সুন্দরবনজুড়ে আজ মঙ্গলবার থেকে শুরু হচ্ছে মধু আহরণ মৌসুম। মধু আহরণ চলবে আগামী ৩০ মে পর্যন্ত।
বিগত বছরগুলোতে সুন্দরবন বিভাগ মধু আহরণ মৌসুম ১ এপ্রিল থেকে ৩০ মে পর্যন্ত দুই মাস সীমাবদ্ধ রাখলেও এবার খলসি গাছের ফুলের উৎকৃষ্ট মানের মধু আহরণ করতে ১৫ মার্চ থেকে মধু আহরণ শুরু হচ্ছে। তবে সুন্দরবন পূর্ব ও পশ্চিম দুই বিভাগের বনাঞ্চলের ভৌগোলিকগত অনেক পার্থক্য থাকার কারণে দুই বিভাগের সমগোত্রের গাছপালাও একই রকম জন্মায় না। সুন্দরবনে যে কয়টি প্রজাতির ফুলের মধু পাওয়া যায়, তার মধ্যে খলসি ও গরাণ ফুলের মধু উন্নতমানের। এরমধ্যে আাগাম ফুল আসে খলসি গাছে।
সুন্দরবনের দুই বিভাগের মধ্যে পশ্চিম বিভাগের সাতক্ষীরা রেঞ্জে খলসি প্রজাতির গাছ অধিক পরিমাণ থাকায় সেখানের মৌয়ালরা বন বিভাগের কাছ থেকে অনুমিতপত্র (পাশ-পারমিট) নিয়ে আজ মঙ্গলবার ভোর থেকে সুন্দরবনে যাচ্ছেন। তবে সাতক্ষীরা তুলনায় পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের শরণখোলা ও চাঁদপাই রেঞ্জে খলসি গাছ খুবই কম থাকায় বাগেরহাটের মৌয়ালরা এখনো বন বিভাগ থেকে পাশ গ্রহণ করেনি। তারা আজ সুন্দরবনে যাচ্ছে না মধু আহরণ করতে।
বাগেরহাটের অভিজ্ঞ মৌয়াল ও মধু ব্যবসায়ীরা জানান, সুন্দরবনের গাছে সবেমাত্র ফুল আসতে শুরু করেছে। মৌমাছিরা এখন বাসা তৈরিতে ব্যস্ত। পূর্ণাঙ্গ মৌচাক তৈরি হয়নি এখনও। এই মুহূর্তে চাকে আঘাত লাগলে বা মধু সংগ্রহের জন্য মশাল জ্বালিয়ে ধোঁয়া দিলে মৌমাছিরা বন ছেড়ে অন্যত্র চলে যাবে। ফলে মধু সংরক্ষণ বাধাগ্রস্ত হবে। ফলে মৌমাছি-মৌয়াল উভয়ই ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
বাগেরহাটের শরণখোলা উপজেলার খুড়িয়াখালী গ্রামের নূর ইসলাম ফরাজী (৬৫), সোবাহান ফরাজী (৪৫), চালিতাবুনিয়া গ্রামের আনোয়ার আকন (৫৫), বগী গ্রামের শাহজাহান হাওলাদার (৫৮), সোনাতলা গ্রামের ফজলু তালুকদারসহ (৬০) অভিজ্ঞ এসব মৌয়ালরা জানান, আগাম পাসে লাভবান হবে পশ্চিম বিভাগের মৌয়ালরা। এই সময় বনে গেলে পূর্ব বিভাগের মৌয়ালদের পুরো একটি গোন (১৫ দিনে এক গোন) লোকসান গুনতে হবে। এখনও সুন্দরবন পূর্ব বিভাগের এসব মৌয়ালরা দল গঠন, নৌকা প্রস্তুত বা মহাজনের কাছ থেকে দাদনও নেওয়া শুরু করেননি তারা সবাই বনে মাছ ধরাসহ এলাকায় অন্য কাজে ব্যস্ত রয়েছেন। তাই ১৫ মার্চ পাস গ্রহণ করবেন না, আগামী ১ এপ্রিল থেকে তারা মধু আহরণ করতে সুন্দরবনে যাবেন।
