হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলার খোয়াই নদীসহ বিভিন্ন নদ-নদী ও পাহাড়ি ছড়া থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করে আসছে একটি প্রভাবশালী মহল। আর এতে করে একদিকে যেমন সরকার হারাচ্ছে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব, অন্যদিকে হুমকির মুখে পড়ছে পরিবেশ। এছাড়াও ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এলাকার রাস্তা-ঘাট ও ফসলি জমি।
স্থানীয়দের অভিযোগ, দিনের পর দিন ড্রেজার মেশিন বসিয়ে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করে আসলেও প্রশাসন কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিচ্ছে না। তবে প্রশাসন বলছে, অবৈধভাবে বালু উত্তোলনকারীদের কোনো ছাড় নেই। তাদের বিরুদ্ধে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে।
জানা যায়, আঁকাবাঁকা পথ আর সবুজ টিলায় ছেয়ে রয়েছে চুনারুঘাট উপজেলা। এ উপজেলার অধিকাংশ টিলায় রয়েছে চা-বাগান। আবার কোথাও কোথাও সমতল ভূমি। কোনো কোনো এলাকা দিয়ে আবার বয়ে গেছে ভারত থেকে বয়ে আসা নদ-নদী। এ যেন অপরূপ সৌন্দর্যের এক লীলাভূমি। এছাড়াও ৪২৭ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের এই উপজেলার সর্বত্র ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে অসংখ্য পাহাড়ি ছড়া। আর এসব ছাড়ায় রয়েছে মূল্যবান সিলিকা বালু। একই সাথে ভারতের ত্রিপুরা থেকে উৎপত্তি হওয়া খোয়াই নদী দিয়ে প্রতিনিয়ত আসছে বালু। আর সেইসব বালু প্রতিটি পয়েন্টে পয়েন্টে ড্রেজার বসিয়ে অবৈধভাবে উত্তোলন করছে প্রভাবশালী মহল।
জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছর খোয়াই নদীতে ৬টি বালু মহাল ইজারা দেওয়া হয়েছে। এতে সরকারের রাজস্ব আয় হয়েছে ৭ কোটি ৪ লাখ ৫০ হাজার টাকা। কিন্তু বাস্তব চিত্র ভিন্ন। ৬টি মহাল ইজারা দেওয়া হলেও অবৈধভাবে বালু উত্তোলনকারীরা প্রভাব খাটিয়ে আরো অন্তত ডজনখানেক স্থান থেকে প্রতিনিয়ত বালু উত্তোলন করে আসছে। এমন অবস্থায় বালু ব্যবসার সাথে জড়িতরা বলছেন, প্রতি বছর যদি বৈধ উপায়ে সকলে বালু উত্তোলন করতো, তা হলে সরকারের অন্তত শতকোটি টাকার রাজস্ব আয় হতো। কিন্তু অধিকাংশই অবৈধ হওয়ায় সরকার এ বিপুল পরিমাণ রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
এদিকে, শুধু চুনারুঘাট উপজেলায়ই নয়, চুনারুঘাট দিয়ে বয়ে আসা খোয়াই নদী শায়েস্তাগঞ্জ হয়ে হবিগঞ্জ শহরের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে। চুনারুঘাট থেকে শুরু করে শায়েস্তাগঞ্জ ও হবিগঞ্জ শহরের আশপাশে আরো অন্তত শতাধিক বালুর স্পট রয়েছে। সেই সব স্পট থেকেও অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। যার ফলে কোথাও কোথাও বালু উত্তোলনের কারণে ছড়া পরিণত হয়েছে বিশাল পুকুরে। ভেঙে পড়ছে ফসলি জমিসহ টিলা। ব্রিজের গোড়া থেকে বালু তোলার কারণে হুমকিতে রয়েছে বেশ কয়েকটি ব্রিজও। বালু বহনের জন্য ট্রাক্টর ব্যবহার করায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে রাস্তা-ঘাট ও নদ নদীর পাড়। তাই স্থানীয়দের দাবি দ্রুত যেন এ বিষয়ে প্রশাসন কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করে।
চুনারুঘাট উপজেলার বাসিন্দা আব্দুল কাইয়ুম জানান, অবৈধ বালু উত্তোলনকারীদের কারণে আমাদের এলাকা এখন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। ছোট ছোট ছড়াগুলো বিশাল বিশাল পুকুরে পরিণত হচ্ছে। এমনকি পাহাড়ের পাদদেশ থেকেও বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। প্রকাশ্যে এসব হলেও ভয়ে তাদের বিরুদ্ধে কেউ মুখ খুলতে সাহস পায় না। প্রশাসন নামে মাত্র অভিযান চালিয়ে শ্রমিকদের জরিমানা করে ছেড়ে দেয়।
ফরিদ উদ্দিন নামে একজন জানান, চুনারুঘাটের এমন কোনো রাস্তা-ঘাট নেই, যেখানে রাস্তার পাশে বালুর স্তুপ নেই। প্রভাবশালীরা অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করে রাস্তা পাশে রেখে দেয়। পরে তারা তা ট্রাক্টরযোগে পাচার করে। ফলে আমাদের এলাকায় রাস্তা-ঘাট বেহাল দশায় পরিণত হচ্ছে।
সাইফুর রহমান নামে এক ব্যক্তি জানান, অবৈধ বালু উত্তোলনকারীদের বিরুদ্ধে প্রশাসন এখনই যদি কঠোর অবস্থানে না যায়, তাহলে সামনে আমাদের জন্য ভয়াবহ বিপর্যয় অপেক্ষা করছে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন বাপা হবিগঞ্জের সাধারণ সম্পাদক তোফাজ্জুল সোহেল বলেন, প্রকৃতি মানব জীবনে এক অমূল্য সম্পদ। প্রকৃতিকে আমাদের বাঁচিয়ে রাখতে হবে। তাই পরিবেশ রক্ষায় যারা অবৈধ ও নিয়ম বহির্ভূতভাবে এসব কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। তিনি বলেন, গুটি কয়েকজনের জন্য পুরো এলাকার পরিবেশ ধ্বংস হতে পারে না।
চুনারুঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সিদ্ধার্থ ভৌমিক বলেন, অবৈধভাবে বালু উত্তোলনকারীদের কোনো ছাড় দেওয়া হচ্ছে না। খবর পাওয়া মাত্রই অভিযান চালানো হচ্ছে। তিনি বলেন, অবৈধভাবে বালু উত্তোলনকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে রয়েছে উপজেলা প্রশাসন। সবশেষ গত ৫ সেপ্টেম্বরও অভিযান চালানো হয়েছে। এসময় ঘটনাস্থলে কাউকে পাওয়া না গেলেও সাতটি অবৈধ ড্রেজার মেশিন ও ৬ হাজার ঘনফুট বালু জব্দ করা হয়েছে। এমন অভিযান চলমান থাকবে।
হবিগঞ্জের জেলা প্রশাসক ইশরাত জাহান বলেন, হবিগঞ্জ থেকে সরকারের রাজস্ব আয়ের অন্যতম একটি খাত বালু। তাই অবৈধ পন্থায় বালু উত্তোলন বন্ধ করতে প্রশাসন তৎপর। তিনি বলেন, প্রতিনিয়ত উপজেলা ও জেলা প্রশাসন খবর পাওয়া মাত্রই অভিযান চালাচ্ছে। যারা অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করবে তাদের ছাড় দেওয়া হবে না।
বিডি প্রতিদিন/এমআই