৮ মার্চ, ২০২১ ১৬:১৯

বগুড়ায় দেশি মুরগির খামার গড়ে যুবক-যুবতীরা হয়েছেন লাখপতি

আবদুর রহমান টুলু, বগুড়া

বগুড়ায় দেশি মুরগির খামার গড়ে যুবক-যুবতীরা হয়েছেন লাখপতি

বগুড়ায় বাণিজ্যিকভাবে দেশি মুরগির খামার গড়ে বেকার যুবক-যুবতীরা আত্মকর্ম নির্ভরশীল হয়ে উঠছেন। বেকার হয়ে ভবঘুরে ছিল যারা, তারা আজ সংসারের হাল ধরে নিজেদের আর্থিকভাবে উন্নয়ন করেছেন। সংসারে নিয়ে এসেছেন আর্থিক গতি। শেরপুর উপজেলায় এখন কয়েকশত যুবক দেশি মুরগির খামার গড়ে লাখপতি হয়ে গেছেন।

জানা যায়, বগুড়ার শেরপুর উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় বাণিজ্যিকভাবে দেশি মুরগির খামার গড়ে উঠেছে। খামারীরা প্রথম দিকে নিজ খামারে দেশীয় মুরগির লালন-পালন করে স্থানীয় বাজারে কেনাবেচা করলেও এখন ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় চলে যাচ্ছে দেশীয় মুরগি।

শেরপুর উপজেলার বেকার যুবকদের আয়ের পথে নিতে প্রাণী সম্পদ দপ্তরের ভেটেরিনারী সার্জন ডা. রায়হান কিছু বেকার যুবকদের নিয়ে গড়েন ‘স্বপ্ন ছোঁয়ার সিড়ি’ নামের একটি খামার সংঘ। এ সংঘে বেকার যুবকদের নিয়ে দেশীয় মুরগি লালন-পালনের বিনামূল্যে প্রশিক্ষণ দিতে থাকেন। প্রশিক্ষণ পেয়ে বাণিজ্যিকভাবে দেশীয় খামার গড়ে ধীরে ধীরে স্বাবলম্বী হতে থাকেন।

বগুড়ার শেরপুর উপজেলার শাহবন্দেগী ইউনিয়নের ধড়মোকাম গ্রামস্থ নিজ বসতবাড়িতে জাকারিয়া হোসেন নামের এক বেকার যুবক গড়ে তোলেন ক্ষুদ্র পরিসরে বাণিজ্যিক দেশি মুরগির খামার। মাত্র ৫০টি দেশি মুরগির বাচ্চা নিয়ে শুরু করা তার খামারটিতে বর্তমানে হাজারের ওপরে মুরগি রয়েছে। এর মধ্যে দেশি জাতের ডিম পাড়া (প্যারেন্টস) মুরগিই রয়েছে পাঁচ শতাধিক।

এছাড়া নিজ বসতবাড়িতেই একসঙ্গে ৩৭ হাজার দেশি মুরগির ডিম ফোটানোর জন্য রয়েছে নিজস্ব হ্যাচারি। বিগত পাঁচ বছরের ব্যবধানে ব্যবসার পরিধি বাড়ায় শূন্য থেকে লাখপতি বনে গেছেন যুবক জাকারিয়া। এই খামার থেকে তার প্রতিমাসে খরচ বাদে আয় প্রায় অর্ধলাখ টাকা। কেবল জাকারিয়াই নয়, তার মতো এই উপজেলার সহস্রাধিক তরুণ-তরুণী বাণিজ্যিক ভিত্তিতে দেশি মুরগির খামার গড়ে বেকারত্বের অভিশাপ থেকে মুক্তি পেয়েছেন। স্বপ্ন ছোঁয়ার সিড়ি সংঘের সদস্য উদ্যোক্তাদের খামারে এখন কর্মসংস্থান হয়েছে আরও অন্তত দশ হাজার মানুষের। এই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত থেকে জীবিকা নির্বাহ করছেন তারা।

দেশি মুরগির খামার গড়া সুর্বণা খাতুন নামের এক নারী খামারি জানান, ‘দেশি মুরগির খামার করে দিনের সন্ধান পেয়েছেন। আর হতাশাগ্রস্ত বেকার জীবন থেকে কর্ম পেয়েছেন।’

আব্দুস সালাম নামের আরেক খামারি বলেন, শিক্ষাজীবন শেষ করে সরকারি চাকরির জন্য বিভিন্ন জায়গায় ধরনা দেয়। কিন্তু চাকরি নামক সোনার হরিণ পায়নি। এতে হতাশ হয়ে পড়েন। বোঝা হয়ে যায় পরিবারের। প্রতিনিয়তই নানা কথা শুনে বিপদে পা বাড়ায়। হাতে তুলে নেয় মাদক। পরে ‘স্বপ্ন ছোঁয়ার সিঁড়িতে মুরগি পালনের প্রশিক্ষণ নিয়ে নিজের বসতবাড়িতে একটি দেশি মুরগির খামার গড়ে তোলেন। খুবই অল্প সময়ের মধ্যে খামারটি লাভজনক হয়ে ওঠে। এখন প্রতিমাসে ওই খামার থেকে ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকা আয় করছেন।