সুন্দরবন বিভাগ গতবারের তুলনায় এ বছর মধু আহরণের রাজস্ব বৃদ্ধি পেয়েছে দ্বিগুণ। আগে যেখানে ১৫ দিনে জনপ্রতি রাজস্ব ছিল ৭৫০ টাকা। এবার সেখানে জনপ্রতি ১৫০০ টাকা করা হয়েছে। বাগেরহাটের পূর্ব সুন্দরবন বিভাগ এ বছর (২০২১-২০২২ অর্থবছর) ১০৫০ কুইন্টাল মধু এবং ৩৫০ কুইন্টার মোম আহরণ ও রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১১ লাখ টাক। গত বছর পূর্ব সুন্দরবন বিভাগ থেকে ২৭৩ জন মৌয়াল পাশ পারমিট নিয়ে সুন্দরবন থেকে ১০৪৪ কুইন্টাল মধু ও ৩৫০ কুইন্টার মোম আহরণ করে। রাজস্ব আয় হয় ১০ লাখ ৯৬ হাজার ২০০টাকা।
বাগেরহাটের পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মোহাম্মদ বেরায়েত হোসেন মৌয়ালদের এই যুক্তির সঙ্গে একমত প্রকাশ করে জানায়, সুন্দরবনের শরণখোলা ও চাঁদপাই এলাকা নিয়ে বাগেরহাট পূর্ব বনবিভাগ এবং খুলনা ও সাতক্ষীরা নিয়ে হচ্ছে পশ্চিম বিভাগের বনাঞ্চলের ভৌগোলিকগত অনেক পার্থক্য রয়েছে। এ কারণে দুই অঞ্চলে সমগোত্রের গাছপালাও একই রকম জন্মায় না। সুন্দরবনে যে কয়টি প্রজাতির ফুলের মধু পাওয়া যায়, তার মধ্যে খলসি ও গরাণ ফুলের মধু উন্নতমানের। বাগেরহাটের পূর্ব বিভাগের শরণখোলা ও চাঁদপাই রেঞ্জে গরাণ গাছের আধিক্য বেশি। এই গরাণের ফুল আসা শুরু হয় মার্চের শেষ দিকে, থাকে পুরো এপ্রিল মাস পর্যন্ত।
এদিকে, আগাম ফুল আসা খলসি প্রজাতির গাছ কেবলমাত্র পশ্চিম বিভাগের সাতক্ষীরা অঞ্চলেই বেশি। সুন্দরবনে খলসি প্রজাতির গাছে ফুলের মধু দেশে প্রাকৃতিকভাবে আহরিত মধুর মধ্যে সর্বোৎকৃষ্টমানের। দাম এবং চাহিদা দুটোই বেশি। সঠিক সময় এই মধু আহরণ না করায় তা বনের অন্য পেশাজীবীরা চুরি করে নিয়ে যায়। ফলে প্রকৃত এবং পাসি মৌয়ালরা পর্যাপ্ত খলসি মধু সংগ্রহ করতে পারেন না। এবং এতে বনবিভাগও রাজস্ব বঞ্চিত হয়। যে কারণে খলসি ফুলের উৎকৃষ্ট মানের মধু বেশি পরিমাণ আহরণ করতে ১৫ দিন এগিয়ে দুই মাস থেকে আড়াই মাস মধু আহরণ মৌসুম করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সুন্দরবন বিভাগ।
পূর্ব বিভাগে মধু আহরণ করতে মৌয়ালরা এখন না গেলেও সমস্যা হবে না। আহরণ না করলে সেই মধু চাকেই থেকে যাবে। পরে যখন যাবেন তখন আহরণ করতে পারবেন। আগাম আসা এই মধু যাতে অন্য কেউ অবৈধভাবে আহরণ করতে না পারে, এজন্য স্মার্ট পেট্রোলিংসহ বনবিভাগের টহল জোরদার করা হবে।
বিডি-প্রতিদিন/বাজিত হোসেন