শেরপুরের পাহাড়ি বনাঞ্চলে বন্যহাতি ও মানুষের দ্বন্দ্ব থামছেই না। সম্প্রতি দ্বন্দ্ব আরও প্রকট আকার ধারণ করেছে। দীর্ঘদিন ধরে হাতি ও মানুষের মধ্যে চলছে চোর-পুলিশ খেলা। হাতি চলাচলের পথে অবাধে চাষাবাদ, বসতি নির্মাণ, বাগান করা, পাহাড়ে হাতির খাদ্য সংকটসহ নানান কারণে প্রায়শই মানুষের মুখোমুখি হয়ে পড়ছে হাতি। এতে প্রাণ হারাচ্ছে মানুষ-হাতি উভয়ই।
বিগত ২০১৪ সাল থেকে ২০২২ পর্যন্ত বন্যহাতির আক্রমণে মানুষ মারা গেছে ২৩ জন। আর হাতি মারা গেছে ২৭টি। তাই জীববৈচিত্র্য রক্ষা ও জানমাল বাঁচাতে অতি দ্রুত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা না নিলে হতাহতের সংখ্যা দিন দিন বাড়বে বলে স্থানীয়রা জানান।
জানা গেছে, ভারত থেকে নেমে আসা শতাধিক বন্য হাতি দীর্ঘদিন ধরে পাহাড়ি এলাকায় বসবাস করে আসছে। কিন্তু ক্রমান্বয়ে বনাঞ্চলের ভূমি স্থানীয়রা দখলে নেওয়ায় সংকুচিত হতে থাকে বনের পরিসর। এতে হাতির দল খাবারের সন্ধানে পালাক্রমে লোকালয়ে হানা দিয়ে ধ্বংসযজ্ঞ চালাচ্ছে। এ কারণে মানুষ হাতির ওপর ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে। তাই প্রায় সময় সংগঠিত হয় হাতি-মানুষের দ্বন্দ্ব। কখনো জয় হাতির, আবার কখনো মানুষের। একদিকে যেমন জন-জীবন ও ফসলের ক্ষতি হচ্ছে। অন্যদিকে বন্যহাতিও প্রাণ হারাচ্ছে।
ভুক্তভোগী এলাকাবাসী জানান, প্রায় দুই যুগ সময় ধরে গারো পাহাড়ে শতাধিক বন্যহাতির পাল কয়েকটি উপদলে বিভক্ত হয়ে লোকালয়ে হামলা চালাচ্ছে। মাঝে মধ্যেই হাতির এ তাণ্ডবে হতাহতের ঘটনা ঘটছে। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শত শত একর জমির মৌসুমী ফসল। লন্ডভন্ড করেছে বেশকিছু ঘরবাড়ি। তছনছ করছে বন বাগানের বিপুল পরিমাণের গাছপালা। হাতির হামলায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে পাহাড়ের গ্রামীণ জীবন। তাদের জীবন এখন হুমকির মুখে।
বন্যহাতির আক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে রাতের বেলায় গ্রামবাসী আগুন জালিয়ে হই-হুল্লোড় করে। বাঁশ দিয়ে পটকা বানিয়ে ঢাকঢোল পিটিয়ে ও মশাল জ্বালিয়ে হাতি তাড়ানোর চেষ্টা করে আসছে।
শেরপুর জেলার নালিতাবাড়ী উপজেলার সীমান্তবর্তী নাকুগাঁও স্থলবন্দর এলাকার কাটাবাড়ি, পানিহাটা, খলচান্দা, হাতিপাগাড়, দাওধারা, বাতকুচি ও বুরুঙ্গাসহ প্রায় ১২টি গ্রাম। শ্রীবরদী উপজেলার কর্ণঝোড়া, বাবলাকোনা, রাজারপাহাড়, ঝোলগাঁও, কোচপাড়া, রাঙ্গাজান, খাড়ামোরা হারিয়াকোনা ও মেঘাদলসহ ১৩টি গ্রাম। ঝিনাইগাতী উপজেলার বড় গজনী, ছোট গজনী, রাংটিয়া, সন্ধ্যাকুড়া, পানবড়, নকশী, তাওয়াকুচা ও গুরুচরন দুধনইসহ প্রায় ১৩টি গ্রামে বাঙালি, খ্রিস্টান, গারো, কোচ ও হাজংসহ বিভিন্ন গোত্র মিলে প্রায় অর্ধ-লক্ষাধিক মানুষ বসবাস করছে।