সব উদ্যোক্তাদের দাবি, এই উপজেলায় দেশি মুরগির নীরব বিপ্লব ঘটেছে। আর এই বিপ্লবের নেপথ্যের কারিগর হলেন উপজেলা ভেটেরিনারী সার্জন মোহাম্মদ রায়হান। তার এই উদ্যোগ ‘স্বপ্ন ছোঁয়ার সিড়ি’ মডেল হিসেবে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। সেইসঙ্গে দেশি মুরগির সংরক্ষণ ও বিস্তারে নিরাপদ-প্রাণীজ আমিষের চাহিদা পূরণ এবং আর্থ-সামাজিক উন্নয়নসহ জাতীয় অর্থনীতিতে অবদান রাখছে। এদিকে স্বল্প বিনিয়োগে উদ্যোক্তা তৈরিতে অবদান ও জনসেবায় অনবদ্য ভূমিকা রাখায় ইতিমধ্যে জাতীয় পর্যায়ে (ব্যক্তিগত শ্রেণি) জনপ্রশাসন পদক পেয়েছেন ডা. রায়হান। এছাড়া জেলা ও রাজশাহী বিভাগীয় পর্যায়ে নাগরিক সেবায় শ্রেষ্ঠ উদ্ভাবনী কর্মকর্তার স্বীকৃতি অর্জন করেছেন তিনি। এমনকি ডা. মো. রায়হানের উদ্ভাবিত ‘স্বপ্ন ছোঁয়ার সিড়ি’ এই উদ্যোগটি সারা দেশে ছড়িয়ে দিতে বিশটি উপজেলায় পাইলট প্রকল্প গ্রহণের সুপারিশ করে মৎস্য ও প্রাণী সম্পদ মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়েছে সরকারের মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ (সমন্বয় ও সংস্কার)।

বগুড়ার শেরপুর উপজেলা উপজেলা ভেটেরিনারী সার্জন মোহাম্মদ রায়হান বলেন, স্বপ্ন ছোঁয়ার সিড়ি সংঘের খামারগুলোতে কোনো অ্যান্টিবায়োটিক ও স্টেরয়েড (হরমোন) ধরনের ওষুধ ব্যবহার করা হয় না। অর্গানিক পদ্ধতিতে এসব প্রতি মাসে চার হাজার কেজি দেশি মুরগির মাংস ও এক লাখ ৩০ হাজার ডিম উৎপাদিত হচ্ছে। দেশি মুরগির বাচ্চা উৎপাদনের জন্য এই উপজেলায় নয়টি হ্যাচারি গড়ে উঠেছে। এসব হ্যাচারিতে মাসে ৮৫ হাজার দেশি মুরগির বাচ্চা উৎপাদন করা সম্ভব হচ্ছে বলে জানান তিনি।

২০১৫ সালে এই উপজেলায় যোগ দিয়ে  জানতে পারেন তিনজন ব্যক্তি আব্দুল কাদের, আমজাদ হোসেন ও এনামুল হক তাদের বাড়িতে ৭০-৮০টি করে দেশি মুরগি পালেন। আর তখনি তার মাথায় আসে দেশি মুরগির খামারের চিন্তা। পরে তাদের তিনজনকে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে দেশি মুরগির খামার গড়ে তোলায় উদ্বুদ্ধ করেন। পাশাপাশি আধুনিক পদ্ধতিতে মুরগি পালনের জন্য প্রশিক্ষণও দেওয়া হয় তাদের। দ্রুততম সময়ের মধ্যে সফল হন তারা। একপর্যায়ে তাদের সফলতার গল্প ছড়িয়ে পড়ে গোটা উপজেলায়। এরপর থেকে পৌরসভাসহ এই উপজেলার দশটি ইউনিয়নে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে দেশি মুরগির খামারের কার্যক্রম শুরু হয়।

স্বপ্ন ছোঁয়ার সিড়ি খামার সংঘের সভাপতি সাদ্দাম হোসেন বলেন, স্বপ্ন ছোঁয়ার সিঁড়ির উদ্যোক্তারা নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষা করে চলছেন। এই কারণে বাজারজাত ও ব্যবসা সহজ হচ্ছে। যেমন সাধারণ খামারিরা হ্যাচারি মালিকদের কাছে ডিম সরবরাহ করতে পারছেন। অতিরিক্ত বাচ্চা হ্যাচারি থেকেই কিনে নিতে পারছেন নতুন নতুন উদ্যোক্তারা।

বগুড়া জেলা প্রাণীসম্পদ কর্মকর্তা ডা. রফিকুল ইসলাম তালুকদার বলেন, ওই কর্মকর্তার নিজস্ব চিন্তা-চেতনা ও সহযোগিতায় গড়ে ওঠা বাণিজ্যিক দেশি মুরগির খামার দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে। এছাড়া দেশি মুরগির চাহিদা ও দাম দুটোই বেশি হওয়ার কারণে খামারিরা ইতিমধ্যে ব্যাপক সফলতা পেয়েছেন।

বিডি প্রতিদিন/এমআই

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর