্দা গ্রামের সৌদি প্রবাসী আ. ছালামের স্ত্রী কল্পনা আক্তার রুপজান ( ৩৮)। ওই দিন দুপুরে সিজারিয়ান অপারেশন করে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। অবস্থার অবনতি হলে শনিবার রাতে অন্যত্র রেফার্ড করেন চিকিৎসক। স্বজনরা তাকে মির্জাপুরের কুমুদিনী হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসকরা তাকে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে রাখলে রবিবার সন্ধ্যায় মারা যান কল্পনা আক্তার রুপজান।
নিহতের স্বজন মোস্তফা (ননদ জামাই) জানান, আমার স্ত্রীর বড় ভাই (নিহতের স্বামী) প্রবাসী হওয়ায় এ পরিবারের অনেক দায়িত্ব আমাকে পালন করতে হয়েছে। ডাক্তার ও নার্সরা জানায় সিজারের সময় ভিতরে রক্ত জমাট বাধার কারণে মারা যান তিনি।
এ বিষয়ে কুমুদিনী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক ডা. রাবেয়া খাতুন বলেন, রোগীটিকে আমাদের হাসপাতালে আনা হলে অপারেশন করে পেটের ভিতর থেকে কমপক্ষে ৩-৪ লিটার জমাট রক্ত বের করার পরও কোনও অবস্থাতেই রক্তক্ষরণ বন্ধ হচ্ছিলো না। এমন অবস্থাতেই রোগীটির করুণ পরিণতি হয়।
গত বছরের শেষের দিকে উপজেলা সদরের দক্ষিণ বেতডোবা গ্রামের রাজ মিস্ত্রি হাবিবের স্ত্রী ছাহেরা খাতুন (৩০) প্রসব সেবা নিতে একই হাসপাতালে আসেন। হাবিব জানান, সিজারিয়ান অপারেশন করে ডা. মিরুফা তাজনীন সুমি অপারেশন করার সময় রক্ত নালি কেটে ফেলায় রক্ত পড়া কোন ক্রমেই বন্ধ হচ্ছিলো না। মুমূর্ষ অবস্থায় সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠিয়ে দেয় নিরাময় (প্রা.) হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। সেখানে অপারেশনের পরও রক্ত পড়া বন্ধ হয়নি, লাইফ সাপোর্টে থাকাবস্থায় মারা যায় ছাহেরা।
একই গ্রামের ভুক্তভোগী মতিন মিয়া জানান, ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে তার স্ত্রী কান্তা বেগম (৩৫) প্রসব সেবা নিতে একই হাসপাতালে আসেন। সিজারিয়ান অপারেশন করেন ডা. মারজিয়া খানম। অপারেশন করার ১০/১২ দিন পর থেকে জরায়ুর চার পাশে অসহ্য ব্যথা অনুভব করে। বারবার ডাক্তারকে দেখানো হয় ঔষধ লিখে দেয় নিয়মমতো খায়, ব্যথা কমেনা। এমতাবস্থায় প্রায় এক মাস পর এক রাতে প্রচন্ড রক্তপাত শুরু হলে টাঙ্গাইল জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসায় কিছুটা সুস্থ হলে বাড়িতে নিয়ে আসি। এক সপ্তাহ পর আবারো রক্তপাত শুরু হয়। এভাবে চার দফা রক্তপাতে তেরো ব্যাগ রক্ত দেওয়া হয়। নিরাময় (প্রা.) হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ও ডা. মারজিয়া খানমের মধ্যস্থতায় টাঙ্গাইল জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। শেষ ধাপে সংকটাপন্ন অবস্থায় ডা. মারজিয়া খানমসহ অন্যান্য ডাক্তারের তত্ত্ববধায়নে অপারেশন করে জরায়ু কেটে ফেলার পর পুরোপুরি সুস্থ হয়। কিন্তুু এতে করে আমার স্ত্রী স্থায়ী ভাবে মাতৃত্ব হারায়। ভবিষ্যতে আর কাউকেই যেনো এরকম ভুল চিকিৎসার স্বীকার হয়ে মাতৃত্ব হারানো, আর্থিক, মানসিক, পারিবারিক, পেশাগত ক্ষতির মুখোমুখি না হতে হয় যথাযথ কর্তৃপক্ষের নিকট ব্যবস্থা গ্রহণের দাবিও জানান তিনি।
নিহত লতা রানী সূত্রধরের বড় জা লক্ষী রানী সূত্রধর বলেন, ২০১২ সালের ২ ফেব্রুয়ারি ভোর সাড়ে ৫টায় উপজেলার পাছজোয়াইর গ্রামের জগদীশ চন্দ্র সূত্রধর তার স্ত্রী লতা রানী সূত্রধরের প্রসব চিকিৎসা নিতে একই হাসপাতালে আসেন। ডাক্তার আসবে আসবে বলে স্যালাইন দিয়ে বিকাল সাড়ে ৪ টায় সিজারের জন্য নিয়ে যায়, ইতিমধ্যে ব্যথায় আমার জায়ের সারা শরীর নীল হয়ে যায়। ডাক্তার রক্ত লাগবে জানালে নিহতের স্বামী জগদীশ এক ব্যাগ রক্ত দেয়, পায়ের গোছা দিয়ে রক্ত প্রবেশ করানোর চেষ্টা করে কিন্তুু রক্ত শরীরে না ঢুকে জমাট বেধে থাকে। ঐখানেই রোগীর জীবন সংকটাপন্ন করে ক্লিনিক থেকে টাঙ্গাইলে নিয়ে যেতে বলে, নেওয়ার পথে রাজাবাড়ী পর্যন্ত পৌছালেই মারা যায় আমার জা। এরকম গাফিলতির কারণে আর কারও যেন মরতে না হয় এমন দাবি জানান তিনি।
এ বিষয়ে কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি নিরাময় (প্রা.) হাসপাতালের পরিচালক সৈয়দ আব্দুল ওয়াদুদ তৌহিদ।
সিভিল সার্জন ডা. শরীফ হোসেন খান বলেন, তদন্তসাপেক্ষে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
বিডি প্রতিদিন/হিমেল