সূত্র জানায়, বাংলাদেশের বনাঞ্চল অপেক্ষাকৃত সমতল। ভারতের গহীন বনাঞ্চল রয়েছে অগণিত বন্যহাতি। এসব হাতি দল বেঁধে সমতল ভূমিতে চলাফেরা ও আহার করতে সহজ মনে করে থাকে। তাই সময়-অসময়ে হাতির পাল সীমান্তপথ পাড়ি দিয়ে ওইসব সমতল বনাঞ্চলের আবাসিক ও কৃষি প্রধান এলাকায় চলে আসে। পাহাড়ে বসবাসরত বাড়িঘর, ফসলাদির জমি ও বিভিন্ন বাগানে প্রবেশ করে ধ্বংসলীলা চালায়। গত প্রায় ২২ বছর ধরে এসব বন্যহাতির তাণ্ডবলীলায় সীমান্তবর্তী পাহাড়ি গ্রামগুলোতে অসংখ্য ঘরবাড়ি ফসলের মাঠ বিধ্বস্ত হয়েছে।
সরেজমিন দেখা গেছে, জেলার সীমান্তবর্তী পাহাড়ি এলাকার মানুষ পাহাড় থেকে লাকড়ি সংগ্রহ করে এবং পাহাড়ের পাদদেশে চাষাবাদ করে কোনোরকম জীবিকা নির্বাহ করেন। ক্ষুধা, দারিদ্র্য, অশিক্ষা, অস্বাস্থ্য ও নানা বঞ্চনা তাদের নিত্যসঙ্গী। এর ওপর প্রায় বন্যহাতির আক্রমণ দিশেহারা করে দিয়েছে তাদের। হাতির আতঙ্কে এমনিতেই হাজার হাজার একর জমি পতিত থাকছে। ঝুঁকি নিয়ে চাষাবাদ করলেও সে ফসল তারা ঘরে তুলতে পারছেন না। ফলে পাহাড়ি জনপদের মানুষগুলো হাতির সাথে যুদ্ধ করে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছেন।
নালিতাবাড়ী উপজেলার পানিহাটা এলাকার বিজার কুবি জানান, বন্যহাতি ঢাকঢোল পটকা ও আগুনকে ভয় পায়। তাই এলাকাবাসী মশাল ও বন থেকে কুড়িয়ে আনা আবর্জনা জ্বালিয়ে হই-হুল্লোড় করে বাঁশ দিয়ে পটকা বানিয়ে ঢাকঢোল পিটিয়ে ও মশাল জ্বালিয়ে হাতি তাড়ানোর চেষ্টা করে। অনেক সময় বাধা না পেলে হাতির দল গ্রামে প্রবেশ করে জানমালের ক্ষতিসাধন করে থাকে।
শেরপুরের বন বিভাগের বন্যপ্রাণী ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ কর্মকর্তা সুমন সরকার বলেন, বন্যহাতির তাণ্ডব থেকে মানুষ ও হাতিকে বাঁচাতে ইতিমধ্যেই সরকার গারো পাহাড়ে অভয়ারণ্য সৃষ্টি ও ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণে নগদ আর্থিক সহায়তা প্রদানসহ বৃহৎ পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। এরই অংশ হিসেবে বন্যহাতির আক্রমণে নিহত ব্যক্তির পরিবারের জন্য ৩ লাখ, আহতকে ১ লাখ এবং ঘরবাড়ি ও ফসলের ক্ষতিগ্রস্তকে ৫০ হাজার টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হচ্ছে। এছাড়া শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে মানুষ ও বন্যহাতির দ্বন্দ্ব নিরসনে পাহাড়ি এলাকার বাসিন্দাদের বিভিন্ন সচেতনতামূলক কর্মশালা পরিচালনা করা হচ্ছে।
বিডি প্রতিদিন/এমআই